শিশুকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে নির্ঘুম মা, কী করবেন

শিশু লালন-পালনের অন্যতম কষ্টকর বিষয় বোধহয় সন্তানের না ঘুমানো সময়মতো। সন্তানকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে দিনরাত মায়েরা নির্ঘুম থাকেন।

লুনা পারভীনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Feb 2022, 09:11 AM
Updated : 26 Feb 2022, 09:11 AM

যুক্তরাষ্ট্রের ‘একাডেমি অফ পেডিয়াস্ট্রিকস’-এর মতে ২৫-৫০% পর্যন্ত সুস্থ শিশুর ঘুমের সমস্যা হয় এবং বাড়ন্ত বয়স বা টিনএজেও এর সংখ্যা ৪০% এর কাছাকাছি।

কতটুকু ঘুম প্রয়োজন শিশুর? স্লিপ ফাউন্ডেশনের মতে, একটা নবজাতক শিশু ৮-১৮ ঘণ্টা ঘুমাতে পারে, একটু বড় শিশুদের ৮-১০ ঘণ্টা ঘুম দরকার এবং বড়দের ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমালেই হয়। অল্পকিছু সংখ্যক মানুষ মাত্র ৩ ঘণ্টা ঘুমিয়েও দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারে।

শিশুর ঘুম না হওয়ার কারণ:

১. নবজাতকের ক্ষেত্রে শুরুতেই দিনরাতের পার্থক্য না বুঝতে পারা। ওদের শরীরে বায়োলজিকাল ক্লক তৈরি হতে সময় নেয় যা কিনা মানুষের ঘুম নিয়ন্ত্রণ করে।

২. একটু বড় শিশুরা ঘুমিয়ে গেলে মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশংকায় বা মজার কিছু মিস করার দুশ্চিন্তায় সহজে ঘুমাতে চায় না।

৩. এছাড়া ঘুমানোর জন্য সঠিক সময় ও পরিবেশ না পেলেও শিশুরা ঘুমাতে চায় না।

৪. ছোটখাটো শারীরিক সমস্যা যেমন নাকবন্ধ, পেটে গ্যাস, দুঃস্বপ্ন, ঘুমের মধ্যে হাঁটা বা কথা বলা, অ্যালার্জি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া থেকে শুরু করে খিঁচুনি, এডিএইচডি বা অটিজমের মতো মারাত্মক রোগেও ঘুমের সমস্যা হতে পারে।

মায়েদের ঘুম না হওয়ার কারণ:

১. গর্ভবতী অবস্থায় পেটে চাপ লাগা, অস্থিরতা, মানসিক চাপ, রাত জেগে বারবার প্রস্রাব হওয়া, এসব কারণে মায়েদের ঘুম হয় না।

২. সন্তান হওয়ার পর আরও টেনশন- মা ঘুমিয়ে গেলে সন্তানের যদি সমস্যা হয় বা জেগে যায়, সন্তানের যদি ক্ষুধা লাগে, সন্তান যদি প্রস্রাব করে ভিজে যায়!

ঘুম হওয়ার পূর্বশর্ত:

১. ঘুমের একটা নির্দিষ্ট রুটিন থাকা দরকার। প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যেতে হবে। তার চেয়েও বড় কথা নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে না পারলেও উঠা যেন একই সময় হয়। তাহলে আস্তে আস্তে শিশুরা সময়মতো ঘুমানোর চেষ্টা করবে।

২. সন্ধ্যার পর থেকে পানি, তরল, চা-কফি, চিনি জাতীয় খাবার কমিয়ে বা বন্ধ করে দিতে হবে। ঘুমানোর কাছাকাছি সময়ে কোন ভারি খাবার দেওয়া যাবে না।

৩. ঘরের পরিবেশ ঘুমের উপযোগী হতে হবে। ভারি পর্দা দিয়ে ঘর অন্ধকার করে দিতে হবে। তবে যেসব শিশু অন্ধকারে ভয় পায় তাদের জন্য ঘরে হালকা রঙিন বাতি জ্বেলে রাখা যেতে পারে।

৪. ঘুমানোর ঘরটায় যথেষ্ট আরামদায়ক, ঠান্ডা, শব্দহীন বা হালকা শব্দ বা গান দিয়ে রাখতে হবে যেন বাইরের আওয়াজ না শোনা যায়।

৫. শিশুর ঘুমের আলাদা পোশাক থাকা ভালো। আলাদা ঘুমের পোশাক শিশুকে ঘুমের আবহ এনে দেবে।

৬. সন্ধ্যার পর থেকে টিভি দেখা, মোবাইল গেইম কমিয়ে লেখাপড়া বা নিজেরা গল্পগুজব করা, গান ছড়া আবৃত্তি, শিশুতোষ বই পড়া যেতে পারে। তবে টিভির শিশুতোষ অনুষ্ঠান দেখা যেতে পারে, কারণ মোবাইলের গেইম বা কার্টুন শিশুর মস্তিষ্ককে উত্তেজিত করে রাখে, এতে ঠিকমতো যেমন ঘুম আসে না তেমনি ঘুমালে স্বপ্নের মধ্যে নানাকিছু দেখে ভয় পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে যায়।

৭. ঘুম ছাড়া শিশুকে বিছানায় নেবেন না। প্রয়োজনে দিনের বেলা তাকে কম ঘুমাতে দিন।

ঘুমানোর সময় করণীয়:

১. শিশুকে আগেই বুকের দুধ বা হালকা কিছু খাওয়াবেন।

২. দাঁত ব্রাশ করিয়ে গা মুছে দিয়ে রাতের পোশাক পরাবেন।

৩. গা, হাত-পা ম্যাসাজ করে দেবেন ও হালকা কোন গান, গল্প বা ছড়া শোনাবেন।

৪. ঘুমিয়ে যাওয়ার পর নয়, ঘুমঘুম ভাব হলেই শিশুকে বিছানায় শুইয়ে দেবেন।

৫. সঙ্গে প্রিয় খেলনা রাখতে দেবেন বা পছন্দের চাদর বা বালিশ গায়ে দিয়ে দেবেন।

৬. প্রয়োজনে রাতের বেলা ডায়পার পরিয়ে ঘুম পাড়াবেন যেন প্রস্রাবে ভিজে ঠান্ডা কাশি লেগে না যায়।

৭. যাদের শিশু দিনের বেলা টানা ঘুমায় তারা চেষ্টা করবেন দিনের ঘুমটা ১ ঘণ্টা করে বেশি জাগিয়ে আস্তে কমিয়ে আনতে আর রাতে এক ঘণ্টা বা আধাঘণ্টা বেশি ঘুম পাড়িয়ে রাখতে। এভাবেই আস্তে আস্তে দিনে না ঘুমিয়ে জেগে থাকার ও রাতে ঘুমিয়ে থাকার অভ্যাস করাতে হবে।

৮. গর্ভবতী মায়েরা রাতে কম পানি খাবেন। ঘুমানোর আগে ২/৩ বার ওয়াশরুমে যাবেন। বাম কাত হয়ে শুবেন। দিনে অল্প করে বারবার ঘুমিয়ে নেবেন। হাঁটুর মাঝে, পেটের নিচে ও পিঠে বালিশ দেবেন। হালকা ব্যায়াম করা, গান শোনা, গল্পের বা ধর্মীয় বই পড়ায় মুড ভালো হবে।

৯. বুকের দুধ খাচ্ছে যাদের সন্তান, সেসব মায়েদের আসলে ঘুমের কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবু বলবো, শিশুর ঘুম ও খাওয়ার ফাঁকে নিজের জন্য কিছুটা সময় বাঁচিয়ে হলেও নিজের পুষ্টি, ঘুম, মানসিক শান্তির জন্য পছন্দের কাজটি করুন। পরিবারের অন্য সদস্য এমনকি খুদে সদস্যেরও সহযোগিতা নিন ঘরের কাজে। শিশুকে ঘরের খাবারেই অভ্যস্ত করুন, মাঝে মাঝে বেড়াতে নিয়ে যান খোলা মাঠে বা ছাদে নিয়ে আকাশ চেনান, শিশুকেও তার মনের কথাগুলো বলতে দিন, মতামতের গুরুত্ব দিন।

১০. সবশেষে পরিবারের অন্যান্য সদস্য, আত্মীয়, প্রতিবেশীদের বলবো, একজন মাকে তার সন্তান নিয়ে খোঁটা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বা দোষ না দিয়ে সহায়তা করুন, তার প্রতি সহমর্মী হোন। কিছু না পারেন তো মুখ বন্ধ রাখুন, তবু ভুল পরামর্শ বা মানসিক চাপ দেবেন না।

লেখক: শিশু বিশেষজ্ঞ, বহির্বিভাগ, ঢাকা শিশু হাসপাতাল

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!