মাছের ডাক্তার

শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি, পানির নিচে প্রবাল প্রাচীরের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বিভিন্ন ধরনের রোগী মাছ। মানুষের মধ্যে যেমন ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে রোগীরা লাইন ধরে বসে থাকে, ঠিক তেমনি।

শেখ আনোয়ারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 July 2021, 06:10 AM
Updated : 31 July 2021, 06:10 AM

মানুষ যেমন মহামারীতে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করে চলে, রোগী মাছ কাজটি করে অনেক আগে থেকেই। রোগী মাছদের মধ্যে গায়ে গায়ে কোন ঠেসাঠেসি, ধাক্কাধাক্কি নেই। আগে ডাক্তার দেখানোর জন্য সিরিয়াল পেতে শক্তিশালী শিকারি মাছগুলো সামান্যতম গায়ের জোর খাটায় না। কারণ তারা জানে তাদের অসহিষ্ণুতার জন্য চিকিৎসক আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পালিয়ে যেতে পারেন। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তারাই।

মাছের ডাক্তার কেন?

মানুষের মত মাছদেরও বিভিন্ন রোগ হয়। মাছেরা পানির নিচে বসবাস করলে কি হবে, সেই পানির প্রবাল প্রাচীরে আস্তানা গাড়া বিষাক্ত ময়লা আবর্জনা, মাছের শরীরের উপর জমা হয়। পানিতে ঘুরে বেড়ায় জানা অজানা হাজারও রকম জীবাণু। রয়েছে ব্যাকটেরিয়া, পরজীবী-ছত্রাক। এসবের কারণে মাছের চামড়ায় ঘা হয়।

বিজ্ঞানীরা জানান, মাছের সবচেয়ে বিপদজনক রোগের উদ্ভব হয় এসব পরজীবীর আক্রমণ থেকে। এছাড়া অনেক সময় মাছের আঁশের নিচে ছোট ছোট পোকামাকড় বাসা বাঁধে। এসব ক্ষতিকারক পরজীবী বা প্যারাসাইট পরিষ্কার না করলে অকালে মারা যায় মাছ। এজন্য দরকার হয় মাছের ডাক্তার।  মাছেরা যখন বুঝতে পারে তারা পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে তখন তারা মাছের ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয়।

মাছের ডাক্তার চেনার উপায় কী?

তবে ডাক্তার মাছরা কি করে বুঝবে কাদের চিকিৎসার দরকার? প্রবাল প্রাচীরের আশপাশে ঘুরে বেড়ানো সব মাছকেই তো আর পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব না। তাই আপন মনে রোগী মাছদেরকেই খুঁজে বের করে নিতে হয়, কোথায় রয়েছে মাছের ডাক্তার। মানুষ ডাক্তারের মত মাছের ডাক্তারদের কোন নেমপ্লেট নেই। ডাক্তার মাছদের চেনার উপায় হচ্ছে, এসব মাছের থাকে চোখ ধাঁধানো রঙ। এই চটকদার রঙ বেশিরভাগ সময়েই হয় টুকটুকে লাল অথবা হলদে কালোয় মিশানো। যার সঙ্গে মেশানো থাকে নীল রঙের কারুকাজ।

যেসব ডাক্তার মাছ পানির নিচে বিনা পয়সায় চিকিৎসা দেওয়ার জন্য রীতিমতো চেম্বার খুলে বসেছে তাদের মধ্যে রয়েছে রেসিমাছ, গারা রুফা মাছ, পাইলট মাছ ও অ্যাঞ্জেল নামক মাছ। সাগরে এক প্রজাতির বড় চিংড়ি মাছও তার হাত-পা, অ্যান্টেনা দিয়ে ডাক্তারি করতে খুব ওস্তাদ। এসব ডাক্তার মাছের চেম্বারে এসে রোগী মাছকে জানাতে হয়, আমাদের চিকিৎসার দরকার। তারপর নানা ধরনের অসংখ্য রোগী মাছের ভিড়ে সিরিয়াল নিয়ে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করে লাইনে দাঁড়াতে হয়।

মাছের ডাক্তার কী চিকিৎসা করে?

মজার ব্যাপার হলো, মানুষের যেমন বিভিন্ন ধরনের রোগের জন্য আলাদা আলাদা চিকিৎসক থাকেন তেমনি মাছদের ক্ষেত্রেও রোগ সারানোর জন্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন চিকিৎসক। সুঁচালো মুখের চিকিৎসক মাছেরা, রোগী মাছের আঁশের নিচে লুকিয়ে থাকা পরজীবী বা অন্য কোন ধরণের ময়লা থাকলে তা পরিষ্কার করে দেয়। অন্যদিকে ক্ষুরের মতো মুখের ডাক্তার মাছেরা হলো বিশেষজ্ঞ সার্জন। এই মাছ রোগী মাছের ত্বকের উপর জড়িয়ে থাকা পরজীবীদের দক্ষ সার্জনের মত কেটে শেষ করে দেয়।

এসব ডাক্তার মাছের মধ্যে এক শ্রেণীর ডেন্টিস্ট মাছও রয়েছে। যারা বড় শুধু দাঁতওয়ালা মাছদের দাঁতের চিকিৎসা করে। প্রবাল দ্বীপে দাঁতওয়ালা মাছের মুখে প্রচুর ব্যাকটেরিয়া জন্মে। তাই এই মাছকে শরণাপন্ন হতে হয় দাঁতের ডাক্তারের কাছে। তারপর রোগী মাছকে তার ফুলকা খাড়া করে, কান ও মুখ খুলে ডাক্তার মাছকে দেখাতে হয়। ডাক্তার মাছ সময় নিয়ে সুনিপুণ চিকিৎসা দেয়। নির্ভয়ে মাছের মুখের ভেতর, ফুলকার ভেতর ঢুকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দাঁত ও মুখের ঘা পরিষ্কার করে দেয়।

ব্যাকটেরিয়াজনিত ঘা রোগের জন্য ডাক্তার মাছ প্রথমে তার মুখ দিয়ে ঠুকরে ঠুকরে ঘায়ের উপরের ময়লা সরিয়ে ক্ষতস্থানটি জীবাণুমুক্ত করে। তারপর নিজের মুখে থাকা প্রাকৃতিক মলম ঘায়ের ওপর লাগিয়ে দেয়। আর তাতেই শতভাগ আরোগ্য লাভ করে রোগী মাছ। সত্যিই আজব ব্যাপার তাই না!

মাছের ডাক্তার এখন মানুষের ডাক্তার

ডাক্তার মাছ নামে পরিচিত ছোট আকারের এই মাছগুলো আজকাল মানুষের চিকিৎসাও করছে। এসব মাছের ডাক্তার বিভিন্ন পদ্ধতিতে মানুষের একাধিক চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে। যেমন, পক্ষাঘাত বা প্যারালাইসিসে, হাড়ের জোড়ের ব্যথা ও চর্মরোগের কার্যকর থেরাপির নাম ইচোথেরাপি। দেশ-বিদেশে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই থেরাপি।

অভিজাত হোটেলে এ মাছের ডাক্তার দিয়ে স্পা থেরাপি করা হয়। রোগীর শরীরের হাত-পা কিংবা পুরো শরীর পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয়। ডাক্তার মাছ এসে রোগীর শরীর থেকে খুটে খুটে খাবার খায়। এর সাহায্যে ক্ষত পরিষ্কার হয়ে যায়। এতেই সেরে যায় রোগ। জাপান, তুরস্ক, দুবাইসহ বেশ কয়েকটি দেশে এ চিকিৎসার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে।

অক্সফোর্ড জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী অ্যালন ইভানস বলেন, “সোরেসিসে আক্রান্ত ৮৮ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, ইচোথেরাপির মাধ্যমে তাদের সোরেসিস সম্পূর্ণ সারিয়ে ফেলা সম্ভব হয়েছে। যদিও বৈজ্ঞানিকভাবে এর কোনো পরীক্ষা হয়নি, তবে ব্যাক্টেরিয়াল ইনফেকশন সারাতে খুবই উপকার করছে এই ডাক্তার মাছ।”

মাছের ডাক্তাররা সারাজীবন তাদের এই ডাক্তারি চালিয়ে যেতে পারে না। মানুষের মতো তাদেরও কর্মজীবন থেকে এক সময় অবসর নিতেই হয়।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!