ভালো বন্ধুর গুণ

অসীম, আবিদ ও তালহা তিন বন্ধু। প্রতিদিন সাইকেলে চড়ে ইশকুলে যাওয়া-আসা করে। তারা খুব ভালো বন্ধু। এবার তারা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে, হুমায়ুন রেজা উচ্চ বিদ্যালয়ে।

জহির টিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 August 2021, 04:47 PM
Updated : 3 August 2021, 04:47 PM

তারা রানীনগর চৌকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে এবার পিএসসি পাশ করেছে। অসীম ও তালহার বাড়ি একই গ্রামে। আর আবিদের বাড়ি ওদের পাশের গ্রামে। কিন্তু একই রাস্তা দিয়ে তাদেরকে ইশকুলে যাতায়াত করতে হয়।

অসীম ও তালহাকে আবিদদের গ্রামের ভেতর দিয়েই যাতায়াত করতে হয়। আবিদ ইশকুল যাবার সময় হলে তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বাড়ির সামনে। যখন বন্ধুরা আসে তখনই একসঙ্গে টুংটাং টুংটাং করে সাইকেলের বেল বাজাতে বাজাতে ইশকুলে যায়।

কখনো তিনজন পিঁপড়ের মতো লম্বা সারি বেঁধে, কখনোবা পুরো রাস্তা ঘিরে সাইকেল চালায় ওরা। রাস্তাতেও জনসমাগম খুব একটা বেশি নয়। অটো, অটোরিকশা, সিএনজি এগুলোই বেশি যাতায়াত করে। মাঝেমধ্যে দুই-একটা ট্রাক বা ট্রলি যায়। ফাঁকা রাস্তায় বেশ খোশমেজাজে সাইকেল চালিয়ে যাওয়া-আসা করতে পারে তারা।

হঠাৎ একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে সিএনজির ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলো আবিদ। পাশ কেটে চলে যাওয়ায় কোনোরকমে আঘাত থেকে বেঁচে গেল অসীম ও তালহা। বড়ো ক্ষতি হয়ে গেল আবিদের। ডান পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ জোরেশোরে আঘাতে ভেঙে গেল। আবিদের  প্রচণ্ড চিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে গেল। আর বন্ধুর জন্য অসীম ও তালহার আহাজারিতে কেঁপে ওঠলো আশপাশ। কেঁপে ওঠলো রাস্তার দু’ধারের গাছপালা। কিচিরমিচির করতে লাগল গাছের পাখিরা। স্তব্ধ হয়ে গেল খাঁ খাঁ দুপুর।

দ্রুত রাজশাহী মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হলো আবিদকে। সর্বোচ্চ ভালো চিকিৎসার জন্য তাগাদা দেওয়া হলো ডাক্তারকে। কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করেও পা-টা বাঁচাতে পারলেন না ডাক্তাররা। শেষ পর্যন্ত পা কেটে ফেলতে হলো। সারা জীবনের মতো পঙ্গু হয়ে গেল আবিদ।

এখন আবিদকে স্টিলের ক্র্যাচের ওপর দুই বগল রেখে ভর দিয়ে চলাফেরা করতে হচ্ছে। ইচ্ছে করলেও আর আগের মতো দুরন্ত হয়ে ছোটাছুটি করতে পারবে না। রোজ বিকেলে একসঙ্গে খেলত আবিদরা তিন বন্ধু গ্রামের অন্যদের সঙ্গে। এখন আবিদ খেলার মাঠে যায় না। কিন্তু ইশকুলে যেতে কোনো সমস্যা হয় না। কারণ, এখন প্রতিদিন অসীম বা তালহার সাইকেলে চড়ে স্কুলে যাওয়া-আসা করে। তারাও নিয়মিত আবিদকে সাইকেলে চড়িয়ে ইশকুলে নিয়ে যায়। এমন কি কোনো জায়গায় ঘুরতে গেলও সঙ্গে নিয়ে যায়। তিল পরিমাণও তাদের মাঝে বন্ধুত্বের ছেদ পড়েনি। এলাকার লোকজন থেকে শুরু করে ইশকুলের শিক্ষকরা তাদের প্রশংসা করে।

এভাবেই যাচ্ছে আবিদের দিনকাল। পা হারানোর পর থেকে গ্রামের ফুটবল মাঠে একদিনও যায়নি। যেহেতু সে খেলাধুলা করতে পারবে না, তাই মাঠেও যায় না। এ সময়টা সে বাড়িতে বসে বসে সৃজনশীল কিছু করার চেষ্টা করে। কখনো ছবি আঁকে, কখনো মনের মধ্যে যা আসে তা দিয়ে ছন্দ বানানোর চেষ্টা করে। ছন্দ থেকে ছড়াও সৃষ্টি হয়ে যায়।

একদিন বিকেলবেলা বন্ধুদের খুব মিস করছিল আবিদ। এসময় কতই না বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করে আনন্দ-ফূর্তি করেছে। কিন্তু গত আট মাস ধরে কোনো খেলাধুলা তো দূরের কথা মাঠেও যাওয়া হয়নি। পুরনো স্মৃতিগুলো ভেতরে নাড়া দিতেই ধীরে ধীরে পৌঁছে গেল খেলার মাঠে। গিয়ে দেখে- অসীম, তালহাসহ আরও অনেকে ফুটবল খেলছে। মাঠের এককোণায় গিয়ে দাঁড়ালো আবিদ।

আবিদের দিকে প্রথমে চোখ পড়লো তালহার। দেখেই সে বলে ওঠলো- দেখ, দেখ আবিদ এসেছে। তালহার মুখে আবিদের কথা শুনে ছুটে গেল সবাই, আবিদকে ঘিরে ধরলো। অনেকদিন পর, আবিদকে খেলার মাঠে পেয়ে আনন্দ মুখরিত হয়ে ওঠলো খেলার মাঠ। অসীম বললো- চল আবিদ মাঠের ভেতরে। আবিদ মনটা ভার করে বলল- বন্ধু তোরা খেলা কর। আমি এখানে বসেই তোদের খেলা দেখি। আমি তো খেলতে পারবো না।

আবিদের মুখে কষ্টের ছাপ দেখতে পেল বন্ধুরা। তালহা ভাবতে লাগল, কীভাবে আবিদকে নিয়ে খেলা যায়! ভাবতে ভাবতে পেয়েও গেল। মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে তালহা বলল- তোরা শোন, আবিদকে নিয়েও আমরা খেলতে পারি। কিন্তু আমাদের একটু কষ্ট করতে হবে। সবাই বলে ওঠলো, কীভাবে বল, বল। তালহা বলল- এক পা দড়ি বা অন্যকিছু দিয়ে হাঁটুর ওপর ভাঁজ করে পেছনে বেঁধে রাখবো আমরা। আর আবিদের মতো করে দুই হাতে লাঠি নিয়ে আবিদের মতো হয়ে একসঙ্গে খেলতে পারি। তালহার কথায় সবাই সমর্থন জানালো। যেই ভাবনা সেই কাজ। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ খেললো আবিদকে নিয়ে তার বন্ধুরা।

খেলা শেষ হওয়ার পর তালহা বললো- আজ আমরা খেলায় অনেক মজা পেলাম, অনেকদিন পর আবিদকে মাঠে পেয়ে। আরেকটা কথা, আগামীকাল আমার জন্মদিন। তোরা সবাই বিকেলে আমাদের বাড়িতে আসবি। তালহার নিমন্ত্রণে সবাই সায় দিয়ে নিজ নিজ বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।

পরদিন বিকেলে সবাই তালহাদের বাড়িতে উপস্থিত। জন্মদিনের কেক কাটলো তালহা। সবাই সবার মুখে কেক তুলে খাওয়ালো। অনেক আনন্দ-ফূর্তি করলো ওরা। এরপর যে যা উপহার নিয়ে এসেছে তালহার হাতে তুলে দিচ্ছে। আর তালহা প্রতিটি বাক্স খুলে খুলে দেখছে। সবাই হৈ-হুল্লোড় করছে। সবার শেষে আবিদ এ-ফোর আকারের একটা লাল টুকটুকে খাম তুলে দিলো তালহার হাতে। সবার মনের মাঝে প্রশ্ন, আবিদ আবার খামের ভেতর কী নিয়ে এসেছে? খামের এক মাথা কাঁচি দিয়ে কেটে যা বের করলো তালহা, তাতে তার চোখ আনন্দে ছলছল করে ওঠলো।

আবিদের নিজ হাতে আঁকা একটা ছবি। সাদা আর্ট পেপারের ওপর কালো কোট আর চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা পরা তালহার ছবি। পিএসসি পরীক্ষার সময় এ ধরণের একটা ছবি তুলেছিল তালহা। সেই ছবিটার একটা কপি আবিদের কাছে ছিল। তা দেখেই হুবহু ছবিটা এঁকেছে অতি যত্নে। ছবির নিচে লেখা জন্মদিনের একটা ছোট্ট ছড়া-

‘জন্মদিনে দিলাম তোরে

নানান ফুলের গন্ধ,

হাজার বছর বেঁচে থাকিস

পাক জীবনটা ছন্দ।’

তালহাকে সবাই জড়িয়ে ধরলো। কারো কারো চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু পানি। তালহা চোখ মুছতে মুছতে বললো- আঁকা-লেখা কবে শিখলি? আবিদও চোখ মুছতে মুছতে বললো- কী করবো বল! খেলাধুলা তো আর করতে পারি না। তাই সেই সময়টা কাজ লাগাই এভাবে। তোরা যেমন আমার জন্য অনেককিছু করছিস, আমি কি তোদের জন্য এইটুকু করতে পারবো না!

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!