রোহিঙ্গা শিশু আয়াত উল্লার দিনরাত্রি

ঘড়ির কাঁটায় তখন চারটা ছুঁই ছুঁই। সকাল হয়ে পূর্ব আকাশে জেগে উঠা রক্তিম সূর্যটি বিকেলের পশ্চিমে হলুদ আভা ছড়িয়ে ধীরে ধীরে প্রস্তুতি নিচ্ছে অস্ত যাওয়ার।

হিমু চন্দ্র শীল, কক্সবাজার থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Oct 2021, 08:12 AM
Updated : 20 Oct 2021, 09:24 AM

পাশেই পড়ন্ত বিকেলের সেই সূর্যের হলুদ আভা এসে অদ্ভুত এক সৌন্দর্যের দাপট দেখিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের পাদদেশে। পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের সেই হলুদ আভাকে গায়ে মেখে ঘুড়ি উড়াতে ব্যস্ত কয়েকজন শিশু।

জাতিসংঘের একটি সংস্থার হয়ে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করার সুবাদে আমার প্রতিনিয়ত সুযোগ হয় কক্সবাজারের উখিয়ায় থাকা বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবিরগুলো ঘুরে দেখার। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে খুব কাছ থেকে কাজ করার সুযোগও হয়। সেদিনও গিয়েছিলাম টেকনাফের উনচিপ্রাং নামক জায়গায় গড়ে উঠা বাইশ নাম্বার ক্যাম্পে।

পাহাড় আর উপত্যকায় তৈরি হওয়া এ ক্যাম্পের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঘরগুলো দেখতে বেশ সুন্দর। পাহাড়ের উপরে ভেসে বেড়ানো সাদা পেঁজা তুলোর মেঘ যেন স্বর্গীয় রাজপ্রাসাদ তৈরি করে রেখেছে। মেঘের আড়ালে ঘুড়ির লুকোচুরি দেখে মনে পড়ে গেল শৈশবের ফেলে আসা স্মৃতি।রোমন্থন করতে করতে এগিয়ে গেলাম তাদের দিকে।

নাফ নদীর ওপার থেকে নির্যাতিত হয়ে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীরা আশ্রয় নিয়েছে এপারে। আশ্রিত রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে আবার অর্ধেকেরও বেশি শিশু। এ শিশুরাই বড়দের সঙ্গে বহু কষ্টে পাড়ি দিয়েছে দুর্গম পথ। আসার পথে কেউ হারিয়েছে মা, আবার কেউ হারিয়েছে বাবা কিংবা পরিবারের প্রিয় মুখটিকে।আবার কেউ হয়েছে চিরতরে জন্য পঙ্গু।

বিভিন্ন সংস্থা কিংবা নিউজের হেডলাইনে বড়দের আনাগোনা থাকলেও রোহিঙ্গা শিশুদের অনুভূতিগুলো বরাবরই থেকে যায় পর্দার আড়ালে। তাই চেষ্টা করলাম তাদের সেই অনুভূতি জানার।

দুরন্ত রোহিঙ্গা শিশুদের মধ্যে একজনকে দেখে কেমন জানি মনে হলো! ঘুড়ি আর নাটাইয়ের দিকে মনযোগী ছাত্রের মতো তার দৃষ্টি। কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম তার পরিচয়। আয়াত উল্লা, বয়স ৯ কি ১০ হবে। এই ক্যাম্পের ব্লক ডি ৩-এ তার বাড়ি। বাড়ি বললে অবশ্য ভুল হবে। কারণ ক্যাম্পে তারা যে ঘরগুলোতে বসবাস করে আসছে ওগুলো আসলে বাড়ি হবে না। ত্রিপল আর বাঁশ দিশে তৈরি ছোট ছোট ঝুপড়ি। ব্লক ডি ৩-এর এমনই এক ঝুপড়িতে আয়াত উল্লা মামার সঙ্গে থাকে।

কথায় কথায় জানতে পারলাম এ পৃথিবীতে তার আপনজন বলতে একমাত্র মামাই আছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুর নুরুল্লা পাড়াতে তার বাড়ি। ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময় বাবাকে হারায় সে। তখন মায়ের সঙ্গে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে কোনোভাবে টেকনাফের এ ক্যাম্পে এসে আশ্রয় নেয়।

‘চাইল্ড ফ্রেন্ডলি স্পেস’-এর রোহিঙ্গা শিশুরা

শুরুতে খুব কষ্টের মধ্যে থাকলেও কিছুদিন পর বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতায় ধীরে ধীরে সবকিছু গুছিয়ে নিতে শুরু করে তার পরিবার। কিন্তু বছরখানেকের মধ্যে মায়ের মৃত্যু ছোট্ট আয়াত উল্লার মন ভীষণভাবে নাড়িয়ে দেয়। মাকে হারিয়ে অসহায় আয়াত উল্লা আশ্রয় নেয় একই ক্যাম্পে থাকা মামার কাছে। মামা তাকে ইউনিসেফের সহযোগিতায় পরিচালিত একটি চাইল্ড ফ্রেন্ডলি স্পেসে ভর্তি করিয়ে দেয়।

চাইল্ড ফ্রেন্ডলি স্পেসে শিশুদের পড়াশোনা থেকে শুরু করে খেলাধুলা সবকিছু করা হয়। তাছাড়া চাইল্ড ফ্রেন্ডলি স্পেসে খেলাধুলার বিভিন্ন সরঞ্জামও থাকে। আয়াত উল্লার ওসব ভালোই লাগে। মহামারীর সময় চাইল্ড ফ্রেন্ডলি স্পেস বন্ধ থাকার কারণে সময়টা একঘেয়ে কেটেছে তার। কিন্তু এখন খুব ভালো সময় কাটে। সমবয়সী কয়েকজন বন্ধুর সাথে দলবেঁধে রোজ নিয়ম করে চাইল্ড ফ্রেন্ডলি স্পেসে যাওয়া। খেলাধুলা করা, পড়াশোনা করা। সবকিছু যেন মা-বাবা না থাকার বেদনাটাকে ভুলিয়ে রাখে বারবার।

ঘুড়ি উড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে আয়াত উল্লাকে জিজ্ঞেস করি মিয়ানমারে কীভাবে সময় কাটত। কথাটি শুনে সে ফিকে হাসি দিয়ে বলল, “মিয়ানমারে যখন ছিলাম তখন আমার বয়স আরও কম ছিল। তাই ওসব তেমন কিছু মনে নেই।তবে আমরা পাড়ার ছোটরা সবাই দলবেঁধে মক্তবে যেতাম। একসঙ্গে খেলতাম, একসঙ্গে খালে লাফালাফি করতাম। খুবই মজা করতাম।”

কথাগুলো বলেই কেমন জানি বিমর্ষ হয়ে গেল ছোট্ট আয়াত। হয়তো এখনও তার স্মৃতির মানসপটে ঝাপসা হয়ে ভেসে বেড়ায় ফেলে আসা অতীত। মুহূর্তে আরও কয়েকজন এসে যোগ দিল সেই দলে। যে কয়জনের সঙ্গে কথা বললাম, তাদের কথাগুলো শুনে মোটামুটি এইটুকু বুঝতে পারলাম বিভিন্ন পরিবার থেকে আসা এ শিশুদের পেছনের গল্পটি এক। যে গল্পে ফুলেরা ফুটতো, প্রজাপতিরা উড়তো, পাখিরা ডাকতো আর আয়াতরা সবাই সেই গল্পের মুখ্য চরিত্রে ঘুরে বেড়াতো।

কিন্তু আজ সেসব শুধুই স্মৃতি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আর মিয়ানমার সরকারের উদাসীনতার বেড়াজাল, সবকিছুর ঘূর্ণিপাকে পড়ে আজ আয়াতরা নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে ঝুপড়িতে। পূর্ব দিগন্তের সূর্য পশ্চিমে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। বাতাসও তার নিজের গতিপথ বদলে নিয়েছে। চারদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু ক্যাম্পের ছোটছোট ঝুপড়ি ঘর আর ঝুপড়ি ঘর।

আয়াতরা ঘুড়ি আর নাটাই গুটিয়ে নিয়ে ফিরে যাচ্ছে যে যার ঘরে। হয়তো ঠিক এভাবে কোনো একদিন সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে তারা আবারও ফিরে যাবে নিজের জন্মভূমি সোনালি প্যাগোডার দেশ মিয়ানমারে।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!