জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় শিক্ষার্থীদের ভাবনা

স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে কনফারেন্স অব পার্টিজের (কপ) ২৬তম সম্মেলন শেষ হওয়ার নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও জলবায়ু পরিবর্তনের বিপজ্জনক প্রভাব এড়াতে দেশগুলোর মধ্যে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর আলোচনা, দরকষাকষি এখনও চলছে।

যোবায়ের ইবনে আলীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Nov 2021, 08:10 AM
Updated : 13 Nov 2021, 08:10 AM

জাতিসংঘের এ জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বার্ষিক সম্মেলন শুক্রবার শেষ হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু কোনো ঘোষণা বা চুক্তি চূড়ান্ত না হওয়ায় আয়োজনের কাল একদিন বাড়ানো হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে হুমকির মুখে মানবজাতিসহ পুরো জীববৈচিত্র্য। এ নিয়ে কী ভাবছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা!  

বাংলাদেশের পরিকল্পনার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন হোক

ইউনিসেফের মতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশই প্রাকৃতিক দুর্যোগের ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্তের শিকার এমন এলাকায় বসবাস করেন। নদী বিধৌত এ অঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। পৃথিবীর উষ্ণায়নের ফলে হিমালয়ের হিমবাহ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, পানির লবনাক্ততা বৃদ্ধি, মাটির উর্বরতা হ্রাস, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলশ্রুতিতে প্রতি বছর বহু মানুষের প্রাণহানি, জমি ও সম্পদ বিনষ্ট এবং বাস্তুচ্যুত হয়।

এদের বেশিরভাগই খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষ। বিশ্বব্যাংকের গ্রাউন্ডসওয়েল প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়েছে, ধীর জলবায়ু পরিবর্তন প্রক্রিয়া যেমন পানির স্বল্পতা, ফসল উৎপাদন হ্রাস এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ১৯ মিলিয়ন মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হবে।

বাংলাদেশ ২০২১ সালের জানুয়ারিতে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ব্যবস্থাপনা বিষয়ে জাতীয় কৌশল প্রণয়ন করেছে। উপকূলীয় জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় গত বৃহস্পতিবার কপ-২৬ এর সাইডলাইন বৈঠকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজেট ঘোষণা দিয়েছেন। পরিকল্পনার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন হোক এ আশাবাদ রাখি।

তাইয়েবা ইসলাম মীম, শিক্ষার্থী, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর

সবার সদিচ্ছা, সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ একান্ত জরুরি

বিশ্বব্যাংকের হিসেবে বাংলাদেশে এখন প্রতিবছর চার লাখ মানুষ শহরে চলে আসছেন স্থায়ীভাবে৷ এ সংখ্যা প্রতিদিন দুই হাজারের মতো৷ তাদের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগ জলবায়ু উদ্বাস্তু৷ ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার এক কোটি ৩৩ লাখ মানুষ তাদের আবাস্থল হারাবেন৷ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সম্প্রতি এক ভার্চুয়াল সেমিনারে বলেছেন, এরই মধ্যে বাংলাদেশের এককোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তে পরিণত হয়েছেন৷

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে পানীয় জলের অভাব দেখা দিয়েছে উত্তরাঞ্চল এবং উপকূলীয় এলাকাগুলোতে৷  পুকুরে ঢুকে গেছে লবণ পানি। ফসলের ক্ষেতে লবণ পানি ঢুকে ক্ষেত বন্ধ্যা করে ফেলেছে৷

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ২১.৮৫ শতাংশ কমানোর পরিকল্পনা করছে৷ বাস্তু সমস্যা সমাধানেও উদ্যোগ নিচ্ছে, দশটি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি জনসচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিগুলো সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে সভা, সেমিনার, আলোচনা হওয়া উচিত। 

যোবায়ের আহমদ, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আঁকা: শিশু আগাথা তালাপাত্রা

এবার হয়তো শেষ সুযোগ

আপনি যখন লেখাটি পড়ছেন তখন এশিয়ার দেশ চীন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করে যাচ্ছে যা মোট পরিমাণের প্রায় ২৭ শতাংশ। গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে অন্যতম মূল কারণ হলো শিল্পের অবাধ ব্যবহার। ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ১৯৭টি দেশ বিশ্ব উষ্ণায়ন ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু দেশগুলো এখনও সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে এখনো ব্যর্থ, যার ফলাফল ভোগ করছে পুরো পৃথিবী। বৈশ্বিক তাপমাত্রা এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামিয়ে আনতে হলে (গ্লাসগো সম্মেলন) কপ-২৬ হচ্ছে শেষ সুযোগ।

জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশে অনেক হুমকির মধ্যে রয়েছে, ইতোমধ্যে বাংলাদেশের মানুষ উপলব্ধি করতে পারছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদী ভাঙ্গন, আকস্মিক বন্যা, উত্তরবঙ্গে খরা বৃদ্ধি, দক্ষিণবঙ্গের পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া এর মধ্যে অন্যতম। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালে প্রতি ৫ জনের একজন বাস্তুচ্যুত হবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে।

আমারা ব্যক্তিগতভাবে কেবল মানবসৃষ্ট কারণগুলো দূর করতে পারি। যেমন- প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো, পলিথিনের বিকল্প ব্যবহার করা, পরিবেশ দূষণ না করা, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ইত্যাদি। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায়, “এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি। নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”

সাদমান সাদিক শোভন, শিক্ষার্থী, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

জলবায়ুর পরিবর্তনগত ঝুঁকি নিয়ে সচেতনতা জরুরি

বর্তমানে জলবায়ুর পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী একটি বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিনদিন ভয়াবহ দিকে যাচ্ছে এটি। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসকরণের যোগসূত্র এখনও পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে উন্নয়ন খাতে একটি ভালো পরিমাণ অর্থ বার্ষিক বরাদ্দ দেয়। এ বিপুল ‍বিনিয়োগের সঙ্গে আরও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, আর্থিক পরিকল্পনা, তদারকি, রিপোর্টিং ও কার্যকর নীতি থাকতে হবে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে একাজে নিজের স্থান থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। এর মাধ্যেমে জলবায়ুগত পরিবর্তন সমস্যা মোকাবেলার দিকে এগিয়ে নেওয়া যাবে।

জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসকরণ নিয়ে জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি এবং তাদের কাছে বিভিন্ন বার্তা পৌঁছে দিতে স্থানীয় ও ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গ, ওয়ার্ড পর্যায়ের কমিটির ব্যাপক ভূমিকা পালনে সচেষ্ট হতে হবে। বিস্তৃতভাবে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে  বনায়ন করতে হবে। জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ মোকাবেলায় আগে থেকেই নিতে হবে নানা উদ্যোগ ও বিস্তৃত পরিকল্পনা। দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলার জন্যও নিতে হবে নানা টেকসই প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা।

বর্তমানে দেখা যায় প্রতি ঋতুর বৈচিত্র্যের ব্যাপক মাত্রায় পরিবর্তন। যখন যে বৈচিত্র্য দেখা যাওয়ার কথা তখন সেটি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এসবের মূল কারণ জলবায়ুর পরিবর্তন। এটি মোটেও ভালো সংকেত নয়৷ তাই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার  বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সবার যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া সময়ের দাবি।

সাঈদ চৌধুরী, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়