দু’বছর তিন মাসের প্রচেষ্টার ফল পেতে যাচ্ছি দেখে শেষবারের মতো সব গুছিয়ে নিচ্ছি। এরপর যা করার তা এডিটর মহাশয় করবেন, মানে আমার হাতের বাইরে। কিন্তু ভুল কিছু হলে আমার হাতেই ধরা পরুক। নির্ঘুম রাত পেরিয়ে অবশেষে উপন্যাসটা লিখে শেষ করলাম।
আজই কুরিয়ারে লেখাটা পাঠাতে হবে, না হলে হিতে বিপরীত হতে দেরি নেই। সহধর্মিণীর শত প্রচেষ্টার পর শান্তির ঘুমকে ভেঙে, সামান্য কিছু কাজ শেষ করেই বেরিয়ে পরলাম। আজ একটা বিশেষ দিন তাই রিকশা নিলাম না। রিকশা নাম মুখে আসলেই তার মধ্য থেকে রিস্ক শব্দটা কেন জানি ভেসে আসে। আজকের এই দিনে রিস্কের ধারে কাছেও যাওয়া যাবে না। তাই অটো নিলাম, ভাড়াও কম। আর হয়তো অটোতে চড়ে সব অটো হয়ে যাবে, কাজ তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। তারপর ভাবলাম এ কেমন অবাস্তব যুক্তি!
যাকগে, আচ্ছা কোথা থেকে কুরিয়ার করা যায়! শুভ বলেও তো একটা কথা আছে! দাঁড়া, আরে দিদিমার আশীর্বাদ নেওয়া হয়নি। আরে ভাই থামান না।
ও মোক কহেছেন? মুই মনে করিছু বাতাসের সাথে কথা কহেছেন। সেলা থেকে বিড়বিড়...
হইছে, এ ধর..
ভ্যান-অটো মিললো না, অগত্যা রিকশাই নিতে হলো। আশীর্বাদটা যে বেশি জরুরি।
নীল ভাইয়া..
হ্যাঁ দিদি।
কোনো খোঁজ খবর যে নিস না?
এইতো আসিনু...
বস, নাস্তা দেছু।
না না দি, অন্যদিন খাম। আইজ একটা লেখা বের করিবা দিম। সময় নাই। ১১ সংখ্যাটা আইজকার তানে ভালো, দশটা পার হয়ে গেইছে। আশীর্বাদ কর যেনো ভালোয় ভালোয় হয়ে যায়।
কিসের লেখা রে?
মোর লেখা বই ‘স্মৃতি ডায়েরি’। অনেকদিন ধরে লেখেছু। মেলা প্রকাশনীর সাথে কথা কহিনু কাহ নিবা চাহে না। এলা ঠিকানা প্রকাশনী হ্যাঁ কহিছে। লেখা পাঠাবা লাগে।
যাগ, অনেকদূর যা এডায় চাহু।
আচ্ছা দি, আসু?
যা তাইলে, সময় পাইলে আসিস।
এবার ভ্যান পেয়ে গেলাম। ধীরে যাচ্ছে, কিন্তু শুভ বলেও একটা কথা আছে তো নাকি! কুরিয়ারের বিষয়টা কী করা যায়? করতোয়া কুরিয়ার সার্ভিস, বান্দরবান কুরিয়ার সার্ভিস না সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস! সুন্দরবন, হ্যাঁ এটাই ঠিক হবে। আহা, সব ভালোই হচ্ছে সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি। পাঠানোর আগে এডিটর মহাশয়কে ফোন করা দরকার।
হ্যালো এডিটর মহাশয়?
জ্বি, কে?
জ্বি আমি হে আমি।
হ্যাঁ, আপনি কে?
নাম্বার সেভ করেননি বুঝি! আমি নীলকান্ত রায়, নীল বাবু।
ও আচ্ছা, হ্যাঁ বাবু বলুন। কি খবর? কেমন আছেন?
জ্বি ভালো। আচ্ছা লেখাটা সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসে পাঠাচ্ছি, কাল পৌঁছে যাবে। চলবে তো?
কিসের লেখা?
জ্বি! আমার লেখা উপন্যাস ‘স্মৃতি ডায়েরি’। বলেছিলেন যে পাঠিয়ে দিতে!
ও আচ্ছা, তো দেন। কী সমস্যা?
না সমস্যা নেই, সেটাই বলছি যে সুন্দরবন কুরিয়ারে পাঠাচ্ছি।
কি বলছেন মশাই? না না চলবে না।
সে কি, কেন?
সুন্দরবন কুরিয়ার অফিস থেকে অনেক দূরে। বাড়তি খরচ হয়ে যাবে।
ও আচ্ছা! তাহলে?
ডাকে পাঠান।
কাকে ডাকে পাঠাব?
আরে মশাই সরকারি ডাক অফিস থেকে পাঠান। সেটা কাছেই সমস্যা হবে না, চেনাজানা আছে আমাদের অফিসে এসে দিয়ে যাবে।
অসম্ভব! বোঝার চেষ্টা করুন..
কী বুঝবো?
ডাক শব্দটা ঠিক খাচ্ছে না। ডাকাত ডাকাত লাগে, এখনি ডাকা ফেলবে! মানে অসহ্যকর অশুভ।
কি বলছেন ফাও কথা। পাঠালে পাঠান তো, না হলে বাদ দেন।
আচ্ছা আচ্ছা মশাই পাঠাচ্ছি।
এখন ভেজাল করলে চলবেই না। আজ প্রথম তো তাই তেনার ভাব বেশি। একবার বিখ্যাত হতে দিন মহাশয়, কেঁদে মরে যাবেন তাও আমার বই ছাপানোর ভাগ্য আপনার হবে না। কষ্ট শুধু একটাই, প্রথম কাজে অশুভকেই সাথে নিতে হচ্ছে ধুর।
স্যার, এখন কি ডাক অফিস নিবো? ভাড়া বেশি লাগবে।
তালে বেতালে ভুলে গেছি ভ্যানে বসে আছি। সময় খেয়েছি এখন ভাড়া ডবল চাইবেই।
আচ্ছা যাও, পাঁচ টাকা বেশি নিও।
না স্যার, বিশ টাকা।
কি! এতটুকু রাস্তা যেতে আরও বিশ টাকা! এ ধরো পনের, এখান থেকেই বিদেয় হও।
আমি হাঁটছি। শুধু হাঁটছি, পোঁছাচ্ছি না। রাস্তা আসলেই দূর। আরও দশ দিতে চাইলে হয়তো ভ্যানটাই আসতো। রিকশা ছাড়া অন্য বাহন নিরুদ্দেশ। এদিকে চলতে চলতে ক্লান্তি যেন আঁকড়ে ধরেছে। সকালের নাস্তাটা জমিয়ে করলেই ভালো হতো। এত করে বউ বললো- খাওয়া শেষ করে যাও। এখন বুঝো ঠেলা! অগত্যা আবার সেই রিকশার রিস্ক নিতেই হলো, তাও আবার বিশ টাকা ভাড়ায়।
হ্যালো এডিটর মহাশয়?
জ্বি বলুন..
পাঠিয়ে দিয়েছি, কবে বের হবে।
জানাবো, আগে আসতে তো দিন কী লিখেছেন দেখি। তাছাড়া প্রথম কপি আপনিই পাবেন।
জ্বি ধন্য...
আজব কিসিমের লোক। ধন্যবাদ শেষ করতে দিল না। যাকগে, এখন বইটা ভালোয় ভালোয় বের হলেই হয়।
মাসটা পার হতে চলল খবর নেই। কল দিলে হয় ব্যস্ত না হলে ধরেনই না। এপ্রিলের অর্ধেক দিন চলেই গেলো। একদিন..
হ্যাঁ সম্পাদক সাহেব?
না স্যার, আমি ওনার পিএ বলতে পারেন।
উনি নেই?
জ্বি, উনি একটু ব্যস্ত আছেন। আমাকে বলুন?
ও, আমি একটা লেখা পাঠিয়েছিলাম। সেটার খবর জানার জন্যই ফোন..
জ্বি, নতুন কিছু লেখা সামনের মাসে রবীন্দ্রজয়ন্তীতে প্রকাশ পাবে।
আচ্ছা আচ্ছা, ধন্যবাদ ধন্যবাদ।
এ যেনো শুধু বাতাস নয়, বইছে আনন্দ। গুপী গাইনের মতো গাইতে ইচ্ছে করছে, আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। ও গো বাঘার ঢোল নিয়ে এসো আমি গাইবো, তুমি বাজাবে- তাক ধিন ধিন তাক।
একুশে বৈশাখ একটা কুরিয়ার এলো। ছোট কাগজে লেখা, ‘পড়ে জানাবেন’। খুলে দেখলাম, আরে আমার বই। শুধু নামটা ‘স্মৃতি’ থেকে ‘স্মৃতির’ হয়ে গেছে। এটা অনেক বড় ব্যাপার, লেখককে না জানিয়ে নাম পরিবর্তন! ধিক্কারজনক কাজ। তাও কিছু মনে করলাম না, আর কিছু না দেখেই পড়া শুরু করলাম। একি! এটা আমার লেখা নয়। আমি এসব লিখিনি। লেখক তাহলে কে? অজিত কুমার সেন!
মহাশয়, কার বই দিলেন এটা? আমার বই কোথায়?
আরে নীলকান্ত বাবু যে...
জ্বি, আমার বই না দিয়ে অন্যের বই দিলেন কেন?
ব্যস্ত হবেন না বাবু। শুনুন, আপনার বইটা আমার জন্য শুভ ছিল না, তাই ছাপানো উচিত মনে করিনি।
কেন? কী ভুল ছিল?
প্রথম তো নামটা মিসিং ছিল। স্মৃতি না দিয়ে স্মৃতির দিলে ভালো লাগতো। তাছাড়া অজিত বাবুর লেখাটা আপনার লেখার চেয়ে পাঠক খাবে বেশি।
আমারটা কেন খাবে না?
অনেক কারণ আছে। যেমন মশাই আপনি লিখেছেন, ‘স্মৃতি ধরে রাখা যায়, মনের খাতায় ডায়রিতে। যখন ইচ্ছা খোলা যায়, অশ্রু ঝর্ণায় ভাসা যায়। আবার বন্ধ করে ফেলা যায় ব্যস্ততা নামক তালায়।’ তিনি লিখেছেন, ‘স্মৃতি ধরে রাখা যায় না, রয়ে যায়। কোনো এক দক্ষিণা বাতাসে শুধু মনে পড়ে যায়। চোখে আসে অশ্রু। শত ব্যস্ততায় তাকে বাঁধা যায় না, ঠিকই চলে আসে।’ আপনার কোনটা ভালো লাগছে? আমার মশাই ওনারটা ভালো লেগেছে, তাই সেটাই পাবলিশ করছি।
আপনি কি করে জানেন যে আমারটা পাঠক মহলে চলবে না?
বিশ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে জানি।
আমি এখন নিস্তব্ধতায় রয়েছি, এ বাতাস আজ ভারি লাগছে। বাতাসে আর আনন্দ নেই, আছে শুধু হাহাকার। এ হাহাকার কোথাকার! কোথা থেকে এলো! দম ঘুটে মৃত্যু যেন আসন্ন। অক্সিজেন! অক্সিজেন চাই অক্সিজেন। আমার লেখা পাঠকরা খাবে না! আমি আর লিখবো না, আমার কি দমে যাওয়া উচিত? লেখা আমার পেশা নাকি নেশা! আমি কি সত্যিই লিখবো না! পাঠকের প্রতি নীলকান্তের ইতি এখানেই।
লেখক পরিচিতি: শিক্ষার্থী, উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষ, রংপুর সরকারি সিটি কলেজ
কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না! |