হুমায়ুন আজাদের কৈশোর ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’

বই: ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, লেখক: হুমায়ুন আজাদ, প্রকাশক: আগামী প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ: ১৯৮৫, প্রচ্ছদ: সমর মজুমদার, অলঙ্করণ: রফিকুন নবী, পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৫৬, মূল্য: ১৫০ টাকা

মো. ইয়াকুব আলীমো. ইয়াকুব আলী
Published : 15 March 2021, 10:16 AM
Updated : 15 March 2021, 10:16 AM

হুমায়ুন আজাদের ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ বইটার রিভিউ পড়ে অনলাইনে খুঁজে একটা পিডিএফ কপি পেয়ে গেলাম। অফিসের কাজ সেদিনকার মতো মাথায় উঠলো। দুটো মনিটরের ছোটটাতে ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ খোলা রেখে অন্যটাতে কাজের ভান করলাম। কিন্তু আমার মন পড়ে রইলো বইটার পাতায়।

একদিনেই শেষ করে ফেললাম। বহুদিন বাদে একটা বই এক বসাতেই শেষ হলো। অবশ্য বইয়ের আকার ছোট সেটাও একটা কারণ, কিন্তু মূল কারণ হচ্ছে লেখকের শৈশব-কৈশোরের দিনগুলোর সঙ্গে আমার নিজের শৈশব-কৈশোরের দিনগুলোর অদ্ভুত মিল। আমাদের প্রজন্ম লেখকের শৈশব-কৈশোরের কিছুটা হলেও ছোঁয়া পেয়েছিলাম, বিশেষ করে আমরা যারা একেবারে অজ-পাড়াগাঁয়ে বেড়ে উঠেছিলাম।

‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ পাঠককে আবারও তার শৈশবের দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে নিশ্চিত। বইটাতে আছে সতেরটি অনুচ্ছেদ। প্রত্যেক অনুচ্ছেদেই গ্রাম-বাংলার বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এক একটা বিষয় উঠে এসেছে আর লেখকের প্রাঞ্জল বর্ণনায় সেটা হয়ে উঠেছে জীবন্ত। লেখকের বর্ণনার সবচেয়ে উপভোগ্য দিক হচ্ছে বিশেষণ ব্যবহার। গ্রামের প্রত্যেকটা সৌন্দর্যকে এক একটা বিষয়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে যেটা কিছুক্ষণের জন্য হলেও পাঠককে ভাবাবে। আর স্থানীয় শব্দগুলোর প্রয়োগ সেখানে দিয়েছে অন্য মাত্রা যাতে করে সহজেই তখনকার দিনের জীবনযাত্রার ধরণ টের পাওয়া যায়।

বইটা শুরু হয়েছে লেখকের বড় মেয়ে মৌলি আজাদকে উদ্দেশ্য করে। আমার ধারণা লেখক ইচ্ছা করেই এটা করেছেন, অবশ্য এরপর কারণটাও বলে দিচ্ছেন। লেখকের ভাষায় – “মৌলি, তোমাকে বলি, তোমার মতোই আমি একসময় ছিলাম – ছোট। ছিলাম গ্রামে, গাঁয়ে, যেখানে মেঘ নামে সবুজ হয়ে নীল হয়ে লম্বা হয়ে বাঁকা হয়ে। শাপলা ফোটে; আর রাতে চাঁদ ওঠে শাদা বেলুনের মতো।”

এর কিছুক্ষণ পর স্বগতোক্তির মতো বলে চলেছেন – “তুমি দেখোনি আকাশে কী করে মেঘ জমে, আহ্লাদে কতোটা রঙিন হতে পারে ডালিম ফুল। কেমনে পুকুরের আকাশে ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বল করে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছরাঙা। তার লাল তলোয়ারের মতো ঠোঁট ঢুকে যায় পাবদার লাল হৃৎপিণ্ডে। তুমি তা দেখোনি।”

মৌলির যেহেতু জন্ম হয়েছে শহরে তাই লেখক তাকে তার গ্রামের গল্প বলতে চাচ্ছেন। শহরে ঠিক কী কী জিনিসের অভাব সেটা বলতে গিয়ে লিখেছেন – “শহরে কি চাঁদ ওঠে? কুয়াশা নামতে দেখিনি দুধের সরের মতো, পদ্মার পারে দেখিনি ধবধবে কাশফুলের শাদা মেঘ। কতো দিন দেখিনি ধানের গুচ্ছ, তারার গুচ্ছের মতো।”

পুরো বইটা জুড়ে গ্রাম-বাংলার প্রকৃতি থেকে শুরু করে জীবনপ্রণালী, অর্থনীতি, সামাজিকতা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, গ্রামের মানুষদের অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে লেখকের বর্ণনায়। আর বইটা শেষ হয়েছে গ্রামের কীভাবে মৃত্যু হয় তার বর্ণনা দিয়ে, আর একেবারে শেষে লেখক বলে গেছেন তার অনুভূতির কথা। এখনও কীভাবে তিনি তার শৈশবের গ্রামটাকে নিজের অন্তরে লালন করে চলেছেন সেটার বর্ণনা পাঠককে মুগ্ধ করবে। আর সবশেষে আকুতি প্রকাশ করেছেন বারবার উনার গ্রাম রাড়িখালের কাছে ফিরে যাওয়ার।

পুরো বইটা পড়তে আপনার কখনই একঘেঁয়ে লাগবে না। শুরুতে আছে লেখকের বাড়ির বর্ণনা। লেখকদের বাড়িটি ছিলো পুকুর দিয়ে ঘেরা। তার পায়ের নিচে সারাক্ষণ ঝুমঝুম করে বাজে পানির নুপুর। পুকুরের কচুরিপানার ফুল যেনো ঝাড়বাতি। পুকুরে যেমন ছিলো কচুরিফুলের দীপাবলি তেমনি ডাঙ্গায় ছিলো ঢলঢল কাঁচা লাউডগার স্বপ্ন। বাড়ির পাশেই আড়িয়াল বিলের উঁচু ভিটেতে চাষ করা হতো মরিচ, লাউ, কুমড়ো, টমেটো। সবই সবুজ, সবই ফুল ফোটায় আর ফল ধরে; কিন্তু তাদের কোনটি স্বপ্ন দেখে আকাশের, কোনটি দিগন্তের, কোনটি আপন শেকড়ের। সব গাছই তো স্বপ্ন দেখে আকাশের, কিন্তু লাউডগা স্বপ্ন দেখে দিগন্তের। ঠিক এভাবেই বর্ণনা দেওয়া হয়েছে সবুজ উদ্ভিদগুলোর। পড়লে মনে হবে তারা যেন কোন উদ্ভিদ না, তারা যেন এক একটা জীবন্ত মানুষ।

হুমায়ুন আজাদ গ্রামের মানুষগুলোকে মোট তিন শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। প্রথম রকম হচ্ছে ধনী মানুষেরা। তারা দেখতে বেশ সুন্দর, তাদের ছেলেমেয়েরা সুন্দর, তাদের লুঙ্গি সুন্দর, জামা সুন্দর। তারা কোন কাজই করে না, গ্রাম শাসন করে। এরা কখনই ক্ষেতে গিয়ে ধান বোনে না, মাছ ধরে না। তারা কাউকে সালামও দেয় না, অন্যরা শুধু সালাম দেয় তাদের। সুন্দর সুন্দর জামা পরে তারা দশটার দিকে চাকর নিয়ে বাজারে যায়। সড়কের মসৃণ জায়গা দিয়ে হাঁটে তারা, আর পথে পথে সালাম পায়।

দ্বিতীয় রকমের মানুষেরা হচ্ছে তারা যারা ধনী মানুষদের পেছনে পেছনে হাঁটে। গ্রামের লোকেরা এদেরও ভয় করে খুব; কেননা এরা নানা বিপদে ফেলে দেয় সরল মানুষদের।

তৃতীয় শ্রেণির মানুষ হচ্ছে গরীব মানুষ যারা সারাদিন শুধু কাজ করে। গরু নিয়ে মাঠে যায়, ধান বোনে, ঠান্ডা পানিতে নেমে মাছ ধরে, মাথায় করে ঘাস নিয়ে আসে। তারা মানুষের সঙ্গে যতোটুকু কথা বলে তার চেয়ে বেশি কথা বলে গরু বাছুর ও মাঠের ধান ঘাস সবজির সঙ্গে। এ যেন হাজার বছরের গ্রাম বাংলার মানুষের জীবনাচারের প্রতিচ্ছবি।

আবহমান গ্রাম-বাংলায় একটা সময় পুকুরভর্তি মাছ ছিলো, কারণ তখন পর্যন্ত ক্ষেতে সেইভাবে কীটনাশকের ব্যবহার শুরু হয়নি। লেখকদের বাড়ির পাশের পুকুরগুলোতেও বছরের একটা সময় সারা গ্রামের লোকজন মাছ ধরতে নামতো বিভিন্ন প্রকারের যন্ত্র দিয়ে। কেউ বা পলো দিয়ে, কেউ বা বড়শি দিয়ে, কেউ বা টেটা দিয়ে আর অনেকেই খালি হাতে মাছ ধরতো। দিনশেষে সবাই অনেক মাছ নিয়ে নিজ নিজ বাসায় ফিরে যেতো, কারণ মাছের সংখ্যা ছিলো অনেক। মাছ ধরার পর পুকুরের পানি ঘোলা হয়ে যায়। তখনকার পুকুরের অবস্থা বর্ণনা করতে যেয়ে লেখক বলেছেন, ‘যখন আমি এ-শহরে, শহরকে আমার অনেক সময় ঘোলাজলের পুকুর বলেই মনে হয়, কাউকে ঘুরতে দেখি একা একা - বিষণ্ণ, মলিন উস্কোখুস্কো, তখনি মনে পড়ে মানুষ নামার পরে পুকুরের ঘোলাজলের ভাসমান জীর্ণ কচুরিপানাগুলোকে। এমন কচুরিপানা-মানুষ দেখেছিলাম আমি একাত্তরে সাতাশে মার্চে।’ এভাবেই লেখক শহরের মানুষদের শেকড়হীনতাকে কচুরিপানার রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।

এরপরই এসেছে গ্রামের টিনের চালের বৃষ্টির শব্দের কথা। বৃষ্টির মধ্যে চালের উপর ডানা ঝাপটায় গাছ তখন স্বপ্নের মতো নিবিড় হয়ে উঠে দশদিক। এছাড়া শহর আর গ্রামের বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক গ্রামকে তুলনা করেছেন ঘুমের সঙ্গে, শহরকে তুলনা করেছেন জেগে থাকার সঙ্গে। গ্রামের খেলাধুলার উপকরণগুলো সংগ্রহ করা হয় আশপাশের পরিবেশ থেকে। একটা সাধারণ জিনিস কারো হাতের ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে বদলে হয়ে উঠতো অনন্য সাধারণ খেলনা। লেখকের হোসেন মিয়াভাই সামান্য খেজুরের ডাল কেটে সুন্দর ঘোড়া বানিয়ে দিতেন আর লেখক সেই ঘোড়ায় চড়ে সারাদিন টগবগ টগবগ করে সারা বাড়িময় ঘুরে বেড়াতেন। 

জীবিত মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে ক্ষুধা। সেটাও উঠে এসেছে এ বইয়ে। লেখকের ভাষায়, ‘ভাত ভাত ভাত - চারদিকে শুনেছি - ভাত ভাত ভাত। এইতো বাঙলার চিরকালের পাখির গান, নদীর গান। বনের গান, রাখালের গান, চাষীর গান, বাউলের গান। গ্রামের গান, শহরের গান। সবুজ চারাগাছের মতো কিশোরের গান, পাতাঝরা শুকনো গাছের পাতার মতো বুড়োর গান - ভাত ভাত ভাত।’

লেখকের কাছে ভাতের আলাদা কোন স্বাদ না থাকলেও উনাদের বাড়ির কাজের ছেলের মতে- ‘ভাত খাইতে লাগে মদুর মতন।’ অভাবী মানুষদের কাছে ভাতের বিকল্প হচ্ছে ভাতের মাড় বা ফ্যান। ভাত রান্না করা পাতিলের তলায় কালি জমে কালো হয়ে যাওয়ায় ফ্যানকে অনেকেই বলতেন ‘কালা গাইর দুদ’। এই ‘কালা গাইর দুদ’ গ্রামের অনেক অভাবী মানুষের প্রাণ বাঁচায়।

লেখকের নানাবাড়ি কামারগাঁয়ের দক্ষিণ দিক দিয়ে বয়ে গেছে প্রমত্ত পদ্মা। পদ্মার ইলিশের স্বাদ গন্ধ নিয়ে আবহমান গ্রাম বাংলায় এখনও কিছু গল্প প্রচলিত আছে যেগুলো আমরাও আমাদের শৈশবে বড়দের কাছ থেকে শুনেছিলাম। ইলিশ মাছের পিঠের দিকের অংশটা হরিণের মাংস আর পেটের দিকের অংশটা ইলিশ মাছের নিজের মাংস। একবার প্রতিযোগিতা করে ইলিশ মাছের কাছে হেরে গিয়ে হরিণ তার শরীরের মাংস কেটে দিয়েছিলো বাজির শর্ত মোতাবেক। এছাড়া ইলিশের মৌসুমে মাছ ধরার উৎসবের বর্ণনা এসেছে। লেখক একবার মাছ ধরতে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। ইলিশ মাছ পানি থেকে তোলার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মারা যায়। এতো সুন্দর ইলিশ মাছ কেন এতো তাড়াতাড়ি মারা যায় সেটা নিয়ে লেখকের শিশুমনে মনে প্রশ্ন তৈরি হয়।

আবহমান গ্রাম-বাংলায় এখনও পুরনো আমলের অনেক জমিদার বা কোন বনেদি বংশের বাড়িঘর দেখা যায়। লেখকদের গ্রামেও এমন একটা বাড়ি ছিলো। লেখক তার শৈশবের ‘বুক অব নলেজ’ থেকে জেনেছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শহর প্যারিস। তারপর থেকে লেখকের কল্পনায় ভাসতো প্যারিস শহর। গ্রামের বিলের ধারেই ছিলো একটা মস্ত সুন্দর বাড়ি লেখক যেটাকে প্যারিস শহরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এছাড়া একটা বাড়ির প্রবেশপথের পাশেই মর্মর পাথরে খোদাই করা ছিলো একটা শোকের কবিতা ‘দাঁড়াও পথিকবর’। এ কবিতাটা দেখলে লেখকের মন দুপুরের মতো উদাস হয়ে যেতো।

এছাড়া লেখকদের গ্রামে ছিলো স্যার আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর জন্মভিটা। গ্রামে উনাকে নিয়ে প্রচলিত ছিলো অনেক গল্প। উনিই প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন রেডিও। উনার রেডিও আবিষ্কারকে নিজের বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন মার্কনি। আসলেই গ্রাম-বাংলায় এখনও অনেক গল্প প্রচলিত আছে স্থানীয় বিখ্যাত ব্যক্তিদের নিয়ে। আর লেখকের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামও ছিলো ‘স্যার জে সি বোস ইনস্টিটিউশন’।

গ্রাম-বাংলায় একসময় প্রতি বছর মেলা বসতো। সেই মেলায় থাকতো সার্কাস, যাত্রা আর বিভিন্ন রকমের মনকাড়া বাহারি পণ্যের দোকান। হাওয়ায় মিঠাই ছিলো একটা অবাক করা খাবার। ইয়াব্বড় একটা গোলা মুখের মধ্যে দিলেই গলে যেতো। সার্কাসে দেখানো হতো হৃদয়ে কাঁপন ধরানো সব খেলা। আর সবার মন যুগিয়ে চলতো সার্কাসের জোকার। তার কার্যক্রম সার্কাসের বিপদজনক সব খেলাকে করে তুলতো আরও বেশি উপভোগ্য। সার্কাসের এসব বিপদজনক খেলা দেখাতে গিয়ে অনেক মানুষই সেই খেলার হাতে বেঘোরে প্রাণ দিতো। এমন গল্পই প্রচলিত ছিলো মানুষের মুখে মুখে, তবু বংশ পরম্পরায় সেই খেলাগুলো চালিয়ে নিতো বংশের কেউ। আর যাত্রা প্যান্ডেলে যাত্রা দেখা এক দারুণ অভিজ্ঞতা। যাত্রার কর্মীদের পোশাক মেকআপ হতো খুবই চাকচিক্যময়। আর তাদের উচ্চারণের ভিন্নতার কারণে সংলাপগুলো সবার মুখস্থ হয়ে যেতো এমনিতেই। আর এ মেলা উপলক্ষে লেখকের নানির বাড়ি যাওয়া হতো। লেখকের মামি লেখককে দেখেই উল্লসিত হয়ে ডাকতেন ‘আমার বাজান আইছে’। এরপর শুরু হতো গ্রাম-বাংলার সেই বিখ্যাত মামাবাড়ির আপ্যায়ন যার কথা বাংলাদেশের কবিতায় বলা হয় ‘মামি দিলো দুধভাত পেটভরে খাই, মামা এলো লাঠি নিয়ে পালাই পালাই’।

এরপর এসেছে লেখকের মনে সুখ আর শোকের অনুভূতি তৈরির কথা। কবিতা লেখকের বরাবরই ভালো লাগতো। কীভাবে লাইনের শেষে শব্দগুলো একই ছন্দে মিলে যাচ্ছে সেটা ছিলো এক বিরাট বিস্ময়। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যে কে বড় সেটা নিয়ে চলতো অবিরাম তর্ক। সেই তর্কের একটা দুর্দান্ত সমাধান দিয়েছিলেন লেখকের ক্লাসের এক স্যার। উনি বলেছিলেন, ‘এখন মনে হবে কাজী নজরুল ইসলাম বড়ো কবি, বয়স বাড়লে মনে হবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বড়ো কবি’।

লেখকের পাঠ করা প্রথম শোকের কবিতার নাম ছিলো ‘কাজলা দিদি’, কবির নাম যতীন্দ্রমোহন বাগচী। এ কবিতায় বর্ণনা করা প্রকৃতির সঙ্গে গ্রাম বাংলার প্রত্যেক গ্রামের প্রকৃতি মিলে যায়। আর কাজলা দিদি যে আর বেঁচে নেই সেটা শিশুমনে গাঢ় ক্ষত তৈরি করে। আর দ্বিতীয় কবিতার নাম ছিলো ‘ছিন্ন মুকুল’, কবির নাম সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। কবিতার শুরুতেই বলা হচ্ছে- ‘সবচেয়ে যে ছোট্ট পিড়িখানি, সেইখানি আর কেউ রাখে না পেতে’, কারণ সেই পিড়িতে যে বসতো সে আর এ পৃথিবীতে নেই। ‘ছিন্ন মুকুল’ কবিতার বিষয়বস্তু লেখকের জীবনে আসে নির্মম বাস্তবতা হয়ে। গ্রাম-বাংলায় একসময় কলেরায় বহু মানুষ মারা যেতো। বলা হতো কলেরার বাহক ‘ওলা বিবি’ পদ্মার পাড় দিয়ে আঁচল ছেড়ে দিয়ে নাচতে নাচতে যাচ্ছেন আর গ্রামের পর গ্রাম কলেরায় আক্রান্ত হচ্ছে। লেখকদের গ্রামে সাধারণত কলেরা দেখা দেয়নি, কিন্তু সেবার কলেরা দেখা দিলো। হঠাৎ মাঝরাত্রে লেখকের ছোট ভাই সাড়ে তিন বছরের আবুল কালাম আজাদ আক্রান্ত হলো। আবুল কালাম আজাদ অনেক কথা বলতো। সে বলতে লাগলো সে মরবে না বেঁচে যাবে। বড় ডাক্তার নিয়ে আসলেই সে বেঁচে যাবে। লেখক সেই মাঝরাত্রেই ডাক্তার আনতে যেতে চাইলো, কিন্তু লেখকের বাবা রাজি না হওয়ায় আর সে যাত্রা সফল হলো না। সকালে লেখকের বাবা ডাক্তার আনতে বেরিয়ে গেলেন। উনি যখন হোমিওপ্যাথি ডাক্তারকে নিয়ে ফিরলেন তখন আবুল কালাম আজাদ মারা গেছেন। লেখক বলছেন ঠিক সময়ে ডাক্তার না ডাকার কারণে তিনি তার বাবাকে আর ক্ষমা করেননি বাকি জীবন। এরপর আবুল কালাম আজাদের নামের শেষের অংশ লেখক তার নামের সঙ্গে জুড়ে নেন।

এরপর এসেছে গ্রামের মৃত্যুর প্রসঙ্গ। গ্রামের মৃত্যু হয় কীভাবে? লেখকের ভাষায় গ্রামে যখন বিদ্যুৎ আর ভাঙা জিপ আসলো তখন থেকেই গ্রামের মৃত্যুর প্রক্রিয়া শুরু হলো। লেখকের ভাষায় ‘ভাঙা জিপে চড়ে বসেছে আমাদের গ্রাম। সারাদেশ। আর বারবার মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছে এখানে সেখানে।... রাড়িখাল এখন জড়িয়ে গেছে ছেঁড়া বিদ্যুতের তারে। আমাদের শহরগুলো কোনদিন শহর হবে না। হবে বস্তি। আমাদের গ্রামগুলো আর গ্রাম থাকবে না। হয়ে উঠবে বস্তি।’

লেখক আক্ষেপ করে আরও বলছেন, ‘গ্রাম মরে যাচ্ছে। পুকুর মরে যাচ্ছে। পদ্মা মরে যাচ্ছে। ধানক্ষেত মরে যাচ্ছে। শুধু ভাঙা জিপের শব্দ উঠছে। ছেঁড়া তার জড়িয়ে ধরছে। ভাঙা জিপে চড়ে রাস্তার পাশে মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে রাড়িখাল।...চারদিকে শুধু পাগলের করতাল।’

পরিশেষে রয়েছে লেখকের শৈশবের গ্রাম রাড়িখালের জন্য লেখকের ভালোবাসার প্রকাশ। লেখকের ভাষায়, ‘আমি আছিলাম পোনর বচ্ছর ছয় মাস তোমার ভিৎরে। থাকুম পোনরশ বচ্ছর। আমার যে মন পোড়ে। আমার যে মন পোড়ে কালো কাউয়ার লিগা, কইতরের বাচ্চার লিগা, বাইগন গাছের লিগা, ঘাডের পানির লিগা।’

লেখক তার আবেগকে প্রকাশ করতে গিয়ে ব্যাকরণ-শুদ্ধ ভাষার ব্যবহার না করে একেবারে রাড়িখালের স্থানীয় কথ্যভাষা ব্যবহার করেছেন সচেতনভাবেই যাতে করে আবেগটা ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। লেখক অনেক বড় হয়ে যাওয়ার পরও রাড়িখালের দিনগুলো ভেবে সময় পার করেন আর প্রতিনিয়ত তার বুকের মধ্যে রাড়িখালের জন্য ভালোবাসা বাড়তে থাকে। লেখকের ভাষায়, ‘রারিকাল। রারিকাল। আমি কত ডাক পারি। তুমি ক্যান হুমইর দ্যাও না।’

বাংলা ভাষাভাষী যে কোন বয়সি পাঠকের জন্য ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ বইটা উপভোগ্য হবে বলেই আমার বিশ্বাস। বয়স্করা তাদের শৈশবের দিনগুলোতে ফিরে যাবেন নিশ্চিতভাবে আর শিশুরা জানবে এমন একটা অনাড়ম্বর ছিলো তাদের পূর্ব-পুরুষদের শৈশব, যেখানে ছিলো না সিলেবাসের চোখ রাঙানি, ছিলো না তেমন কোন খেলার উপকরণ। তবু ছিলো প্রকৃতি থেকে কুড়িয়ে পাওয়া বিনামূল্যের খেলনা দিয়ে খেলার অপার আনন্দ।

পাশাপাশি গ্রামীণ ঐতিহ্যগুলোর একটা ছোঁয়া পাওয়া যাবে বইটি পড়লে। যার শৈশবের স্মৃতি যত বেশি বর্ণিল তার ভবিষ্যৎ তত বেশি উজ্জ্বল। আমি বলছি না সফল, কারণ সময়ের ব্যবধানে সফলতার মাপকাঠি বদলে যায়। কিন্তু শৈশবের স্মৃতি অবধারিতভাবে ভবিষ্যৎ জীবনের খারাপ সময়টা অতিক্রম করতে অনেক সাহায্য করে। বর্তমান বিশ্বে যান্ত্রিকতার যাঁতাকলে আমাদের জীবন অতিমাত্রায় অতিষ্ঠ। আমরা এক একজন কলের পুতুল হয়ে গেছি। ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ পাঠ সেখানে বয়ে নিয়ে আসবে পদ্মা পাড়ের এক মুঠো হিমেল বাতাস।  

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!