হাঁস আর হাঁসি

বনের মধ্যে একটা পুকুর। অনেক পুরনো। পানি তেমন বেশি না। আবার কমও না। সেই পুকুরে রোজ সাঁতার কাটে দুটো পাতিহাঁস- একটা হাঁস, আরেকটা হাঁসি।

মুস্তাফা মাসুদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Nov 2021, 08:33 AM
Updated : 22 Nov 2021, 08:43 AM

ওদের পালকগুলো দুধের মতো সাদা। একেবারে রাজহাঁসের মতো। শুধু হাঁসির মাথার দিকটা একটু নীলচে-সবুজ।

ওরা শুধু কি সাঁতার কাটে? নাহ্, তাও বা বলি কেন। মাঝে মাঝে পানির মধ্যে ভুসভুস করে ডুব দেয় আর বেশ খানিকক্ষণ পর ওপরে ওঠে। মুখে গুগলি শামুক। কখনো মাছ। কখনো ঝিনুক। কখনো শালুক কিংবা অন্য কোনো খাবার। সেগুলো খাওয়া হলে খানিকক্ষণ সাঁতার কাটে। দু’জন খুনসুটি করে। ডানা নাচিয়ে ফুর্তি করে।

তারপর পেট একটু খালি হলেই আবার পানির তলায় ডুব। আবার খাবারের খোঁজ। কোনো কোনো ডুব মিসও হয়। কিছুই ধরতে পারে না। তাতে ওদের উৎসাহ কমে না। মুখও গোমড়া করে না। আবার ডুব, আবার ভেসে ওঠা। আবার ডুব, আবার...।

এভাবেই দিন কাটে হাঁস আর হাঁসির। সন্ধে হলেই ওদের আর এখানে দেখা যায় না। কোথায় যায়, কে জানে!

পুকুরের চারপাশে ঘন বন। বিরাট গাছগাছালি। লতাপাতায় ঘেরা চারদিক। এক দুপুরের কথা। হাঁস দুটো এইমাত্র ডুব থেকে পানির ওপর মাথা তুলেছে। হাঁসের মুখে একটা শামুক আর হাঁসির মুখে ঝিনুক। ওরা তাড়াতাড়ি তা গিলে খেলো। ঠোঁট ডুবিয়ে খানিকটা পানিও খেয়ে নিল। তাতে নাকি হজমটা ভালো হয়। পেটটা এখন বেশ ভারি ভারি।

হাঁসি এবার ডানা ঝাঁপটে আর গলা ফুলিয়ে কী একটা গান গাইতে যাবে, এমন সময় হাঁস বলে হাঁসিকে- শোন্ হাঁসি, একটা দামি কথা কই....

শামুক আর ঝিনুক খোঁজা ছাড়া তুই আর দামি কিছু জানিস নাকি! একটা ভালো গপ্প জানিস না। সুর করে গান গাইতে পারিস না।

হাঁসির কথায় একটু চাপা অভিমান ঝরে পড়ে। তখন হাঁস বলে- শোন্ হাঁসি, সবাই কী সব পারে? পারে না। তাতে কী? তুই গপ্প জানিস। গান জানিস। তোর গপ্প আর গান আমি শুনি। আমার ভারি ভালো লাগে। তবে শোন্, এখন আমি সত্যি সত্যি একটা দামি কথা বলব। সেটা হলো- মানুষেরা কেন যে বনের বাঘকে বাঘমামা বলে তা আমার মাথায় আসে না। তোর মাথায় আসে?

হাঁসি মাথাটা একটু নাড়িয়ে বলে- নাহ্, আসে না। বাঘ হলো মানুষের এক নম্বর শত্রু। মানুষ-গরু-ছাগল-ভেড়া বাগে পেলেই হলো, ঘাড় মটকে খাবে। কোনো খাতির করবে না। তারপরও বাঘ মানুষের মামা হয় কী করে! মানুষের মাথায় কেমন বুদ্ধি, কিচ্ছু বুঝি না ছাই! তুই বুঝিস?

না রে হাঁসি, আমিও বুঝি না। এখন দেখি তুইও বুঝিস না। তাহলে কী হলো? তাহলে এই হলো যে, এত বুঝে আর আমাদের কাজ নেই। এখন আয় ডুব...

কথা শেষ হয়নি হাঁসের। তখনি তার চোখ পড়ে পুব পাড়ের দিকে। সে ইশারায় হাঁসিকে তা দেখায়। ফের তাকায় উত্তর দিকে। এবারও ইশারা করে হাঁসিকে। হাঁস আর হাঁসি পাড়ের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ফিট হওয়ার যোগাড়। দেখে, বিশাল দুটো বাঘ। সারা গায়ে ডোরা ডোরা দাগ। লেজ দুলছে ঘন ঘন। আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে পানির দিকে। জিবে দিয়ে লালা ঝরছে টপ টপ।

হঠাৎ পুব পাড়ের বাঘ মশাই একটু থামে। উত্তর পাড়েরটার দিকে তাকায়। একটুখানি খুশির হাসি হেসে বলে- দেখলি তো গিন্নি, আজ ভাগ্য কেমন ভালো! এলাম গোসল করতে। একটু সাঁতার-টাতার কাটতে। তা তো হবেই। সেইসাথে একটু হালকা নাশতাও হয়ে যাবে। পাতিহাঁস দুটো ছোটো। তবে বেশ নাদুস-নুদুস। মাংসালো। চল আগে ওই দুটোকে ধরি। নরম নরম মাংসগুলো পেটের মধ্যে ভরি। তারপর হবে সাঁতারকাটা। ফুর্তি করা।

হাঁস আর হাঁসি বাঘের সব কথা শুনেছে। ওরাও কানে কানে ফিসফিস করে কীসব বলাবলি করে। সেসব কথা আর কিছুই নয়, নিজেদের জীবন বাঁচানোর শলাপরামর্শ। হাঁস বলছে হাঁসিকে- দেখ্ হাঁসি, কোনোভাবেই ধরাপড়া যাবে না। ওরা বনের রাজা। অনেক বড় ওদের শরীর। সেই শরীরে অঢেল শক্তি। দাঁত-নখে ভীষণ ধার।

তাতে কী হয়েছে! আমাদের মতো বুদ্ধি কি আছে ওদের? আমরা ভুস করে ডুব দিয়ে অনেকক্ষণ পানির নিচে থাকতে পারি। ওরা কি তা পারে? পারে না। তো শোন্ হাঁসি, ভয় পাবি না। ওই ডুবই আমাদের বাঁচার উপায় হবে। ওই দেখ্, গাড়ল দুটো এগিয়ে আসছে আস্তে আস্তে। ভাবছে, যেন আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। সাবধান! থাবা দেওয়ার আগেই ভুস করে ডুব দিবি। ভেসে উঠবি গিয়ে অনেক দূরে। দেখি ব্যাটারা ক্যাম্নে ধরে আমাদের! ওদের নাশতা খাওয়ার শখ...

হাঁস পুরোটা বলার সময় পায় না। এরইমধ্যে পুব পাড়েরটা একেবারে কাছে চলে এসেছে। দেরি না করেই সে থাবা মারে হাঁসকে লক্ষ্য করে। খুব বেশি জোরে মারেনি। ভাবে এটুকুন পুঁচকে হাঁসকে ধরতে গিয়ে কত জোরেইবা থাবা ফেলবে! কিন্তু তিন সেকেন্ডের মধ্যেই সে বুঝতে পারে, থাবা মিস হয়েছে। তার আগেই পাতিহাঁস উধাও। এক ডুবে পানির নিচে। খানিকক্ষণ শাপলা ডাঁটার গোড়া ধরে বসে থাকে। দু’-একটা গুগলিও খায়। তারপর অনেক দূরে গিয়ে ভেসে ওঠে।

ঠিক একই সময়ে হাঁসিও তাই করেছে। উত্তর পাড়েরটা থাবা ফেলার আগে সেও ভুস করে ডুব। অনেকক্ষণ পরে পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় গিয়ে ভেসে ওঠে সে। দেখে, হাঁসও খানিক দূরে ভাসছে। হাঁসিকে দেখেই সে প্যাক প্যাক করে আনন্দ প্রকাশ করে। হাঁসিও ডানা ঝাঁপটায় আর বাঘেদের দিকে তাকিয়ে হি হি করে হাসে। ওদেরকে ভ্যাঙ্গায়।

এতে বাঘ দুটোর রাগ আর দেখে কে! আবার এগিয়ে যায় হাঁস আর হাঁসির দিকে। হাঁস পুব দিকে এগোতে থাকে। তার ইশারা পেয়ে হাঁসি যায় উত্তর-পশ্চিম দিকে। তা দেখে বাঘ আর বাঘিনীর সেকি গর্জন- হালুম হুলুমু! পেলুম খেলুম! আর সেকি চোখ রাঙানি! কিন্তু হাঁস দুটো একটুও ভয় পায় না। ওদের যেন ভারি ফুর্তি বেড়েছে। বাঘ দুটোর সাথে যেন জলখেলায় মেতেছে! বাঘ-বাঘিনী আবার থাবা ফেলে- ঝপ্। হাঁসেরাও চটজলদি ডুব মারে- ভুস। এবারও ফেল। এবারও খালিহাত বাঘমামা আর বাঘমামির। থাবার সাথে শুধু আটকে আছে কয়েকটা শাপলার পাতা আর কয়েক গাছা শ্যাওলা।

হাঁস আর হাঁসি এবারও ডুব-সাঁতারে পগারপার। ওই অনেক দূরে গিয়ে ভেসে ওঠে। তা দেখে মামা কয় মামিকে- ভারি ল্যাঠা হলো দেখি! পুঁচকে দুটো তো জ্বালিয়ে খেলো! সেই তো পড়বি ধরা। তো, এভাবে কেন খাটাচ্ছিস বাবারা! আয় আয়। ধরা দে। ধরা দে। এই বলে বাঘ আবার এগোয়। বাঘিনীও। হাঁসেরাও রেডি। ওদের মুখে খুশির হাসি আর প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক ডাক। নাকি ফুর্তির গান! বাঘ-বাঘিনী আরও কাছে গিয়ে মারে থাবা ঝপাঝপ থপাথপ। ভাবে, এবার ঠিকই ধরা পড়বে পুঁচকে দুটো। থাবাও বেশ ভারি ভারি লাগছে। ওদের মুখে তখন জয়ের হাসি।

দশ সেকেন্ড পর। বাঘ-বাঘিনী আস্তে আস্তে থাবা ওঠায় পানির ওপর। এবার কি শিকার ধরা পড়েছে?... নাহ্! এবারও ফসকে গেছে! থাবার মধ্যে আটকে আছে একগাদা ময়লা-জঞ্জাল। ঠিক তখনি তাকিয়ে দেখে হাঁস আর হাঁসি পুকুরের মাঝখানটায় ভাসছে। হি হি করে হাসছে। মাঝে মাঝে গলা খ্যাকারি দিয়ে কাশছে। যেন মজার খেলা খেলতে খেলতে হাঁপিয়ে উঠেছে দুইজন।

অমন ফাঁকা জায়গায় জ্বলজ্যান্ত দুটো খাবার ভাসছে। মামা-মামির খিদে আরো চাগাড় দিয়ে ওঠে। জিবে দিয়ে লালা পড়ে। চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরে। আবার এগোয়। আবার ঝপ। হাঁসেরাও আবার ভুস। ঝপ আর ভুস। ঝপ আর ভুস...চলতেই থাকে...চলতেই থাকে। কিন্তু শিকার তো ধরা পড়ে না!

এভাবে সারাটা দুপুর যায়। বিকেলও যায়। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। পুকুরের পানিতে বড়ো বড়ো গাছের ছায়া পড়ে। আবছা হয়ে আসছে আশপাশ। তার মধ্যে পাতিহাঁস দুটোকে দিব্যি দেখা যায়। উত্তর পাশে কূলের কাছাকাছি সাঁতরাচ্ছে। যেন দুটো ফকফকে সাদা শাপলা ফুল। থির থির ঢেউয়ের দোলায় আস্তে আস্তে দুলছে যেন। দুজনে কথাও বলছে টুকিটাকি। কিন্তু তা শুনতে পায় না বাঘমামা আর বাঘমামি। তারা বড়ো কাহিল হয়ে পড়েছে। খিদেয় প্রাণ যায় যায়।

তখন কী আর করা! দু’জনে হাউ হাউ করে কান্না জুড়ে দেয়। একটু কাঁদলে মনটা হালকা হবে, ভাবে তারা। পাতিহাঁসেরা ওদের হড়বড়ে গলার কান্না শোনে কিছুক্ষণ। তারপর প্যাঁক প্যাঁক করে বলে, কেমন মজা হলো! মনে করেছিলে, আমরা ছোটো আর তোমরা বড়ো। বনের রাজা-রানি। আমাদের তোমরা এক থাবাতেই ধরে ফেলবে। তারপর খাবে, তাই না? মনে রেখো, আর কোনোদিন এমুখো হলে খবর আছে কিন্তু! তখন এমন প্যাঁচ খেলব যে, জান নিয়ে আর বাড়ি ফিরতে পারবে না। মনে থাকে যেন বড়ো মামা আর বড়ো মামি!

মুহূর্তে কান্না থেমে যায় বাঘমামা আর বাঘমামির। ভাবে, হাঁসেরা যা সাংঘাতিক! আবার কী প্যাঁচ কষে, কে জানে! তাই তারা তাড়াতাড়ি পুকুর থেকে ওপরে ওঠে। তারপর দ্রুত মিশে যায় বনের মধ্যে। আর কোনোদিন তাদের এ-তল্লাটে দেখা যায়নি।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!