বই পাওয়ার আগেই সে দুটা সিমেন্টের ব্যাগ জোগাড় করে রেখেছে। আজ সকালে খাওয়া শেষ করে উঠোনে পাটি বিছিয়ে মলাট লাগাতে বসেছে তারা। সিয়াম জেদ করে- তার গুলোই আগে লাগাতে হবে।
ছোঁয়াকে জিজ্ঞেস করে- আচ্ছা আপু, তোর ক্লাস ফাইভের পড়া কি খুব কঠিন?
তুই মাত্র থ্রিতে পড়িস। তুই সহজ কঠিন দিয়ে কী করবি রে? ফাইভে উঠলে টের পাবি।
বাংলা বইয়ের ‘আমার পণ’ কবিতা আর ‘কুঁজো বুড়ির গল্প’ দুটা পড়ে ফেলেছি, খুব সুন্দর। মনে হচ্ছে সহজই হবে।
হ্যাঁ সহজই তো, আমার কাছে তোদের পড়া কোনো ব্যাপার-ই না।
উহ্! সেইদিনই আম্মু বলল, ছোঁয়া ক্লাস থ্রিতে ফেল করেছিল, তুই যেন একটু ভালো করে পড়িস।
ওদের দুজনের একটা মাটির যৌথ ব্যাংক আছে। উপহার বা টিফিনের বাঁচানো টাকা সেখানে জমা রাখে। কার ভাগ বেশি, কার ভাগ কম এই নিয়ে হয় ঝগড়া, চলে নানা জল্পনা কল্পনা।
এই আপু, এক বছরতো হয়ে গেল, ব্যাংক ভাঙবি না?
হ্যাঁ ভাঙবো ভাঙবো। মেলা শুরু হলেই ভাঙবো। আর আগেই বলে রাখছি, টাকা কিন্তু তিন ভাগের দুইভাগ আমার, একভাগ তোর।
বললেই হয়ে গেল? আমি তোর চেয়ে বেশি টাকা রাখি। গত ঈদে শাহজাহান কাকা আমাকে ২০ টাকা দিয়েছিলো, ওইটাও ব্যাংকে রেখেছি।
কাকা কি শুধু তোকে একাই দিয়েছিল নাকি, বলেছে দুইজন মিষ্টি কিনে খেও। আর টিফিনে টাকা তুই সব খেয়ে ফেলিস, আমি না খেয়ে ব্যাংকে রাখি।
দুজনার ঝগড়ার সুর শুনে তাদের মা কারিমা বেগম রান্নাঘর থেকে এগিয়ে আসে।
হয়েছে হয়েছে এবার থামো! কত লক্ষ টাকা যে জমিয়েছ, এটা নিয়ে আবার দুই ধনী ব্যক্তির প্রতিদিন হিসাবে গণ্ডগোল লাগে।
দেখেছো মা, আপু বলছে ওর দুইভাগ, আমার এক ভাগ!
ওইসব হিসাব বাদ রেখে কাল থেকে ক্লাস শুরু- এই চিন্তা করো। ছোঁয়া তোমার স্কুল ড্রেসটা আজই ধুয়ে শুকাতে দিও।
আচ্ছা মা।
এবছর নতুন স্কুল ড্রেস বানানো হয়নি। শুধু সিয়ামের শার্ট নতুন বানানো হয়েছে।
সকালে ঘুম থেকে ওঠে খাওয়া-দাওয়া সেরে স্কুলে বেড়িয়ে পরে দুজন। এই স্কুলে গত ছয় বছর পড়লেও সবকিছু নতুন নতুন লাগছে। ছোঁয়ার বান্ধবী লামিয়া তার কাছে এসে বসে।
কিরে কী খবর, কেমন আছিস?
আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?
আছি ভালোই। শোন, নতুন বছরে আমার বাবার প্রোমোশন হয়েছে, তাই একটু ছোট করে অনুষ্ঠান করবে আজ। আমি তোকে আর রুহিকেই বলছি। স্কুল থেকে ফিরে বিকেলেই আমাদের বাসায় আসবি।
চেষ্টা করবো, আম্মু যেতে দিলে যাব।
চেষ্টা কিরে! আন্টিকে আমার কথা বলবি। আসবি কিন্তু।
ছোঁয়া মায়ের থেকে বাক্সে তুলে রাখা গত ঈদের সালোয়ার-কামিজটা বের করে সেটা পরে। বাসা থেকে বের হয়ে রুহিকে সঙ্গে নিয়ে লামিয়ার বাসায় পৌঁছায়। রুহি কানে সোনার দুল আর হাতে সোনার আংটি পরে এসেছে। বাড়িতে লামিয়ার সব আত্মীয়-স্বজন এসেছে। লামিয়া ওদের দুজনকে নিয়ে খাবার রুমে যায়। খাওয়া শেষে তার রুমে নিয়ে বসে গল্প করতে থাকে।
রুমটা খুব সুন্দর করে সাজানো, কাঠের সুন্দর কাজ করা সব জিনিসপত্র। সবচেয়ে সুন্দর ওর পড়ার টেবিলটা। লামিয়া তার ড্রেসিং টেবিলে রাখা সাজবার জিনিস দেখায়, তার সুন্দর সুন্দর পোশাক দেখায়। আলমারি থেকে তার সোনার অলংকারগুলো দেখায়।
একসময় বলে- আমার আম্মু বলে, মেয়েদের অলংকার ছাড়া চলেই না। বলে যে- অলংকার ছাড়া নারী লবণ ছাড়া তরকারির মতো।
কথাটা শুনে ছোঁয়ার খুব খারাপ লাগল। কারণ তার কোনো সোনার অলংকার নেই। রাত হওয়ার আগেই বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে ভাবে সেও সোনার দুল কিনবে। কিন্তু টাকা কোথায় পাবে? আব্বুকে বললে কিনে দেবে না। গত কয়েকদিন আগেই ডাক্তারখানায় অনেকগুলো টাকা খরচ হয়েছে।
ছোঁয়া বাড়ি গিয়ে দেখে সিয়াম ঘুমিয়ে গেছে। সোনার অলংকারের কথা কিছুতেই ভুলতে পারছে না ছোঁয়া। তার মন খুঁড়ে খাচ্ছে, সবার আছে তার কেন নেই? আসলেই কি অলংকার ছাড়া নারী লবণ ছাড়া তরকারির মতো!
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মাটির ব্যাংকটার দিকে নজর পরে তার। ছোঁয়ার মাথায় একটা বুদ্ধি আসে, ব্যাংক ভেঙে টাকা নিয়ে দুল কিনবে। যেই ভাবা সেই কাজ। ভয়ে গা প্রচণ্ড কাঁপছে তার। যে ব্যাংক নিয়ে কত খুনসুটি, কত উৎসাহ, আর সেটা কিনা এভাবে করে ভাঙতে হচ্ছে!
সতর্কতার সঙ্গে আস্তে করে মেঝের উপর আঘাত করে ছোঁয়া। আকাশ থেকে একবারে অনেকগুলো বৃষ্টিকণা টিনের চালের উপর পড়ার মতো ব্যাংক থেকে একবছরের জমানো সবগুলো টাকা-পয়সা উন্মোচিত হয়। শুধু কাগজের নোটগুলো নিয়ে গুণে দেখে ২৮০ টাকা হয়।
কাঁপাতুর হাতে টাকাটা বইয়ের মধ্যে রাখে আর ভাঙা টুকরোগুলো খুচরা টাকা খাটের তলায় লুকিয়ে রাখে ছোঁয়া। সে রাতে তার ভালোমতো ঘুম হয়নি। সিদ্ধান্ত নেয় স্কুলে টাকা নিয়ে যাবে, ছুটির পর জুয়েলারিতে গিয়ে দুল কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরবে।
স্কুলে যাওয়ার পথে সিয়ামের সঙ্গে বেশি কথা বলে না ছোঁয়া, গম্ভীর হয়ে ভাবে।
মাঝেমাঝে তার খুব পাপবোধ হচ্ছে। কিন্তু পাপবোধটা তার দুল কেনার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে পেরে উঠছে না। আজ ক্লাসে তার মন বসছে না। রুহি,লামিয়ার সঙ্গেও তেমন হেসে-খেলে কথা বলছে না। তার মাথায় ওই এক চিন্তা। কত দাম হবে, সে তো দাম জানে না, দোকানি তাকে আবার ঠকিয়ে দেয় কিনা, এইসব ভাবনায় ব্যস্ত সে।
আরেকটা বুদ্ধি পাকিয়েছে ছোঁয়া, সোনার দুল দেখলে আম্মু সন্দেহ করবে যে এটা কিসের তৈরি, টাকা কোথায় পেলাম ইত্যাদি। তাই আম্মুকে একটা মিথ্যা বলবে যে লামিয়া উপহার দিয়েছে। এটা বাজারের কমদামি দুল, একদম সোনার দুলের মতো দেখতে।
স্কুল ছুটির পর ছোঁয়া বাজারের দিকে হাঁটতে শুরু করে। তার খুব আনন্দ লাগছে। আগে নিজেকে নিয়ে এত ভাবেনি। কিন্তু আজ ভাবছে, দুল পরলে তাকে কেমন দেখাবে, কোন কোন দিনে পরবে। বাজারে পৌঁছে সুন্দর দেখে বড় একটা জুয়েলারি দোকানে ঢুকে পরে। দোকানি তাকে দেখে বলে, কী নেবে মা?
চাচা, একজোড়া দুল নিতে চাচ্ছিলাম।
দেখো, অনেকগুলো সাজানো আছে, তোমার কোনটা পছন্দ হয় বেছে নাও।
সুন্দর সুন্দর কাজ করা দুল। প্রায় রুহির মতো একজোড়া দুল পছন্দ করে ছোঁয়া।
চাচা, এই জোড়া বের করেন তো!
তোমার পছন্দ আছে বলতে হয়। এটা নিতে পারো, সুন্দর মানাবে।
ছোঁয়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কানের কাছে ধরে দেখে আসলেই খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।
চাচা, এটার দাম কত?
একেকজনের কাছে একেকরকম দামে বিক্রি করি। তুমি স্টুডেন্ট মানুষ, তোমার কাছে কমই রাখবো। ৩ হাজার ২০০ টাকা দিও।
দাম শুনে আকাশ থেকে পড়ার মতো হয় ছোঁয়ার। সে আগে সোনার জিনিসের দাম সম্পর্কে জানতো না।
এত দাম! এর কমে হবে না?
দুল সর্বনিম্ন ২ হাজার ৫০০ টাকার পর্যন্ত হবে। এর নিচে হবে না।
চাচা, আমার কাছে ২৮০ টাকা আছে।
২৮০ টাকা! হা হা হা, ২৮০ টাকায় তো সিটিগোল্ডও হবে না!
আচ্ছা।
ছোঁয়া কান্নামাখা মুখে দোকান থেকে এক পা-দুপা করে বের হয়। ব্যাংক ভাঙার মতই একটা দমকা আঘাত অনুভব করে। তার পা উঠছে না। খুব কান্না পাচ্ছে। দুনিয়াতে সবচেয়ে তার নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে। কিছুদূর এগিয়ে বাজারের গেইটের কাছে একজন খুনখুনে বৃদ্ধা মহিলা দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করছে- সারাদিন কিচ্ছু খায়নি গো, কয়ডা পয়সা দাও…।
ছোঁয়া বৃদ্ধার চোখে ক্ষুধার্ত চাহনি, অসহায়ত্বের ছাপ দেখতে পায়। মনে মনে ভাবে যে- আমার চেয়ে বেশি অসহায় মানুষ এখনও অনেক আছে। একমুঠো খাবারের আশায় হাত পাতছে, আর আমি মনের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য এতবড় একটা কাজ করলাম! আমি তো এদের চেয়ে সুখিই ছিলাম। কী দরকার ছিল? এই ভেবে সে বইয়ের ভেতর থেকে ২৮০ টাকা বের করে বৃদ্ধাকে পুরোটা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফেরে।
এদিকে সিয়াম ঘরে ব্যাংক খুঁজে না পেয়ে অস্থির হয়ে আছে। এখনও মায়ের কাছে বলেনি ব্যাংক দেখেছে কিনা। ছোঁয়ার জন্য অপেক্ষা করছে কখন আসে। ছোঁয়া ঘরে ঢুকতেই জিজ্ঞেস করে- আপু ব্যাংক কোথায়? পাচ্ছি না তো। দেখেছ তুমি?
ছোঁয়া সিয়ামের দিকে তাকালে বুকভাঙ্গা কান্না আসে। সব ঘটনা বলার পর খাটের তলা থেকে সিয়াম ছুটে গিয়ে মাটির ভাঙা টুকরোগুলো আর খুচরা টাকা বের করে। ক্ষতবিক্ষত ব্যাংকটা দেখে সিয়ামও কাঁদতে থাকে। ব্যাংক নিয়ে সিয়ামের এত বেশি উৎসাহ ছিলো, তারপরও আজ সে স্বাভাবিক আচরণ করতে লাগলো।
আব্বু আম্মু জানলে আপুকে বকবে, তাই নিয়ে চিন্তিত হয়। আর ছোঁয়া শুধু নিজেকে ধিক্কার দিতে থাকে।
আমি অন্যায় করে ফেলেছি, তুই আমাকে মাফ করে দিস। আমার ভয় করছে আব্বু-আম্মু জানলে বিপদ হবে মহাবিপদ।
আপু তুই চিন্তা করিস না। এই খুচরা টাকা দিয়ে আগের মতো দেখতে একটা ব্যাংক কিনবো। আমরা আবার টাকা জমাবো। আম্মুকে বলবো এবছর ব্যাংক ভাঙবো না। কী বলিস হবে না?
আব্বু-আম্মুকে বলবি না? সত্যি বলছিস?
হ্যাঁ সত্যি বলছি। আমরা আমাদের নতুন মাটির ব্যাংকে অনেক টাকা জমাবো অনেক টাকা, যে টাকা দিয়ে সোনার দুল কেনা যাবে।
আবার তারা দুই ভাইবোন মিলে নতুন ব্যাংকে টাকা জমানো শুরু করে। প্রতীক্ষায় থাকে, কবে মাটির ব্যাংকটা ভরবে, আর সোনার দুল কেনার স্বপ্ন পূরণ হবে।
লেখক পরিচিতি: শিক্ষার্থী, দ্বাদশ শ্রেণি, বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ
কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না! |