রাতের বাসের যাত্রী

চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিচ্ছুটি দেখা যাচ্ছে না। তার ওপর আবার মুষলধারে বৃষ্টি। রাস্তার ধারে ল্যাম্পপোস্টগুলো আলোহীন ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।

হিমু চন্দ্র শীলহিমু চন্দ্র শীল
Published : 21 August 2021, 04:04 PM
Updated : 21 August 2021, 04:04 PM

ছেঁড়া এলোমেলো বিদ্যুতের তারের ওপর ঝুলে আছে গাছের ভাঙা ডালপালা। ঝুমঝুম বৃষ্টিতে হেডলাইট জ্বেলে ঘুটঘুটে অন্ধকারকে ভেদ করে এগিয়ে চলছে আমাদের বাস। রাত হওয়াতে মোটামুটি সব যাত্রী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।

বাস চলছে তো চলছে। হঠাৎ পেছনের সিট থেকে একটা অস্ফুট গুঞ্জন ভেসে এলো। সেইসঙ্গে এক নারী কণ্ঠের কান্নামিশ্রিত গোঙানির শব্দ, গাড়ির যাত্রী অনেকের ঘুম ভেঙ্গে গেল। পেছনের সিটে বসা কেউ একজন গাড়ির ড্রাইভারকে বারবার তাগদা দিতে লাগলেন সামনে কোনো ক্লিনিক বা হাসপাতাল দেখলে বাস দাঁড় করাতে। ওই নারীর স্বামী পাশে বসে বিপদে থেকে বাঁচার মন্ত্রপাঠ করছেন- ওঁ শ্রী মধুসূদনায় নম:। স্ত্রীর মুখে জমা ঘাম আর কান্নার জল মুছে দিচ্ছেন হাতের তালু দিয়ে, তাই কপালের সিঁদুর লেপ্টে গেছে। 

রাতের বাস এগিয়ে চলছে সাঁ সাঁ করে। একসময় গাড়ির ভেতরে সবার মুখে মুখে কথাটি চাউর হয়ে যায়। কারও বুঝতে আর অসুবিধে হলো না বাসের পেছনের সিটে বসা একজন অন্তঃসত্ত্বা নারী প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছে। যাত্রীরা সবাই মহাচিন্তিত, এই অসম রাতে কী করা যায় তা নিয়ে। ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে ঘুরতে থাকে। সেকেন্ড মিনিটে রূপন্তরিত হয়, মিনিট ঘণ্টায়। বাড়তে থাকে ওই নারীর প্রসব বেদনার চিৎকার।

তাছাড়া আমাদের বাসে নারী বলতে উনি এবং মধ্যবয়সী আর একজন, মাত্র এই দুজনই আছেন। তাই কেউ সাহস করলো না ওনার প্রসব গাড়ির ভেতর করার সিদ্ধান্ত নিতে। যাত্রীদের মধ্য থেকে অনেকে ফোন করে, গুগল করে আশপাশে কোনো হাসপাতাল আছে কিনা দেখতে লাগল। কিন্তু দেখা গেল আশপাশে কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো হাসপাতাল নেই। ওদিকে উনার কান্নার তীব্রতা ক্রমশ বাড়ছে।

না এবার আর পারা গেল না। নারীটির স্বামী আর সবার অনুরোধে বাসের ড্রাইভার গাড়ি থামালেন। ঝড়ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে গাড়ি গিয়ে দাঁড়াল রাস্তার ধারে একটা বাড়ির পাশে। সিদ্ধান্ত হলো ওই নারীকে ধরাধরি করে ওই বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে। যা হবার তা সব ওই বাড়িতেই হবে। বাস গিয়ে থামল, সবাই দ্বিধান্বিত। এই অসম রাতে একটা বাড়িতে একজন অপরিচিত অন্তঃসত্ত্বা নারীকে কেনই বা তারা আশ্রয় দিতে যাবে!

রাত আরও গভীর হয়েছে। টিপ টিপ করে বৃষ্টি ঝরছে। কাঁপা কাঁপা বুকে যাত্রীদের মধ্য থেকে কেউ একজন ওই বাড়ির দরজায় গিয়ে টোকা দিলেন। কোনো সাড়া শব্দ নেই। এবার দুয়েকজন চিৎকার দিয়ে মানুষ জাগানোর চেষ্টা করলেন, এতে কাজ হলো। একজন লোক দরজা খুললেন, মাথায় টুপি আর গালভর্তি দাড়ি। পেছনে একজন নারী। দেখে মনে হলো দুজন বাড়ির কর্তা-গিন্নী। ঝড়-বৃষ্টির এ রাতে বাড়ির সামনে বিরাট একটা বাস, এতগুলো মানুষ দেখে তারা হতভম্ব হয়ে গেলেন। লোকটা আসসালামু আলাইকুম বলে মুখে সালাম জানালেন বটে, তবে তাদের চোখেমুখে স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ দেখতে পেলাম।

অন্তঃসত্ত্বা নারী বাসের ভেতর গোঙাচ্ছে। সঙ্গে থাকা তার স্বামী আর অন্য নারীটি সামাল দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। যাত্রীদের মধ্য থেকে বয়সে তরুণ এক ভদ্রলোক ওই বাড়ির কর্তাকে এক পাশে নিয়ে গিয়ে ব্যাপারটি বুঝিয়ে বললেন। সবাই দ্বিধান্বিত, তখনও বৃষ্টি থামার কোনো নামগন্ধ নেই। লোকটি সবাইকে অবাক করে দিয়ে অন্তঃসত্ত্বা নারীকে বাড়িতে তুলে নিলেন। ওই রাতে বাড়ির গিন্নী তার পরিচিত এক গাইনি ডাক্তারকে ফোন করে কিছু তথ্যও জেনে নিলেন।

যাত্রীরা কেউ হাত তুলে আল্লাহর কাছে মোনাজাত করছে, আবার কেউ হাত জোড় করে ঈশ্বরের কাছে করছে প্রার্থনা। আমাদের বাসও ঠায় দাঁড়িয়ে। অবশ্য ড্রাইভার আগে থেকে কোম্পানিকে ঘটনাটি জানিয়ে দিয়েছিল। যাত্রীরাও বলল এর শেষ দেখে তবেই যাবে। অবশেষে বিশ-ত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করার পর বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসল ওঁয়া ওঁয়া শব্দে ছোট্ট শিশুর কান্নার আওয়াজ। পৃথিবীতে নেমে আসল ফুটফুটে এক পরী।

জানা গেলো মা-মেয়ে সুস্থ আছে। বাসের যাত্রীরা খুশিতে সমস্বরে চিৎকার দিয়ে উঠল। কেউ হলো দাদু, আবার কেউ মামা। কেউ একজন নবাগতের নামও দিয়ে ফেলেছেন- ‘সম্প্রীতি’। দেখে মনে হলো তারা যেন দীর্ঘদিনের আত্মীয়।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!