ভেড়ার বাচ্চাটা কোথায় গিয়েছিলো

ছোট্ট বাচ্চাটার নাম পিংকি। নামটা আমারই দেওয়া। বরফের মতো শাদা একগাদা পুরু লোম যে-ভেড়িটার, পিংকি তারই মেয়ে।

মুস্তাফা মাসুদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Oct 2021, 08:00 AM
Updated : 25 Oct 2021, 08:00 AM

পিংকির সঙ্গে আরও দুটো বাচ্চা হয়েছিলো, তারা ছেলে। তাই তারা ভেড়া আর পিংকি মেয়ে বলে ও ভেড়ি। ভাই দুটোর নামও আমি দিয়েছি- রন্টু ও ছন্টু । ওদের সবার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব। তবে পিংকির সঙ্গে একটু বেশি। এর কারণ পিংকির দুরন্তপনা আর মিশুক স্বভাব।

পিংকির বয়স মাত্র বিশ কি পঁচিশ দিন। এখনই তার সেকি লাফঝাপ-নাচানাচি-কুঁদোকুঁদি! শিং নেই, তবু সমবয়সিদের দিকে এমনভাবে তেড়ে যাবে যেন এখনই গুঁতিয়ে তাদের পেট ফুটো করে দেবে! তারপরই আনন্দে ‘ভ্যাহ্’ করে বারকয়েক ডিগবাজি খাবে। তখন মা ঘাড় উঁচিয়ে দেখে কী হয়েছে। পিংকি তখন একেবারে শান্তভাবে ঘাস খাবে, নয় তো মুখ নিচু করে ঘাস খাওয়ার ভান করবে।

পিংকির সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব। কেমন করে যেন ওর ভাষাও আমি বুঝতে পারি, সেও আমার কথা বুঝতে পারে। ওর ভাষাতো একটাই- ভ্যাহ্- হ্-হ্.....। বড়োগুলোর ডাক অনেকটা ভ্যাড়ভেড়ে হলেও ছোটো বাবুগুলোর ডাক একটু চিকন সুরের এবং শুনতেও বেশ ভালো লাগে। এই ডাকই হলো ওদের ছোটো-বড়ো সবার ভাষা। আমি অন্য কারো ডাকের বা ভাষার মানে বুঝতে পারি না, শুধু পিংকির ভাষা বুঝতে পারি। সেও আমারটা বুঝতে পারে। এজন্যই বোধহয় আমাদের মধ্যে এত বন্ধুত্ব। এত বোঝাপড়া।

এখন হেমন্তকাল, কার্তিক মাস শেষ হতে চলেছে। এসময় বাবা আমাদের ভেড়াগুলোকে মাঠের খালপাড়ে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যান। এর আগে মহামারীতে দেড় বছর ইশকুল বন্ধ থাকায় ওদেরকে আমিই নিয়ে যেতাম। ভারি আনন্দে কেটেছে সারাদিন। বিল জলেশ্বরের ফুরফুরে হাওয়ায় মনপ্রাণ জুড়িয়ে যেতো। বিলের অনেক দূর পর্যন্ত গভীর খাল কাটার কারণে খালের পাড় হয়েছে উঁচু আর চওড়া। নতুন তোলামাটিতে তাজা ঘাসও হয়েছে দেখার মতো।

প্রায় তিন কিলোমিটার খালপাড়ে লকলকে তরতাজা সবুজ ঘাসের বন। ভেড়ারা রোজ সেই ঘাস পেটপুরে খায়। খুনসুটি-ছুটোছুটিও খেলে। আনন্দ করে। ভেড়া-ভাষায় গানও গায়। খালপাড়ে গরু-ছাগলরাও ঘাস খায়। আনন্দফূর্তি করে।

আজ শুক্রবার। ইশকুল ছুটি থাকায় ভেড়ার পাল নিয়ে আমি গেলাম মাঠে। হেমন্তের শীতমাখা মিষ্টি রোদ গাছগাছালির পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঝিকমিক করছে। কুয়াশাও পড়েছে বেশ। আমি দুপুরের খাবার একটা বক্সে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোই। আমার সামনে সামনে চলে পঁচিশটি ছোটোবড়ো ভেড়া-ভেড়ি। পাঁচ-ছয়টি বাচ্চা। তাদের মধ্যে পিংকিই বেশি ছটফটে আর দুরন্ত। ভেড়ি-মা এজন্য তাকে শাসনও করেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! সে একদৌড়ে আমার কাছে চলে আসে, বলে- ভাইয়া, মা খেপেছে। তাকে সামলাও। আমি হাসিমুখে ওর মায়ের দিকে একবার তাকাতেই সে থেমে যায়।

বিএডিসি’র তৃতীয় ডিপ-টিউবওয়েল পার হয়ে আমরা থামি। এখানে খালের পাড় একটু বেশি চওড়া। ঘন সবুজ ঘাসও বেশি। ভেড়া-ভেড়িগুলোকে আর কিছু বলতে হয় না বা ইশারাও করতে হয় না। ওরা মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘাসের বনে। লেগে যায় ঘাস খেতে। পিংকিও সবার সঙ্গে ঘাসে মুখ দেয়, তবে খাওয়া শুরু করার আগে সে একবার আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলো- বড্ড খিদে পেয়েছে, ভাইয়া।

খালের পানির একেবারে কাছছোঁয়া একটি বড়ো মেহগনি গাছ। আমি তার তলায় বসি। আজ সঙ্গে বাঁশি এনেছি। মহামারীর মধ্যে গ্রামে সিধু বয়াতির কাছ থেকে বাঁশের বাঁশি বাজানো শিখেছি। সেই বাঁশি ঠোঁটে লাগিয়ে সুর তুলি। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ দেখি পিংকি আমার পাশে দাঁড়ানো। চুপ করে মন দিয়ে শুনছে বাঁশির সুর। আমি বাজনা থামাই। অবাক হয়ে দেখি- পিংকির দুচোখের কোনা বেয়ে টলটলে পানির ধারা গড়িয়ে পড়ছে। আমি ব্যস্তভাবে ওকে বলি: একি! তুমি কাঁদছো কেন, বুনডি?

না না, ভাইয়া, এ হলো খুশির কান্না। কেমন সুন্দর বাজাও তুমি! আমার বুকটা ভরে গেছে, বলেই সে নাচতে নাচতে আবার চলে যায় ঘাস খেতে। আমারও ভারি ভালো লাগে আমার বাঁশির সুর পিংকির ভালো লেগেছে শুনে।

এখন ছোটো, দুপুরবেলা সাড়ে এগারোটা বাজে। ভেড়াদের পানি পানের সময়। বাড়ি থেকে আনা বালতি দিয়ে আমি খালের পানি তুলি বড়ো প্লাস্টিকের গামলায়। রোজ ওদের তিন গামলা পানি লাগে। সবাই একে একে পানি খেয়ে যাচ্ছে। পানি শেষ হলে আবারও পানি তুলছি। কিন্তু পিংকি কই? শেষবারেও সে পানি খেতে এলো না দেখে আমার চিন্তা বাড়ে। তাকিয়ে দেখি ওর মা-ও যেন কেমন অস্থিরভাবে ছটফট করছে আর এদিকওদিক ছুটোছুটি করছে, সঙ্গে তার দুই ছেলে রন্টু আর ছন্টুও যেন মায়ের সঙ্গে এদিক ওদিক খুঁজছে আর চিকন গলায় ভ্যাহ্..হ্ করে ডাকছে। আমি বুঝতে পারি, ওরা পিংকিকেই খুঁজছে। কিন্তু পালের অন্য ভেড়া-ভেড়িরা স্বাভাবিকভাবেই ঘাস খাচ্ছে। কেউ কিছু বুঝতে পেরেছে বলে মনে হচ্ছে না।

আমি সঙ্গে সঙ্গে পিংকি..ই..ই বলে চিৎকার করে ওঠি। সঙ্গে সঙ্গে অন্যদের ঘাস খাওয়া থেমে যায়। সবাই যেন বুঝতে পারে, কোনো-একটা বিপদ ঘটেছে। তারা আমার দিকে তাকায়। আমি আবার জোরে ডাক দিই- পিংকি সোনা! কোথায় তুমি? কোথায়....

কিন্তু কোথায় পিংকি! তার কোনো সাড়াশব্দও নেই, দেখাও নেই! এবার আমি ইশারায় ভেড়াদেরকে যার যার জায়গায় থাকতে বলে আশপাশে খুঁজতে থাকি।

একটু পরে দেখি, পিংকির মা এবং দুভাইও আমার পিছে পিছে আসছে। আমি ওদেরকে কিছু বলি না। প্রথমে পাশের ধানখেতে ঢুকলাম। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পিংকিকে পাওয়া গেলো না। ভাবি অতটুকু বাচ্চা, হঠাৎ কোথায় গেলো! এদিকে কোনো কুকুর বা পাতিশিয়ালও তো নেই যে তাকে খেয়ে ফেলবে!

আমি এবার খালপাড়ের কিনারা-বরাবর পুব দিকে হাঁটতে থাকি, সঙ্গে পিংকির মা ও দুভাই। হাঁটতে চলে আসি পাশের বাবলা-বনের কাছে। এদিকে একটা ছোটো ঝোপ, তার পরেই বাবলা-বনের শুরু। প্রায় শ’খানেক বাবলা গাছ। বনের দক্ষিণ পাশটায় কেমন যেন উৎসব-উৎসব ভাব। অনেকগুলো কাঠবেড়ালি তুমুল শব্দে চিৎকার করছে- চিড়িকপিড়িক... চিড়িকপিড়িক। তবে সে চিৎকার ভয়ের নয়, আনন্দ আর খুশির বলে মনে হলো আমার কাছে। তারা কেউ লাফিয়ে এক ডাল থেকে আরেক ডালে যাচ্ছে। কেউ কেউ গাছের গোড়া বেয়ে নিচে নামছে, আবার ওপরে উঠছে। সবার মুখে একটানা চিড়িকপিড়িক... চিড়িকপিড়িক... শব্দ।

আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে ঘটনা কী, বোঝার চেষ্টা করি। পিংকির মা আর দুভাইও আমার পেছনে দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ পরে একটা গাছের নিচের দিকে তাকিয়ে আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। আ রে! আমাদের পিংকি না! হ্যাঁ, তাই তো! ওর মা আর ভাইয়েরা এখনো কিছু দেখতে পায়নি। তাই দুশ্চিন্তা ও ভয়ে গলার মধ্যে কেমন-একটা শব্দ করছে। এই প্রথম আমি পিংকির মায়ের ভাষা বুঝতে পারি, সে কাতরভাবে আস্তে আস্তে কাঁদছে- মা পিংকি রে, কোথায় হারায়ে গেলি রে...!

আমি একটু পিছিয়ে পিংকির মাকে নিচুস্বরে বলি, ভয় নেই মাসি। শান্ত হও... বলেই ইশারা করি- ওইযে ওখানে। তারপর ইশারায় ওদেরকে চুপ থাকতে বলি। ওরা চুপ হয়। ওদের গলা থেকে সেই বিশেষ শব্দও আর শোনা যাচ্ছে না। আমি ঝোপের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে আরও খানিকটা এগিয়ে যাই। এখান থেকে সব স্পষ্ট দেখা যায়। পিংকির মা আর ভাইদের আগের জায়গায় থাকতে ইশারা করলাম।

এবার যা দেখলাম তাতে আমার চোখ ছানাবড়া কেন, ইয়াবড়ো সাইজের রসগোল্লাই হয়ে গেল যেন! দেখি কী- কাঠড়োলিরা সবাই তখন গাছ থেকে নেমে এসেছে। একজন চড়েছে পিংকির পিঠের ওপর। সেখানে দুপায়ে ভর দিয়ে চিড়িকপিড়িক শব্দে চারদিক ভাসিয়ে দিচ্ছে। তার দুহাত তালি দেওয়ার মতো ওঠনামা করছে। বাকি প্রায় বিশ-পঁচিশটা কাঠবেড়ালি গোল হয়ে পিংকিকে ঘিরে নাচছে। সেকি তুমুল নাচ! সেইসঙ্গে সবার কণ্ঠে দ্রুতলয়ের চিড়িকপিড়িক গান! সেই নাচ আর গান যেন আমাকেও পাগল করে দেয়। আমি আর নিজেকে সামলাতে পারি না। জোরে বলে উঠি, ব্রাভো! এক্সিলেন্ট! চমৎকার!

মুহূর্তেই সব সুনসান। কাঠবেড়ালিগুলো নাচগান বন্ধ করে দ্রুত গাছে উঠে যায়। ওদেরকে আর কোথাও দেখা গেলো না। আমার গলার আওয়াজ শুনে পিংকি আমার দিকে তাকায়। ওর মুখটা বেজার। হয়তো আমার জন্যই ওদের আনন্দটা মাটি হয়ে গেলো বলে রাগ বা অভিমান হয়েছে ওর। ততক্ষণে ওর মা আর দুভাইও এসে পড়েছে আমার কাছে। ওদেরকে দেখেই পিংকির চোখমুখ আবার খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

সে খুশি যেন বাঁধ মানছে না। দৌড়ে এসেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ে মায়ের কোলের কাছে। বারবার মায়ের মুখে, মাথায় মুখ ঘষে আর কী যেন বলে মাকে। আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম, সে বলছে, ভারি আমোদের খেলা, মা। তুমি রাগ কোরো না, সোনা মা!

পিংকির কথায় যেন আহ্লাদের মধু ঝরে। মুহূর্তে মায়ের সব রাগ পানি। মা তখন আদুরে গলায় একটু শাসনের সুরে মেয়েকে বলে, ভারি দুষ্টু হয়েছিস, না? মাকে না বলে কেউ কোথাও যায়? আর কখনো এমনটি করবি না, ঠিক আছে? বলেই আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় পিংকিকে। ভাই দুটোও তখন মায়ের আদরে ভাগ বসানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!