এক জাপানি ছাত্রের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন

বই: নরওয়েজিয়ান উড, লেখক: হারুকি মুরাকামি, অনুবাদক: আলভী আহমেদ, প্রকাশনী: বাতিঘর, পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৩৫২, মূল্য: ৪৮০ টাকা

হিমু চন্দ্র শীলহিমু চন্দ্র শীল
Published : 12 July 2021, 04:38 PM
Updated : 12 July 2021, 04:38 PM

জাপান এমন একটি দেশ যেখানে সময়ানুবর্তিতা, নিয়মানুবর্তিতা কঠিনভাবে পালন করা হয়। সবকিছু নিখুঁতভাবে করা এ দেশের এক কথাসাহিত্যিক হারুকি মুরাকামি কলমের আঁচড়ে ঠিক এমনই নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ‘নরওয়েজিয়ান উড’ নামে একটি উপন্যাস।

আলভী আহমেদের বাংলা অনুবাদও যেন সেই উপন্যাসে যোগ করেছে এক মিশ্র অনুভূতি। ষাটের দশকের শেষদিকের টোকিও শহরের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে পড়তে আসা তরু ওয়াতানাবেকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে উপজীব্য করে এগিয়ে যাওয়া এ উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে। তারুণ্যনির্ভর এ উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই মৌলিক রচনার মধ্যে ‘নরওয়েজিয়ান উড’ দ্রুত পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠে।

উপন্যাসটি গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে খোলামেলা বর্ণনায় কাল্পনিক চরিত্রগুলো বাস্তবে রূপান্তরিত করে তুলেছেন হারুকি মুরাকামি। উপন্যাসের শুরুতে একটা সময় গিয়ে মনে হবে অন্তরঙ্গতা আর যৌনতা এ উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু। কিন্তু আরেকটা সময় চমকপ্রদ কিছু ঘটনার সাবলীল বর্ণনা যেন পাঠকের হৃদয়ে সেই ভুল ভাঙিয়ে ঢেউ তুলবে আনকোরা শিহরণের। আকুতি জানিয়ে অশ্রুসিক্ত করবে দুই নয়ন।

পৃথিবী-বিখ্যাত ‘বিটলস’ ব্যান্ডের গান থেকে সৃষ্ট উপন্যাসটির নাম যেন এক সার্থকতা নিয়ে এসে খ্যাতির চূড়ায় দেশে ও বিশ্বে স্থান করে দেয় হারুকি মুরাকামিকে। নভেম্বরের শীতল বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে ভারি মেঘের ভেতর দিয়ে প্লেনে করে জার্মান যাওয়ার সময় ৩৭ বছর বয়সী তরু ওয়াতানাবে ফিরে যায় ১৯৬৯ সালের নিজের ফেলে আসা অদ্ভুত এক জীবনে। আঠারো বছর আগে সদ্য বিশে পা দিতে যাওয়া তরু ওয়াতানাবে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য জাপানের রাজধানী টোকিও শহরে এসে ভর্তি হন এক বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যসব ছাত্রদের মতো তরু ওয়াতানাবেও ডর্মে উঠে। স্বাভাবিক ডর্মের মতো তরু ওয়াতানাবের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডর্মগুলোও ছিলো ছেলেদের খোলামেলা ক্রিয়াকলাপ আর তারুণ্যের ছোঁয়ায় মত্ত। কিন্তু তরু ওয়াতানাবেকে ওসব টানত না। সে সবসময় সবার কাছ থেকে আলাদা হয়ে থাকার মধ্যে নিজের সুখ খুঁজে নিত। ঘটনাক্রমে কিজুকি নামে আরেক তরুণ তার ভালো বন্ধু হয়ে ওঠে।

সেই কিজুকির গার্লফ্রেন্ড হলো নাওকো। ‘নরওয়েজিয়ান উড’ উপন্যাসটি এখানেই এসে মোড় নেয় অন্যদিকে যখন কিজুকি সুইসাইড করলো। কিজুকির সুইসাইড তরু ওয়াতানাবেকে ভীষণ নাড়িয়ে তুলল। প্রিয় বন্ধুর আকস্মিক মৃত্যুতে হতবিহ্বল তরু ওয়াতানাবে হয়ে পড়ে দিশেহারা। যার সঙ্গে কিছুদিন আগেও সব শেয়ার করতো সে বন্ধুটি নেই ভাবতেই বিমর্ষ হয়ে পড়ে তরু। প্রিয় বন্ধু যে এভাবে কিছু না বলে আচমকা সুইসাইড করবে তা তরু ওয়াতানাবের কল্পনাতীত।

কিজুকির মৃত্যুর পর তরু ওয়াতানাবের পাশাপাশি আরও একটি প্রাণ কুঁকড়ে কুঁকড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিল, আর তিনি হলেন কিজুকির গার্লফ্রেন্ড নাওকো। নাওকো নিঃসঙ্গতা থেকে বের হতে ভরসা খুঁজে পায় তরু ওয়াতানাবের ওপর। যার ফল হিসেবে তরু ওয়াতানাবে আর নাওকোর মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তরু ওয়াতানাবে ডর্মের রুমমেট স্ট্রর্মট্রুপার এর মজার কাহিনি থেকে শুরু করে ডর্মের নানা ঘটনা শেয়ার করতো নাওকোর সঙ্গে।

একটা সময় গিয়ে সেই বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে অন্তরঙ্গতায় রূপ নেয়। কিন্তু সেই পরিস্থিতি একসময় পাল্টে যায় যখন নাওকো মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে। নাওকো সেই অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে নির্জন এক কটেজ, বলতে গেলে এক ধরনের চিকিৎসালয় যেখানে অবসাদগ্রস্ত রোগীরা সাময়িক স্বাচ্ছন্দ্যে কিছু সময় অতিবাহিত করতে পারে সেখানে স্থান নেয়। নাওকোর চলে যাওয়ার পরে তরু ওয়াতানাবে আরও একা হয়ে পড়ে। আর সেই একাকীত্ব তরু ওয়াতানাবেকে ভীষণ কষ্ট দেয়।

তরু ওয়াতানাবে সেই একাকীত্ব থেকে রেহায় পেতে ডর্মের পাশের নাগাসাওয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। আর নাগাসাওয়া, তরু ওয়াতানাবেকে নিয়ে পা বাড়ায় নিষিদ্ধ পথে। প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য না পাওয়ার কষ্ট ভুলে থাকতে বিভিন্ন মেয়েদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা শুরু করে তরু। কিন্তু সেই অতিবাহিত সময়ের স্রোতের ফাঁকে মিদোরি নামক এক নারী এসে প্রবেশ করে তরু ওয়াতানাবের জীবনে। ধীরে ধীরে একসময় মিদোরি হয়ে উঠে তরু ওয়াতানাবের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

তখন দোটানায় পড়ে যায় তরু ওয়াতানাবে। একদিকে নাওকোর প্রতি তার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ভালোবাসা, অপরদিকে মিদোরির প্রতি সাময়িক ভালোবাসার দায়বদ্ধতা তাকে জটিল সমস্যায় ফেলে দেয়। নাওকোকে একবার দেখতে গিয়ে নাওকোর রুমমেট কিংবা সাহায্যকারী রেইকোর প্রতিও দুর্বল হয়ে পড়ে তরু। একটা সময় গিয়ে সেই দুর্বলতা ঘনীভূত হয়ে ভালো সম্পর্কে রূপ নেয়। আর সেই ভালো সম্পর্ক ধীরে ধীরে রেইকোর সঙ্গেও তরু ওয়াতানাবেকে অন্তরঙ্গতার দিকে নিয়ে যায়।

এক অদ্ভুত সম্পর্কের গেঁড়াকলে পড়ে ‘নরওয়েজিয়ান উড’ এগুতে থাকে নানা বিচিত্রতার মধ্য দিয়ে। কখনো তারুণ্যের শিহরণ জাগানো প্রেম নামক সম্পর্ক আবার কখনও অবাধ মেলামেশা কিংবা হৃদয় থেকে অনুভব করা পবিত্র ভালোবাসা হারুকি মুরাকামির কলমের সূচালো ডগায় ফুটে ওঠে। দিশেহারা পথিকের মতো ক্লান্ত-শ্রান্ত তরু ওয়াতানাবে যেন হয়ে ওঠে ভালো আর মন্দের মিশেলে সেই গল্পের এক অদ্ভুত চরিত্র।

কিন্তু একটা সময় নাওকোর সুইসাইড সব জটিলতার অবসান ঘটিয়ে ‘নরওয়েজিয়ান উড’ প্রবাহিত হয় ভিন্ন ধারায়। তরু ওয়াতানাবে স্বার্থপরের মতো মিদোরিকে ফোন করে তার মনের কথা বলার আকুতি জানাল, অবশেষে মিদোরির মৃদু কণ্ঠ নিরবতা ভাঙলো, কোথায় তুমি? কোথায় আমি? ফোনের রিসিভার চেপে ধরে আমি টেলিফোনের বুথের ভেতর থেকে আশপাশে তাকালাম। আমি কোথায় আছি জানি না। একদম কোন ধারণা নেই আমার। এই জায়গাটা কোথায়? আমার চোখের সামনে খালি ভেসে উঠল হাজার-হাজার মানুষ এদিক ওদিক চলাচল করছে। তারা কোন এক অদৃশ্য জায়গা থেকে এসে আবার কোথায় জানি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। নামহীন এই অজানা, মৃত জায়গা থেকে আমি বারবার মিদোরিকে ডেকে যেতে লাগলাম।

একথা বলেই হারুকি মুরাকামি তার উপন্যাস ‘নরওয়েজিয়ান উড’ এর সমাপ্তি টানলেন। প্রতিটি গল্পের একটি শুরু থাকে, থাকে শেষ। ‘নরওয়েজিয়ান উড’ উপন্যাসটা শুরু হয়েছিল তরু ওয়াতানাবের হাত ধরে। কিন্তু কি অবাক করা ব্যাপার উপন্যাসের সমাপ্তি রেখাটাও তিনিই টেনে দিলেন। তবে কলমের ডগার আঁচড়ে নয়, নাওকো-মিদোরি নামে দুটি প্রাণের জন্য পাঠকের হৃদয়ে রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!