আল মাহমুদের শৈশব-কৈশোরের কাহিনি

বই: যেভাবে বেড়ে উঠি, ধরণ: আত্মজৈবনিক উপন্যাস, লেখক: আল মাহমুদ, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, প্রথম প্রকাশ: ১৯৮৬, পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১৬৮, মূল্য: ২২৫ টাকা 

আনিকা তাবাসসুম রিশাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 March 2021, 02:55 AM
Updated : 19 March 2021, 02:55 AM

মানুষ শৈশব, কৈশোর, যৌবন পেরিয়ে পূর্ণাঙ্গ মানুষে পরিণত হয়। তার সেইসব মুহূর্তগুলোকে ঘিরে রচিত হয় নানা স্মৃতি বিজড়িত গল্প। জীবনের এই গল্প কখনো হয় গভীর দুঃখবোধ, কখনো বা অনাবিল আনন্দ। উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে জীবন চলতে থাকে জীবনের মত করে।

জীবনের এই নানা রঙের গল্পগুলো নিয়ে রচিত আত্মজীবনীমূলক একটি বই ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’। এটি কোন সাধারণ মানুষের জীবনী নয়। এটি সেই অসাধারণ মানুষের জীবনী, যিনি ছিলেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম একজন কবি যার কলমের ছোঁয়ায় কবিতায় এসেছে নতুনত্ব, সাহিত্য হয়েছে সমৃদ্ধ, সহজ-সরল, সুবোধ্য  ছিল যার ভাষাশৈলী। তিনি হলেন কবি আল মাহমুদ।

এক অসাধারণ কবি প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন আল মাহমুদ। ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোড়াইলে মোল্লাবাড়িতে প্রপিতামহ মুনশী নোয়াব আলীর বাড়িতে এই মানুষটির জন্ম। তার পিতার নাম আবদুর রব ও মাতার নাম রওশন আরা মীর। পিতা-মাতার বড় সন্তান তিনি। মূল নাম ছিল মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ, ডাক নাম ‘পিয়ারু’।

‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ মূলত একটি আত্মজৈবনিক উপন্যাস। উপন্যাসে মানুষের জীবন-যাপনের একটি সামগ্রিক চিত্র ফুটে ওঠে। কাহিনির বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে অনেক রকম চরিত্র সামনে আসে এবং চরিত্রগুলোর মধ্যে থাকে যোগসূত্র। আর পাঠকের মনে অনায়াসে গেঁথে যায় সেই চরিত্রগুলো। এই বইটিতেও ঠিক উপন্যাসের মতই এ বিষয়গুলো ফুটে উঠেছে। পড়ার সময় মনে হয়েছে দারুণ এক উপন্যাস পড়ছি।

আল মাহমুদ তার এই জীবন উপন্যাসের নায়ক আর তাকে ঘিরে একেক সময় একেক রোমাঞ্চকর ঘটনা সামনে আসছিল। দারুণ এক গদ্যে জীবনের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোকে তিনি স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তার লেখার ধারাবাহিকতা  এতোটাই প্রাঞ্জল যে মোল্লাবাড়িতে জন্ম নেওয়া সেই ছোট্ট পিয়ারুর তার শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পদার্পণ করার দৃশ্যগুলো এবং এই পুরো সময়ে জীবনের পরিবর্তনগুলো যেন পাঠক মনের দৃষ্টি দিয়েই অবলোকন করতে পারবে। এই বইটি শুধু কবির শৈশব-কৈশোর কিংবা তার পারিবারিক অবস্থাকেই উপস্থাপন করেনি, বরং বইটিতে প্রকাশ পেয়েছে সেই সময়কার মানুষের জীবন-যাপনের চিত্র।

কবির পূর্বপুরুষেরা এদেশে এসেছিল ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে। তারপর এখানেই স্থায়ী হয়ে বসবাস শুরু করেন। তার পরিবার ছিল ধর্মপরায়ণ এবং একই সঙ্গে সংস্কৃতিমনা। তার বাবা নিয়মিত সংগীতচর্চা করতেন। দাদা ছিলেন একজন কবি, জারি গান লিখতেন। সেই সঙ্গে লাঠি এবং তরবারি খেলায় বেশ পারদর্শী ছিলেন। মহরমের সময় তার দাদার নেতৃত্বে বাড়িতে চলতো এক জমজমাট লাঠি খেলার উৎসব, সবচেয়ে বেশি জমে উঠতো রাম-দায়ের খেলা। টানটান উত্তেজনায় সবাই গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখতো সে খেলা। পুঁথিগান, মর্সিয়া এসবও শোনা হতো আয়োজন করে।

সবার আদরের মধ্য দিয়ে বড় হতে লাগলো আল মাহমুদ। তার দাদি তাকে খুব আদর করতেন। দাদির সঙ্গেই বেশি সময় কাটতো তার। আল মাহমুদ তার লেখায় উল্লেখ করেছেন, শৈশবের কোন স্মৃতি যদি থেকে থাকে সেটা হলো তার দাদির পবিত্র মুখাবয়ব। তার দাদির মৃত্যুর পর তিনি আকাশে ডানা মেলে ওড়বার মত স্বাধীনতা পেয়ে গেলেন, এতোদিন অধিক স্নেহ মমতায় যা সম্ভব হয়নি। এই সময় বাড়ির গৃহপরিচারিকা আলকি তার জীবনে বেশ স্মৃতিময় প্রভাব ফেললো। আলকির সঙ্গে লজেনচুজ খাবার শৈশব তিনি বেশ উপভোগ করতে লাগলেন। কিন্তু হঠাৎ একদিন আলকি তার জীবন থেকে হারিয়ে যায়। এই বেদনা তাকে পরবর্তী জীবনেও বেশ নাড়া দেয়। কবির বৃদ্ধ বয়সেও যেন তিনি শৈশবের সেই ধাত্রী, সঙ্গিনী, শিক্ষয়িত্রীকে খুঁজে বেড়াতেন।

বাড়িতে অক্ষরজ্ঞান এবং নিজস্ব মসজিদে আরবি শিক্ষা গ্রহণ করলেও আল মাহমুদের শিক্ষা জীবন শুরু হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এম.ই স্কুলে ভর্তির মধ্য দিয়ে। কিন্তু এই স্কুলের পরিবেশ, বেশির ভাগ মুসলমান ছাত্রদের প্রতি আচরণ তাকে সাম্প্রদায়িক করে তুললো। ফলে পড়ালেখার প্রতি মনোনিবেশ তিনি সেভাবে করতে পারলেন না। মারামারি এবং স্কুল কামাই দিয়ে বাইরের আড্ডাই তখন বেশি চলতে লাগলো তার।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে মানুষের জীবন যাত্রা পাল্টে যেতে লাগলো। তার বাবার কাপড়ের ব্যবসাটি বন্ধ হয়ে গেল। তিনি যোগ দিলেন বেঙ্গল ফায়ার সার্ভিসে। ট্রেনিং এর জন্য তাকে বাড়ি ছাড়তে হলো। আর এই সুযোগেই যেন আল মাহমুদ পেয়ে গেলেন অবাধ স্বাধীনতা। তিনি নতুন একটি বিষয়ের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। নেশার মত পেয়ে বসলেন রোমাঞ্চকর বই পড়ার অভ্যাস, আর ছুটির দিনে গুলতি দিয়ে পাখি শিকারের শখ। বই পড়ার অভ্যাস থেকেই তিনি বাংলা ভাষার প্রতি গভীর টান অনুভব করতে লাগলেন।

এম.ই স্কুলের পাঠ চুকিয়ে ভর্তি হলেন জর্জ হাইস্কুলে। তিনি যত বড় হতে লাগলেন ততই বাইরের জগতের সঙ্গে তার বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হতে লাগলো। সারাদিন গল্পের বই নিয়ে মগ্ন হয়ে পড়ে রইতেন। এই বই এর সঙ্গে গড়ে উঠলো তার বন্ধুত্বতা। তবে বই এর বদৌলতে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল, যারা সবাই ছিলেন তার অসমবয়সী।

একবার তার পরিচয় হলো দুই নারীর সঙ্গে, যারা পরস্পর বোন ছিলেন। তাদের একজনের নাম ছিল শোভা। কৈশোরের অনেকটা সময় এই নারীর সঙ্গে আল মাহমুদের অনেক স্মৃতি জমেছিল। তাদের দু'বোনের মাধ্যমে আল মাহমুদ প্রবেশ করলেন নতুন এক জগতে। সন্ধান পেলেন অনেক বই এর এবং একটি ছোট পাঠাগারের। পাঠাগারটির নাম ছিল ‘লালমোহন পাঠাগার’। শহরের অনেক উদীয়মান লেখক এবং সংগীত প্রতিভার সঙ্গে তার এই লালমোহন পাঠাগারই পরিচয় হয়। এই পাঠাগারের মাধ্যমেই তিনি রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন, মার্কসীয় চিন্তা-ভাবনা তিনি অন্তরে লালন করতে লাগলেন।

আল মাহমুদ এতো বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠলেন যে তার মা তার বাবার কাছে ছেলের বিষয়ে অভিযোগ করলেন। কিন্তু আল মাহমুদের পিতার তার প্রতি গভীর বিশ্বাস ছিল যে আল মাহমুদ বিপদগামী হবেন না। এই সময়ে শোভার সঙ্গেও তার সখ্যতা দিন দিন বাড়তে লাগলো। পরবর্তীতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, তার কবি প্রতিভা বিকশিত হবার পেছনে এই নারীর কোন না কোনভাবে ভূমিকা ছিল।

একসময় আল মাহমুদের পরিচয় হলো জীবনানন্দ দাশের কবিতার সঙ্গে। তার এক বন্ধু তাকে জীবনানন্দ দাশের কবিতার বই ‘মহাপৃথিবী’ উপহার দিয়েছিলেন। তিনি জীবনানন্দ দাশে এতো বেশি বিভোর হয়েছিলেন যে কয়েকবার বইটি পড়লেন। আর তখনই তিনি অনুভব করলেন তিনিওতো লিখতে পারেন। এরকম শব্দ তার মস্তিষ্কেও খেলা করে এবং সেই থেকে শুরু হলো তার কবিতা লেখার সূচনা। তার এই কবি প্রতিভা যতই বিকশিত হচ্ছিলো ততই শোভার সঙ্গে তার বন্ধুত্বে দূরত্ব সৃষ্টি হতে লাগলো। এভাবেই একসময় শোভার সঙ্গে তার যোগাযোগ চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন আল মাহমুদের জীবনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছিল। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে লাগলেন। এরই জের ধরে পুলিশি ঝামেলার মধ্যে পড়লেন। তখন চুরি-কারবারির সঙ্গে জড়িত এক পরিচিত মামার সঙ্গে গেলেন কলকাতা। সেখানে দেখা হলো আরেক পরিচিত ব্যক্তির। তিনি যে মামার সঙ্গে কলকাতা গিয়েছিলেন উনাকে নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলেন। বড় কোন ঝামেলায় পড়বেন বলে আশঙ্কা করেছিলেন। কিন্তু কলকাতার সেই পরিচিত ব্যক্তি তাকে উদ্ধার করলো বলা যায়।

কিছুদিন পর বাসায় ফিরে দেখলেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক। এরপর পড়াশোনার জন্য তাকে তার চাচা-চাচীর সঙ্গে জগৎপুরে পাঠানো হয়। সেখানে যেন তিনি এক অন্য রকম জীবনের সন্ধান পান। স্কুল, বই সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গ্রামীণ সৌন্দর্যকে গভীরভাবে উপভোগ করতে লাগলেন। গ্রাম্য জীবন-ব্যবস্থা তাকে মুগ্ধ করে তুললো। তিনি এতো বেশি স্বাধীনচেতা হয়ে গেলেন যে, এটি একসময় তার চাচীর সঙ্গে মনোমালিন্য সৃষ্টি করলো।

জগৎপুর থেকে তিনি আবার নিজ বাস ভবনে ফিরে এলেন। সময়টা তখন তার ভালো কাটছিল না। এই সময় তার এক ফুপুর সঙ্গে তেলিয়াপাড়া চা বাগান দেখবার সুযোগ পান তিনি। সেখানে তিনি এমন এক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, পরবর্তীতে তিনি কোনদিনও সেই ঘটনা ভুলতে পারেননি। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতায় সেখানে আর অবস্থান না করে আবারও চলে যান তার চাচা-চাচীর কাছে, সীতাকুণ্ডে। তার চাচী তাকে অনেক বেশি ভালোবাসতেন, তাই আগের মনোমালিন্য তাদের মধ্যে  প্রভাব ফেলেনি। কিন্তু সীতাকুণ্ডেও তিনি বেশিদিন থাকতে পারলেন না। এক ঘটনার জেরে আবারো তার চাচীর সঙ্গে মনোমালিন্য হয়। এবার তিনি সব আত্মীয়তা ও মানুষের ওপর তার নির্ভরতা ছেড়ে ঢাকাগামী মেল ট্রেন ধরে চিরকালের জন্য চললেন নিরুদ্দেশে! আর সেই সঙ্গে শেষ হয়ে যায় প্রতিভাবান এই কবির বেড়ে উঠার গল্প।

আল মাহমুদ শুধু কবিই ছিলেন না, তিনি ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিকও ছিলেন। তবে কাব্যজগতে তার বিচরণ ছিল সমৃদ্ধশীল। আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করতে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।

প্রায় সব মানুষরেই জানতে ইচ্ছে করে বিখ্যাত মানুষগুলোর জীবন কেমন ছিল, কী ছিল তাদের জীবনের গল্প, তাদের জীবন-যাপন কি সবার মত স্বাভাবিক ছিল নাকি কোন স্বর্গসুখ নিয়ে জীবন-যাপন করতো তারা! আর জনপ্রিয় কবি আল মাহমুদ তার জীবনের গল্পগুলোকে এই বই এর মাধ্যমে পাঠকদের জানবার সুযোগ করে দিয়েছেন। এই বইয়ের পরতে পরতে রয়েছে আবেগ, ভালোবাসা, স্মৃতি জর্জরিত এক শৈশব কথন। প্রজাপতির মত উজ্জ্বল ডানা মেলে উড়বার মত এক কিশোরের গল্প।

কবির ছেলেবেলার সঙ্গে সঙ্গে পাঠক অবগত হতে পারবে সেই সময়কার পরিস্থিতি, রীতি- রেওয়াজ সম্পর্কে। শুধু এটিই নয়! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন তখন মানুষের জীবনে কেমন প্রভাব ফেলেছিল, কী বৈচিত্র্য এসেছিল এর ফলে সেটিও সুন্দরভাবে অনুধাবন করা যায়।

আত্মজীবনী যদি এতো মনোমুগ্ধ হয় তাহলে তা পড়ায় কারও ক্লান্তি আসবার কথা নয়। এখানেই আল মাহমুদের সার্থকতা। তিনি তার এই জীবনের গল্পগুলোকে এতো সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন যে পাঠকের কাছে এটি হয়ে উঠবে অনবদ্য। এটুকু নিশ্চিত করে বলতে পারি পাঠকরা এই বই পড়ে নিরাশ হবে না।

বইটি প্রকাশ করেছে ‘প্রথমা’ প্রকাশন। এছাড়া ‘ঐতিহ্য’ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত আল মাহমুদ সমগ্রের প্রথম পর্বের প্রথমেই রয়েছে কবি রচিত অসাধারণ আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’।

লেখক পরিচিতি: শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!