ফিরতে চাই স্কুল জীবনে

দিনটি ছিল ২০১৮ সালের জানুয়ারির ৩০ তারিখ। মাধ্যমিক শিক্ষা জীবনে সেটা শেষ দিন ছিল। সেদিন ছিল বিদায় অনুষ্ঠান।

শারমিন আক্তার জেরিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 March 2021, 07:33 AM
Updated : 9 March 2021, 07:43 AM

আমি বসেছিলাম, আমার সামনে স্টেজে ছিলেন আমার স্কুলের সব থেকে রাগী শিক্ষক। বিদায় উপলক্ষে আমাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলছিলেন তিনি। অবশ্য তার কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম না আমি। হঠাৎ কানে এলো স্যার বলে উঠলেন, প্রতি বছরই এভাবে বিদায় দিতে হয় এক একটা নতুন ব্যাচকে। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে তারা চলে যায় নতুন ঠিকানায়, কেউ মনে রাখে কেউ রাখে না।

স্যারের কথাটা কানে আসতেই স্যারের দিকে তাকালাম, দেখতে পেলাম নবীনদের মুখে হাসি। কিন্তু স্যারের চোখ কিছু অন্য কথাই বলছিল। হঠাৎ করে চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই প্রথম দিনের কথা, মায়ের হাত ধরে যেদিন স্কুলে প্রথম পা রেখেছিলাম। ১০ বছর পেরিয়ে গেল, আজ স্কুল জীবনের সমাপ্তি।

কিন্তু ধাপে ধাপে মনে পড়ছিল কত স্মৃতি। তখন কেন জানি স্কুলের সব থেকে রাগী স্যারকে আমার ভয় হচ্ছিল না। সেদিন নিজে থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম স্যার আমাদের সঙ্গে কঠোর ব্যবহার করতেন শুধু আমাদের ভবিষ্যত সুন্দর করার জন্য। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে এলাম, সঙ্গে ছেড়ে এলাম এমনকিছু বন্ধু-বান্ধবী যাদের ছাড়া একসময় একটা মুহূর্তও কাটতো না।

স্বপ্নের টানে আর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় আজ আমরা ভিন্ন ভিন্ন শহরে। স্কুল জীবনে কলেজ জীবন নিয়ে ছিল অনেক রঙিন স্বপ্ন, এক দীর্ঘ অপেক্ষা ছিল এ কলেজ জীবনের জন্য। হ্যাঁ আমি কলেজ জীবনে পদার্পন করেছি, তবে আজ আমি সবচেয়ে বেশি ফিরে পেতে চাই আমার স্কুল জীবনকে। রোজ স্কুল ইউনিফর্ম পরা আমার জন্য ছিল এক বিরক্তিকর বিষয়, তবে আজ মনে হয় কোন বাহানায় হলেও একবার স্কুল ইউনিফর্মটা যদি পরতে পারতাম!

স্কুলের ভারি ব্যাগ ছিল আমার জন্য কষ্টদায়ক, আজ আমার কলেজ ব্যাগে তেমন কোনো ভার নেই। কিন্তু আমি ফিরে পেতে চাই স্কুলের সেই ভারি ব্যাগটাই। হ্যাঁ আমি আজ কলেজে পড়ি, পেছনের দরজাটা আমার জন্য সবসময় খোলা। ভালো না লাগলে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে যেতে পারি। এই দিনটির অপেক্ষা করেছি পুরো স্কুল জীবন, তবে আজ আমি ফিরে পেতে চাই স্কুল জীবনের সেই দিনগুলো যখন শুধু কথা বলার অপরাধে পুরো ক্লাস দাঁড়িয়ে থাকতে হতো।

তবে তাতে আমাদের খুব একটা কিছু আসতো যেত না। গণিত পরীক্ষার ভয়ে যেদিন স্কুলে যেতাম না, পরদিন স্কুলে গিয়ে জানতে পারতাম পরীক্ষা হয়নি পরীক্ষা আজ হবে। ঘটনাগুলো এখন আর আমার সঙ্গে ঘটে না। তবে আমি ফিরে পেতে চাই সেই অপ্রস্তুত গণিত পরীক্ষাগুলো। হ্যাঁ আমি কলেজে পড়ি, আজ আমাকে টিফিন খাওয়ার জন্য টিফিন ঘণ্টার অপেক্ষা করতে হয় না, তবে স্কুল জীবনে টিফিন খাওয়ার জন্য আমি টিফিনের ঘণ্টার অপেক্ষা করেছি তা কিন্তু না। ক্লাস চলার সময়ই আমাদের টিফিনবাক্স ফাঁকা হয়ে যেত।

আমি ফিরে পেতে চাই এই দুষ্টুমিভরা দিনগুলো, স্যারের একটু বকাতেই যখন কান্নার জোয়ার ভাসিয়েছি। কলেজে পড়লেও আজ আর স্যারের বকা শুনে হাই-বেঞ্চের ওপর মাথা রেখে শুয়ে কান্না করা হয় না। কলেজে তো ঠিকই উঠেছি আমি, তবে স্কুল জীবনে সবার আগে খাতা জমা দেওয়ার আনন্দটা হারিয়ে ফেলেছি। হারিয়ে ফেলেছি ক্লাসে টপ নাম্বার পাওয়ার খুশিটা। স্যারদের জানাই হলো না তাদের অগোচরে তাদের কিছু সুন্দর নাম দিয়েছিলাম। টিফিন টাইমের আনন্দটা হারিয়ে ফেললাম, সঙ্গে হারিয়ে ফেললাম খুব কাছের বন্ধু-বান্ধবীদের।

আজ অনেকদিন হলো তাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই। তারা আছে স্মৃতির পাতায়, তবে সাক্ষাৎ আজ আর হয় না। সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী যার সঙ্গে এক বেঞ্চে বসা নিয়ে বকুনি খেয়েছি অনেক, তার সঙ্গে আজ আমার যোগাযোগ হয় না। কখনো কি ভেবেছিলাম যে জীবনের জন্য এত অপেক্ষা সে জীবনে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে আসতে হবে ওদের! মাধ্যমিক পরীক্ষার পর সবাই প্ল্যান করেছিলাম একই কলেজে ভর্তি হব। বাস্তবে সেটা হলো না। বাস্তবতায় আমরা যে যার যোগ্যতা অনুযায়ী হারিয়ে গেলাম নতুন নতুন ঠিকানায়।

নতুন বন্ধু-বান্ধবী অনেক হয়েছে, তবে ‘তুই স্কুলে না গেলে আমিও যাব না’ এরকম বান্ধবী আর হয়নি। হয়তো আর হবেও না। হ্যাঁ কলেজ জীবনে এসে আমি বন্ধু-বান্ধবী তো পেয়েছি, তবে নিজের ফুচকার প্লেট শেষ করে বান্ধবীর ফুচকার প্লেটে ভাগ বসানোর মতো বান্ধবী আর হয়নি। অনেকদিন হলো প্রিয় বান্ধবীর সঙ্গে টিফিন ভাগ করে খাওয়া হয় না।

সময় বহমান। সময় কারও জন্য অপেক্ষা করে না। স্কুল লাইফের গণ্ডি পেরিয়ে এসেছি ঠিকই, স্কুল লাইফের মায়া ছাড়তে পারেনি। স্কুল জীবনে যখন খুব করে চাইতাম স্কুল জীবনটা শেষ হয়ে যাক, শুরু হোক কলেজ জীবন, আজ তার থেকেও অনেক বেশি করে ফিরে পেতে চাই স্কুল জীবনকে। মাধ্যমিক শিক্ষা জীবন এমন একটা সময় যা হারিয়ে যাওয়ার আগে উপলব্ধি করা যায় না। আমার জীবনে মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের প্রতিটি অধ্যায় স্মৃতিময় হয়ে আছে। যদি সত্যিই ফিরে যাওয়া যেত, তবে আমি ফিরে যেতাম আমার স্কুল জীবনে।

 লেখক পরিচিতি: শিক্ষার্থী, দ্বাদশ শ্রেণি, বাগেরহাট সরকারি মহিলা কলেজ

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!