তার দুই নাতনি নয়না ও দীপিতাকে নিয়ে বেশ কিছু ছড়া লিখেছেন তিনি। সমাজের বিভিন্ন অনিয়ম বা অসঙ্গতি নিয়েও ছড়া লিখেছেন। তার ছড়া-সাহিত্য খুব কম আলোচিত হয়। তবে বলা যায়, যারা শুধু ছড়া লিখে খ্যাতি পেয়েছেন তাদের অনেকের চেয়ে শামসুর রাহমানের ছড়া সংখ্যা কম। আবার অনেকের ছড়ার মানের বিচারে তার ছড়ার মান উন্নত। সুন্দর সুন্দর ছড়া লিখেছেন তিনি। সমাজের কাছেপিঠের উপাদান, রূপকথা, মিথ, ইতিহাস ইত্যাদি তার ছড়া-কবিতার উপাদান হয়েছে।
শামসুর রাহমানের প্রকাশিত ছড়াগ্রন্থ ১৪টি। ছড়াগ্রন্থের নামাকরণেও নান্দনিকতা রয়েছে এবং নাম থেকে মনে হয় গ্রামের গন্ধ বেরুচ্ছে। কোনটায় মনে হয় সামনে শিশুর মুখ ভেসে উঠছে। শিশুদের প্রিয় জিনিসগুলো নিয়ে তার ছড়াগুলো দারুণ। ছড়াগ্রন্থগুলো হলো: ১. এলাটিং বেলাটিং, ২. ধান ভানলে কুঁড়ো দেবো, ৩. গোলাপ ফোটে খুকির হাতে, ৪. রঙধনুর সাঁকো, ৫. লাল ফুলকির ছড়া, ৬. আগুনের ফুলকি ছোটে, ৭. নয়নার জন্যে, ৮.ইচ্ছে হলো যাই ছুটে যাই, ৯. তারার দোলনায় দীপিতা, ১০. সবার চোখে স্বপ্ন, ১১. চাঁদ জেগেছে সবার চোখে, ১২. আমের কুঁড়ি জামের কুঁড়ি, ১৩. হীরার পাখির গান ও ১৪. গোছানো বাগান।
১৯৯৮ সালে কবির ৭০তম জন্মদিনে প্রকাশিত হয় তার ছড়াসমগ্র। বইটিতে কবির প্রথম ৬টি ছড়ার বইয়ের সবগুলো ছড়া তো আছেই; আরও আছে তখনও বইয়ের বাইরে থাকা আরও ৪০টি ছড়া। সেগুলো পরে তার অন্য ছড়ার বইয়ে জায়গা পেয়েছে। প্রতিটি গ্রন্থের অধিকাংশ ছড়ার মধ্যেই ফুটে উঠেছে শিশুর প্রতি কবির অকৃত্রিম ভালোবাসা ও দরদ। তার ছড়ায় আছে ছোটদের মনভোলানো রূপকথার কাহিনি, আছে স্বপ্নরাজ্যের হাতছানি। সেইসঙ্গে আছে লৌকিক ছড়ার রূপ-রস ও সমাজমনস্কতা।
কবি প্রথমেই বলেছেন তিনি কাদের জন্য ছড়া লিখেন। কবি তার দুই নাতনি নয়না ও দীপিতাকে আনন্দ দেওয়ার জন্য অনেক ছড়া লিখেছেন। পরবর্তীতে এগুলো ক্লাসিক মর্যাদা পেয়ে গেছে। ‘এলাটিং বেলাটিং’ এ কবি লেখেন-
‘যারা বেড়ায় উড়ে পক্ষিরাজের পিঠে
যারা জিরোয় বসে স্বপ্নবাড়ির ভিটে
যারা ভেলকি বোঝে হঠাৎ মিলের ফাঁদের
ফাঁদের ফাঁদের ফাঁদের।
আমার ছড়ার এ বই পড়তে দেবে তাদের
তাদের তাদের তাদের।’
কবি তার ছড়ায় কেবল ছন্দের দোলাই দেননি, কল্পনার ছবি এঁকেছেন। ছড়াগুলো অনেকসময় কিশোর-কবিতা হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, ‘এলাটিং বেলাটিং’ এর প্রায় প্রতিটি ছড়ায় তিনি সচেতনভাবে গ্রামীণ জীবনের উপকরণ ব্যবহার করেন। ‘আমায় নিয়ে যা’ ছড়া থেকে একটি উদাহরণ-
‘নীলের ঘোড়া নীলের ঘোড়া পক্ষিরাজের ছা,
মেঘডুমাডুম আকাশপারে তা থৈ তা থৈ তা।
মেঘের দোলায় চললি কোথায়, কোন সে অচিন গাঁ
আয়-না নেমে গলির মোড়ে করবে না কেউ রা।’
জল-টুপটুপ, খোকন গেছে ক্ষীরসাগরে, জটিবুড়ির ছড়া, চরকাবুড়ি, আঁটুল-বাঁটুল ছড়া, খুকুমণির বিয়ে এ ছড়াগুলোর নাম থেকেই বোঝা যায় যে আমাদের রূপকথার চরিত্র ও কাহিনি নিয়ে তিনি ছোটদের জন্য লিখেছেন এগুলো। যেমন-
‘আঁটুল বাঁটুল শামলা সাঁটুল শামলা গেছে হাঁটে
কুঁচবরণ কন্যে যিনি, তিনি ঘুমান খাটে।
খাট নিয়েছে বোয়াল মাছে, কন্যে বসে কাঁদে,
ঘটি-বাটি সব নিয়েছে কিসে তবে রাঁধে?
আর কেঁদো না আর কেঁদো না ছোলাভাজা খেয়ো,
মাটির উপর মাদুর পেতে ঘুমের বাড়ি যেয়ো।’
সুন্দর একটি ছড়া-
‘মা মণিটার চোখ এড়িয়ে
গলির মোড়ের পুল পেরিয়ে
রোদের সাথে বুক মিলিয়ে
পাখনা-ভরা রঙ বিলিয়ে
এখান থেকে অনেক দূরে
যদি আমি যেতাম উড়ে
প্রজাপতির মতো
কেমন মজা হত।’
এটি ‘যদি আমি’ নামের ছড়া থেকে নেওয়া, ছড়াগ্রান্থ ‘ধান ভানলে কুঁড়ো দেব’। এ গ্রন্থে আছে আরও কিছু জনপ্রিয় ছড়া। ‘পণ্ডশ্রম’ কবিতার কথা কে না জানে! এটি রীতিমতো প্রবাদের মতো হয়ে গেছে প্রায় প্রতিটি চরণ। চিলে কান নিয়েছে শুনে সবাই চিলের পিছে ছুটছে, অথচ কেউ খেয়ালও করছে না, কান আদৌ চুরি হয়েছে কিনা! অসাধারণ ছড়ার একটি অংশ-
‘এই নিয়েছে ঔ নিল যা
কান নিয়েছে চিলে।
চিলের পিছে ঘুরছি মরে
আমরা সবাই মিলে।’
ঝড়-শেষে মানুষের অসহায়ত্বের বিবরণ তুলে ধরেছেন একেবারে সাদামাটা ভাষায়; কিন্তু সেই ভাষার বর্ণনা কী অসম্ভব শক্তিশালী, কী অসাধারণ, ‘ধান ভানলে কুঁড়ো দেব’ গ্রন্থের ‘সাইক্লোন’ ছড়া থেকে-
‘রোদ হচ্ছে বৃষ্টি হচ্ছে
খেঁকশেয়ালের বে।
সর্বনাশা ঝড়ের পরে
কোমর বাঁধে কে?’
ছড়ার মাধ্যমে কবি সমসাময়িককে তুলে ধরেছেন। সময়কে গুরুত্ব দিয়েছেন। নানা অনিয়ম তুলে ধরেছেন। ‘রংধনুর সাঁকো’ গ্রন্থের এরক একটি বিখ্যাত ছড়ার নাম ‘যা রাজাকার’-
‘যা রাজাকার ভেগে যা,
এদেশ ছেড়ে ভেগে যা
খোকার সাহস দেখে যা,
মারের মজা চেখে যা।
তোদের হাতে খুনের দাগ
ভাগ রে তোরা জোরসে ভাগ।”
‘লাল ফুলকির ছড়া’ বইয়ের কয়েকটি ছড়া আবার একেবারে রাজনৈতিক। খেটে-খাওয়া অসহায় মানুষের কথা ভেবে লিখলেন, অসাধুদের বিরুদ্ধে কঠোরভাষায় লিখলেন কবি-
‘সর্ষে তেলের ঘ্রাণ পাওয়া ভার
নেইকো ঘরে জ্বালানি।
পণ্যগুলো হচ্ছে লোপাট,
ধন্য চোরাচালানি।’
শামসুর রাহমান রূপক ছড়া লিখলেন বিদেশি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। ‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো’ ছড়াটিতে তিনি লিখলেন-
‘ছেলে ঘুমায় না, পাড়ায় জুড়ায় না
বর্গিরা এল দেশে।
বর্গি তাড়াবে তাই তো খোকন
সাজল বীরের বেশে।’
‘রূপকথা’ নামে ছড়াটিও একসময় খুব বিখ্যাত হয়েছিল। এটি একটি রূপক ছড়া। সোজা করে বললে, একটা জিনিসকে অন্য কোনো জিনিসের প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করাই রূপক। তার এই ‘রূপকথা’ নামের ছড়ার ‘আজব দেশের ধন্য রাজা’ বলে তিনি তখনকার স্বৈরাচারী শাসক এরশাদকে বুঝিয়েছিলেন। এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের সময় এ ছড়াটি রীতিমতো মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। ছড়াটি এমন-
‘আজব দেশের ধন্য রাজা
দেশজোড়া তাঁর নাম
বসলে বলেন, হাঁট রে তোরা,
চললে বলেন, থাম।’
‘ট্রেন’ কিশোর-কবিতাটি পাঠ্যপুস্তকে শিশুরা খুব আনন্দ পায়। ট্রেন হচ্ছে ছোটদের প্রিয় একটি বস্তু বা বিষয়। আর শামসুর রাহমান কী চমৎকার লিখলেন যা শিশুদের অন্তরে গেঁথে যায়-
‘ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে
রাত দুপুরে অই।
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে
ট্রেনের বাড়ি কই ?
একটু জিরোয়, ফের ছুটে যায়
মাঠ পেরুলেই বন।
পুলের ওপর বাজনা বাজে
ঝন ঝনাঝন ঝন।’
কবি শামসুর রাহমানের ডাকনাম ছিল বাচ্চু। মা তাকে এ নামে ডাকতেন। ‘মাগো তুমি’ কবিতায় মায়ের আবেগভরা সম্বোধনের স্মৃতি ফুটে উঠেছে এভাবে-
‘এখন কে আর বলবে আমায়
আয়রে বাচ্চু আমার কাছে?
দমকা হাওয়ায় পর্দা কাঁপে
পাতা নড়ে একলা গাছে।’
কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না! |