অনলাইন ক্লাস ও ছাদে আন্টির কাপড়

এহেমের আজ পরীক্ষা শেষ হলো। আজকাল পরীক্ষার ধরণ সব অন্যরকম হয়ে গিয়েছে।

জান্নাতুল ফেরদৌস আইভীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 April 2021, 08:46 AM
Updated : 9 April 2021, 08:46 AM

পরীক্ষার জন্য ওকে স্কুলে যাবার আগে অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠতে হয় না, সেই সাত-সকালে মায়ের বকুনি খেতে খেতে নাস্তা শেষ করতে হয় না, আর টিফিন বক্স, পানির ফ্লাস্ক, ইয়া বড় স্কুলের ব্যাগ নিয়ে শামসু চাচার জন্য বড় রাস্তার মোড়ে গিয়ে অপেক্ষা করতে হয় না, মানে মায়ের কাছে বারবার শুনতে হয় না যে স্কুলের গাড়ি চলে যাবে তোমাকে রেখেই, তাড়াতাড়ি করো, জলদি করো এহেম!

এখন বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠলেও এহেম পরীক্ষা দিতে ফোনের সামনে বসার জন্য অনেক সময় পেয়ে যায়। শুধু একটাই অসুবিধা, সেটা হলো ওর পরীক্ষার প্রশ্ন পাঠাতে যদি ম্যাডাম দেরি করেন তাহলে তখন ওর পিশু পেয়ে যায়। কি মুশকিল! তখন ওকে যে কীভাবে সামলাতে হয় তা কেউ চিন্তাই করতে পারবে না।

তবুও এহেম সব ম্যানেজ করে তারপর পরীক্ষা দিতে বসে এবং ওর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সব লেখা শেষ হলে তখন মা এসে ওর খাতার ছবি তুলে ম্যাডামকে পাঠিয়ে দেয়। এই পৃথিবীতে একটা ভাইরাস নাকি সব মানুষের জীবনের জন্য হুমকি হয়ে এসেছে, এজন্য সারা পৃথিবীর সব বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সেই এক বছর আগে। তারপর যখন থেকে এহেম ওর বাবা মায়ের সঙ্গে এই কক্সবাজার এলাকায় এসেছে, এখানের রামু ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের ছাত্র হতে পারলেও এখন পর্যন্ত এভাবেই অনলাইনে স্কুল করছে।

এহেমের একটু বিরক্ত লাগে, কারণ ক্লাসের বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে পারছে না, মাঠে গিয়ে খেলতে পারছে না, টিচারদের সঙ্গে সঙ্গে দলবেঁধে কোরাস করে ছড়া আবৃত্তি করতে পারছে না। শুধু সারাক্ষণ অনলাইনে ক্লাস করে আর একা একা পরীক্ষা দিয়ে সেই খাতার ছবি তুলে টিচারকে পাঠিয়ে দেয়। ওরা যখন গত বছর কক্সবাজারে এসেছিল সেই সময়ে ওরা এহেমের বাবার অফিসের কাছে একটা পাহাড়ি এলাকার বাসায় থাকতো। সেই বাসাটা ছিল বাবার উখিয়া অফিসের খুব কাছে।

এহেমের বাবা যখন দুপুরে খাবারের জন্য বাসায় আসতো তখন এহেমকে ফোন করতো, এক দৌড়ে গিয়ে বাবার অফিসের গেটের কাছে চলে যেত। তারপর বাবার হাত ধরে ধরে খেলতে খেলতে পাহাড়ি রাস্তার মধ্যে দিয়ে বাসায় ফিরতো। কিন্তু দুই মাস হলো ওরা কক্সবাজার শহরের ভেতরে একটা বাসায় চলে এসেছে। এই বাসা থেকে এহেমের বাবার অফিসে যেতে স্কুটিতে করে প্রায় ৪০ মিনিট সময় লাগে। তার মানে হলো এখন ও আর সেই পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে বাবার হাত ধরে নেচে নেচে হাঁটতে পারে না সে।

এখন এহেমের একটাই কাজ, সেটা হলো সারাদিন মায়ের কাজে সহযোগিতা করা। মা যখন রান্না করতে যায় তখন মাকে ফ্রিজ থেকে সব সবজি এগিয়ে দেওয়া, মায়ের রান্না হয়ে গেলে সব খাবার আর প্লেট-গ্লাস টেবিলে নিয়ে আসা, এই সবই এমেহের দায়িত্ব। তবে ও এখন মায়ের সঙ্গে ছাদে গিয়ে কাপড় শুকাতে যায়। আবার বিকেলে মাকে সেই শুকনো কাপড় ছাদ থেকে উঠিয়ে এনে দেয়।

মাঝে মাঝে এহেম একাই ছাদে গিয়ে শুকনো কাপড় নিয়ে আসে। একদিন এহেম দেখলো ওদের পাশের বাসার আন্টি অনেক কাপড় ছাদে শুকাতে দিয়ে অফিসে চলে গিয়েছেন। এহেম খেয়াল করলো যে সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, তবু সেই আন্টি অফিস থেকে ফেরেননি। ওর বেশ চিন্তা হলো, সন্ধ্যায় ছাদের কাপড়ে অনেক মশা বসে, ওই আন্টির কাপড়ে মশা বসলেতো মশার গায়ের সব জীবাণু আন্টির কাপড়ে লেগে যাবে। ওর বেশ দুশ্চিন্তা হতে লাগলো।

এহেম তার মাকে জিজ্ঞেস করলো, আন্টির কাপড়গুলো আমি তুলে আনি মা? মা শুনে বলল যে, যাও আন্টির কাপড়গুলো তুলে নিয়ে আসো। এহেম ছাদে গিয়ে আন্টির কাপড়গুলো একটা একটা করে নিচ্ছে, কিন্তু রাখার জায়গা পাচ্ছে না। ও তখন আবার বাসায় এসে মাকে বলল, আন্টির অনেক কাপড় ছাদে, সেগুলো একসঙ্গে কীভাবে আনবো? মা তখন ওকে বড় একটা গামলা দিলো যেটায় করে ওরা ভেজা কাপড় ছাদে নিয়ে যায়। এহেম সেটা নিয়ে একটা কাপড় তার থেকে নামিয়ে সেটা ভাঁজ করে সেই গামলায় রেখে দেয়, আবার আর একটা কাপড় তার থেকে নামায়।

এভাবে ও সবগুলো কাপড় তার থেকে নামিয়ে ভাঁজ করে ছাদ থেকে নেমে আসে। ওহ, ওকে আবার ছাদের দরজার ছিটকিনি আটকে দিয়ে হবে। ও সেই গামলাটা সিঁড়িতে রেখে ছাদের দরজা আটকে তারপর সেই গামলাটা নিয়ে তিনতলায় নেমে আসে। ও দেখলো তখনও আন্টির বাসায় তালা দেওয়া। তখন সে কাপড়গুলো ওদের বাসায় নিয়ে বসার ঘরের একপাশে যত্ন করে রেখে দেয়।

সেদিন আন্টির ফিরতে অনেক রাত হলো, আন্টির অফিসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছিল নাকি। আন্টি ফিরতে ফিরতে ততক্ষণে ওদের রাতের খাবারের সময় হয়ে গিয়েছে। এহেমের অনেক দুশ্চিন্তা হলো আন্টির জন্য, কেন এতো দেরি হচ্ছে আন্টির? বাবাতো সেই কোন সন্ধ্যায় চলে এসেছে। তাহলে আন্টিদের অফিসের মিটিং কেন এতো লম্বা সময় ধরে চলছে? সেই সময় ও শুনতে পেল পাশের বাসার আন্টি দরজার তালা খুলছেন আর দারোয়ানকে ফোন করে বলছেন, ছাদে আমার কাপড় শুকাতে দেওয়া ছিল, সেগুলো তো একটাও নেই। আন্টি ভাবল সব কাপড় হারিয়ে গিয়েছে।

বাসার ছাদে এহেম

দারোয়ান ফোন ধরা অবস্থায় চলে এসে কথা বলছে, আমিতো সারাক্ষণ নিচে ছিলাম, কেউ কাপড় নিয়ে বের হয়ে যায়নি তো। আপনি আবার গিয়ে খুঁজে দেখেন, হয়তো বাতাসে একদিকে জড়ো হয়ে আছে। তখন এহেমকে সঙ্গে নিয়ে ওর মা এগিয়ে গেল। আন্টিকে মা-ই বলল, ‘আপা, আমার ছেলে আপনার সব কাপড় তুলে এনে আমাদের বাসায় রেখে দিয়েছে, এই নিন।’

আন্টি এত্তো অবাক হলেন যে তিনি কথা হারিয়ে ফেললেন। উনি বললেন, এটা কীভাবে সম্ভব? এহেমতো ছোট্ট একটা মানুষ, ও এত্ত কাপড় কীভাবে তুলে আনলো। এমন লক্ষ্মীছেলে আমি পৃথিবীর কোথাও দেখিনি। এটা শুনে এহেন লজ্জায় গুটিশুটি হয়ে গেল। আন্টি যে কী বলেন, আন্টিতো আমাদের পাশে থাকেন, আন্টিকে দেখে রাখার দায়িত্ব তো এহেমেরই।

যখন পৃথিবী থেকে করোনাভাইরাস চলে যাবে, তখনও এহেম ওই আন্টিকে আর সব আন্টিকে দেখে রাখবে। এটাইতো ছোটদের এখন কাজ, শুধু ক্লাসরুমের বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করা কি ছোটদের দায়িত্ব? বরং এসময়ে সব ছোটবাচ্চাদের উচিত ওদের বাবা-মা আর সব প্রতিবেশী আন্টিদের সহযোগিতা করা।

লেখক পরিচিতি: চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক ও মানবাধিকারকর্মী।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!