গ্রামে গুলি দিয়ে দুভাবে খেলা যেতো, টাকা ছাড়া এবং টাকাসহ। টাকাসহ খেলাটাকে বলা হয় জুয়া। তবে আমরা ছোটরা মার্বেলের বিনিময়ে মার্বেলই নিতাম। মার্বেলগুলোর আকারের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন নাম দিতাম আমরা। যেমন সবচেয়ে বড়টির নাম হচ্ছে ডাগা বা ডাগ আর সবচেয়ে ছোটটির নাম হচ্ছে চুই। আমরা আমাদের হাই স্কুলের হেডস্যারকে চুই বলে ডাকতাম এ কারণে।
সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলাটা হয় দুটো দাগ দিয়ে। একটা দাগের পেছনে দাঁড়িয়ে অন্য দাগটার সামনের একটা নির্দিষ্ট গর্তের যত কাছাকাছি পারা যায় একটা মার্বেল ফেলা হয়। গর্তটার নাম আজ আর মনে নেই। তারপর যার মার্বেল গর্তের সবচেয়ে কাছে তার চাল আসে সবার আগে। সব খেলোয়াড় সমান পরিমাণ মার্বেল দিয়ে দান চালে। আবার সেই আগের দাগের পেছনে দাঁড়িয়ে অন্য দাগের সামনে মার্বেলগুলাকে চেলে দেওয়া হয়। যে মার্বেলগুলো অন্য দাগটা পার হতে পারে না সেগুলোকে বলা হয় বাদ বা পচা।
দাগ পার হওয়া মার্বেলগুলা থেকে একটাকে আবার বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। সেটা হয় এমন একটা মার্বেল যেটাকে খেলোয়াড় অন্য একটা মার্বেল দিয়ে সহজেই ছুঁয়ে দিতে পারবে এবং ভুলক্রমে সেটাকে যদি ছুঁয়ে দেয় তাহলে সেই খেলোয়াড়কে ডোন বা দণ্ড দিতে হবে আরও একটা মার্বেল। কিন্তু যদি সে অন্য মার্বেলগুলার কোন একটাকে যদি ছুঁয়ে দেয় তাহলে বলা হবে সে দান মেরে নিয়েছেন। কিন্তু যদি ভুলক্রমে দুটোকে ছুঁয়ে দেন তাহলেও ডোন হবে এবং দণ্ড দিতে হবে। এভাবে একজন একজন করে খেলোয়াড় দান মারার চেষ্টা করে যান।
একজন খেলোয়াড় তার হাতের মার্বেলগুলো দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে ঝাকি দিয়ে একটা হাত ক্রস চিহ্নটার মাঝে নিয়ে এসে রাখেন। তখন অন্য তিনজন খেলোয়াড় তিনটা ঘরে তাদের ইচ্ছেমতো মার্বেল রাখেন আর একটা ঘর ফাঁকা রেখে সেটাতে খেতে বলেন। প্রথম খেলোয়াড় তার হাতের মুঠো খুলে দিয়ে মার্বেলগুলো হিসাব করতে শুরু করেন চারটা চারটা করে। যদি ফাঁকা ঘরের সমান সংখ্যক মার্বেল অবশিষ্ট থাকে তাহলে তিনি জিতে যাবেন তা নাহলে অন্য যে ঘরের সঙ্গে মিলে যাবে সেখানে রাখা মার্বেলের সমপরিমাণ মার্বেল সেই খেলোয়াড়কে দিয়ে দিতে হবে।
এ খেলাটাই বড়রা খেলে টাকা দিয়ে। এমন অনেক গল্প শুনেছি যে টাকা হারতে হারতে একসময় বসতভিটা এমনকি বউ পর্যন্ত ধরে বসতেন! অবশ্য আমাদের সেই সুযোগ ছিলো না, কারণ ছোটদের নামে বসতভিটা বা বউ কোনটাই ছিলো না।
মার্বেল অন্য সময়ে খেলা হলেও ঈদের সময় না খেলা হলে ঈদের আনন্দ পূর্ণতা পেতো না। ঈদের সময় গ্রামের মুদি দোকানগুলো ঈদকে সামনে রেখে নতুন নতুন মার্বেল নিয়ে এসে রাখতো। আমরা সালামির টাকা দিয়ে সেইসব নতুন মার্বেল কিনে খেলতে বসে যেতাম। এরপর আর আমাদেরকে উঠানো মুশকিল হয়ে যেতো। ঈদের দিন সামান্য যে দুয়েকজন অতিথির বাসায় যাওয়া লাগতো আমরা সেখানে যেতেও চাইতাম না খেলা ফেলে, তাই বাধ্য হয়েই আমাদের বাবা-মা লাঠি নিয়ে তাড়া দিতেন।
খেলতে গিয়ে অবধারিতভাবে আমাদের মধ্যে একসময় মারামারি লেগে যেতো। তখন ঘুষাঘুষি, কিলাকিলি এবং মালাম ধরার মতো ঘটনাও ঘটতো অনেকসময়। মালাম ধরাটা অনেকটা চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বলিখেলার মতো, কে কাকে নিচে ফেলে দিতে পারে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে একটু পরই আবার আমরা গলাগলি ধরে বিভিন্ন লোকের গাছের ফল চুরি করতে বেরিয়ে পড়তাম। আমরা নিজেরা মারামারি করবো কোন সমস্যা নেই, কিন্তু বাইরের কেউ এসে বাগড়া দিলে আমরা দুজন মিলে তখন তাকে পিট্টি দিতাম।
তাহিয়াই খুঁজে বের করলো। আমাকে নিয়ে এসে দেখলো ক্যাটকেটে হলুদ রঙের মার্বেল। আমি বললাম অন্য কোন রঙের নেই? তখন তাহিয়া বললো, খুঁজে পাচ্ছি না বাবা। আমি বললাম স্টাফদের সাহায্য নাও। আমাদের পাশেই একজন স্টাফ কাজ করছিলেন। তাহিয়া উনার কাছে গিয়ে সাহায্য চাইলে উনি এসে একটা বাক্স খুঁজে দিলেন যেখানে হরেক রকমের মার্বেল সাজানো রয়েছে। আমি তার মধ্যে থেকে খুঁজে খুঁজে আমাদের শৈশবে খেলা মার্বেলের কাছাকাছি রঙের একটা বস্তা বেছে নিলাম। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে আমাদের ছোটবেলাতেও আমরা এমন একটা বস্তার মধ্যে মার্বেলগুলো সংরক্ষণ করতাম।
মার্বেল কেনার আগে আমরা আমাদের আবিষ্কার করা নদীর (ক্রিকের) ধারে গিয়েছিলাম। সেই নদীটার দুই পাশে উঁচু মাঠ। আমরা ছোটবেলায় নদীর ধারে গরু চড়ানোর সময় গাছতলায় মার্বেল খেলতাম। এ নদীর ধারের মাঠেও তেমন কয়েকটা ঝাউগাছ আছে। আর তার পাশে একটু জায়গা কারা যেন ঘাস উঠিয়ে পরিষ্কার করে রেখেছে। আমার পরিকল্পনা হলো ওইখানটায় মার্বেল খেলার জায়গা বানানো। তারপর কেমার্ট থেকে তাহিয়ার জন্য আরও এক বস্তা মার্বেল কিনে নিয়ে ওখানে খেলতে চলে যাওয়া। আমি অপেক্ষায় আছি কবে আমরা সেটা সম্ভব করতে পারবো।
কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না! |