একটি ফুল

প্রতিদিনের মতো আজও সাতসকাল গিটার নিয়ে বাড়ির ছাদে এলাম। গান শোনা আর বাগান পরিচর্যা যেনো নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মাধব রায়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 April 2021, 05:42 AM
Updated : 13 April 2021, 05:42 AM

বাগান বলতে চারটে গোলাপ, দুটো সন্ধ্যামালতী আর গাঁদাগুলো সবে বড় হচ্ছে। সন্ধ্যামালতীর ফুল এখনো দেখা যায়নি, গোলাপ বুঝি কিছুদিনের মধ্যেই ফুটবে।

জল দেওয়ার নিত্যকর্ম শেষ করে গিটারে হাত দিয়েছি। প্রতিদিন সাত সুরের বারোটা না বাজালেই নয়। নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে ‘ওরে নীল দরিয়া’ গান। যদিও মুখে এক গিটারে আরেক সুর, তবু গান থামছে না। আমায় দে রে দে ছাড়িয়া...আরে সে কে? সৃষ্টি! কবে এলো? কেমন আছে? জানা দরকার। 

আমাদের বাড়ির সামনে রাস্তার ওপাশেই বাড়ি তার। তিনমাস আগে গিয়েছিল ভারতে, লিভারের সমস্যা না কী যেন, আজ ফিরেছে।

সেদিন বিকেলের দিকে ছাদে বসে আছি, যদি সকালের মতো হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। কিন্তু কই আসছে নাতো! তার বাড়ির কাজের ছেলেটাকে দেখা যাচ্ছে- কাপড় তুলছে। এদিকে তাকাতেই তাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বললাম। বয়সে বড় হবার এই এক সুযোগ, যখন তখন যাকে তাকে ডাকা যায়- ডেকে পাঠানো যায়।

কিরে কি অবস্থা তোর?

এইতো দাদা ভালোই।

আচ্ছা, সৃষ্টি ফিরেছে নাকি শুনলাম।

জ্বি দাদা, গতকাল দু কি তিনটার দিকে।

ওহ ভালো, তো কেমন আছে?

কে?

আরে বাড়ির সবাই?

জ্বি ভালো, বাবার একটু জ্বর।

আরে তোর বাড়ির না তোর কাকার বাড়ির যেখানে কাজ করিস।

ওহ হ্যাঁ, সবাই ভালো আছে।

আচ্ছা যা..

ঠিক আছে।

আরে শোন শোন, সৃষ্টি কি এখন পুরোপুরি সুস্থ না আরও দৌড় দেবে কোথাও?

না দাদা, পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। মাঝে মাঝেই ব্যথায় ছটফট করে, নিজের মুখে বলে না। কাকিমা পাশে শোয় বলে বুঝতে পারে। ডেইলি ওষুধ চলছে। হায়দ্রাবাদের ডাক্তার বলেছিল কিছুদিন থাকতে, কিন্তু কাকার তো আর টাকা কুলায় না। এখন শুধু বাড়িটাই সম্বল, বাকি সব তো গেছে।

তোকে এতসব বলতে কে বলছে। এ ধর দশ টাকা, যা কাজ কর।

মনু মিথ্যে কিছু বলেনি। আমিও তাই শুনেছি, ভাইদের দিয়ে নিজের সব জমি বিক্রি করেছে। মাস্টারি চাকরির আর বেতনইবা কত যে জমাপুঞ্জি দিয়েই কাজ চালিয়ে নেবে! আদরের একমাত্র মেয়ে, ছোট থেকেই কত না যত্নে মানুষ করেছে। নিজের সবটুকু ভালোবাসা শুধু একজনের উপর, তাই সব দিয়েই স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার প্রদীপ শেষ রক্ষা করার চেষ্টা।

ঘুম হয়নি। সারারাত কোথাকার কোন যেন চিন্তাবানু মাথায় আখড়া বেঁধে আছে, যাওয়ার নাম নিচ্ছে না। শুধু মনে বিড়বিড় করছে শেষ রক্ষা হবে তো?

সকালে আর ছাদে উঠলাম না, বিকেলে জল দেব ভেবে প্রায় অর্ধদিন ঘুমিয়েছি।

বিকেলে ছাদে উঠলাম ঠিকই, কিন্তু জল আনতে ভুলে গেছি। যাকগে কাল দিয়ে দেব। ওমা সেকি! একটা গোলাপ ফুটেছে! যে গাছটা মরমর অবস্থা সেটাই ফুটেছে। বাহ! কি অপরূপ। এই একটি ফুল যেন পুরো ছাদকেই আপন করে ধরে আছে, সঙ্গে আমাকেও।

সামনের ছাদে সৃষ্টি আর তার মা। সৃষ্টি চেয়ারে বসা কেন! আগে তো কোনোদিন দেখিনি এভাবে, হয়তো অসুস্থ শরীর তাই। মনে মনে ঠিক করছি যদি সব ঠিক থাকে তবে এ ছাদের এই একটি গোলাপ ওই ছাদের ওই ফুলের তরে অর্পণ করবো।

কিছুক্ষণ পর সৃষ্টি চলে গেল, বুঝলাম সে একা একা হাঁটার শক্তি পাচ্ছে না। মন ভার হয়ে গেলো, আমি যদি কিছু কাজে আসতে পারতাম ভালো লাগতো।

রাত তখন দশটা।

কিরে মনু কই যাচ্ছিস?

আর বলিও না দাদা, অক্সিজেন সিলিন্ডার নিতে যাই। দিদির নাকি দম নিতে কষ্ট হচ্ছে।

কি বলিস! আমি গাড়ি বের করবো?

না, লাগবে না। সামনের দোকানে কাকুর গাড়িটা আছে।

যা যা তাড়াতাড়ি যা।

আজও ঘুম ধরছে না। সেই চিন্তাবানু বিড়বিড় করছে, শেষ রক্ষা হবে তো একটি ফুলের। রাতে কখন ঘুমিয়েছি জানি না, তবে তা তিন কি সাড়ে তিন তো হবেই। কারণ চিন্তাবানু আড়াইটা পর্যন্ত এসে তার কথা উল্টিয়েছিল, ওই একটি ফুলের শেষ রক্ষা বুঝি আর হলো না।

আজও ছাদে এলাম, কিন্তু প্রতিদিনের মতো আনন্দ নেই। কোথায় গেলো! কে নিয়ে গেল! ছাদে উঠেই দেখি ফুলটা অর্ধেক ঝরে গেছে। পাপড়িগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তবু যেন তাদের সৌন্দর্য হারায়নি। তাদের আগের গোছানো ভাব থেকে এখকার এই অগোছালো ভাব আরও যেনো বেশি সুন্দর।

আমি সুন্দরের বিন্যাস করছি, এমন সময় কোথা থেকে যেনো কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। রাতেও একবার শুনেছিলাম মনে হয়, কিন্তু মনে পড়ছে না। ভেতরের চিন্তাবানু বলে উঠলো, একটি ফুলের শেষ রক্ষা বুঝি আর হলো না।

লেখক পরিচিতি: ছাত্র, উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষ, রংপুর সরকারি সিটি কলেজ

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!