বাঙলা সাহিত্যের কিশোর ইতিহাস

বই: লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী, লেখক: হুমায়ুন আজাদ, প্রকাশনী: আগামী প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ: ১৯৭৬

মো. ইয়াকুব আলীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Feb 2021, 05:13 AM
Updated : 26 Feb 2021, 05:13 AM

‘লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী’ এবং ‘কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী’ যুগল বই দুটি হুমায়ুন আজাদের অমর সৃষ্টি। ‘লাল নীল দীপাবলিতে’ লেখক অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। কোন ইতিহাস পাঠও যে এতটা সহজ সুন্দর হতে পারে এই বই দুটো না পড়লে অজানা থেকে যেতো।

লেখকের ভাষায় ‘লাল নীল দীপাবলিতে আমি স্বপ্নিল কিশোর-কিশোরী তরুণ-তরুণীদের চোখের সামনে বাঙলা সাহিত্যের হাজার বছরকে আলোকমালার মতো জ্বেলে দিতে চেয়েছিলাম।’ এই বইয়ে ছোট ছোট প্রচ্ছদের আকারে বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। বাঙলা সাহিত্য চিরকাল একরকম থাকেনি, কালে কালে বদল ঘটেছে তার রূপের তার হৃদয়ের। কবি হুমায়ুন আজাদ হাজার বছরের বাঙলা সাহিত্যকে তুলে ধরেছেন কবিতার মতো, জ্বেলে দিয়েছেন বাঙলা সাহিত্যের নানা রঙের দীপাবলি।

‘লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী’ এমন বই যার সঙ্গী হতে পারে ছোটরা, বড়রা, যারা ভালোবাসে বাঙলা সাহিত্যকে। বাঙলার প্রতিটি ঘরে আলো দিতে পারে এ বই। বইয়ের ভাষা এতটাই মধুর যে একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না করে ওঠা মুশকিল। প্রথম পরিচ্ছদের প্রথম লাইনগুলো এমন- ‘যদি তুমি চোখ মেলো বাঙলা সাহিত্যের দিকে, তাহলে দেখবে জ্বলছে হাজার হাজার প্রদীপ, লাল নীল সবুজ, আবার কালোও। হাজার বছরের বেশি সময় ধরে রচিত হচ্ছে বাঙলা সাহিত্য। এর একেকটি বই একেকটি প্রদীপের মতো আলো দিচ্ছে আমাদের।’

এরপরই সাহিত্য কী সে বিষয়টা লেখক আবার পরিষ্কার করে দিচ্ছেন এভাবে, ‘সাহিত্য হচ্ছে আলোর পৃথিবী, সেখানে যা আসে আলোকিত হয়ে আসে; কালো এসে এখানে নীল হয়ে যায়, অসুন্দর হয়ে যায় সুন্দর শিল্পকলা।’

এ বইয়ে বাঙলা সাহিত্যের উৎস এবং বিবর্তনের পাশাপাশি সাহিত্যের বয়ে চলার পথের গল্পও বলা হয়েছে। কারা আসলে বাঙলা ভাষা তথা সাহিত্যকে এতদূর নিয়ে এসেছে সেই গল্প বলা হয়েছে। বলা হয়েছে বাঙলা সাহিত্যকে যুগ যুগ ধরে যারা রচনা করে গেছেন এসেছে তাদের নাম ও অবদানের কথা।

একেবারে বাঙলা সাহিত্যের সেই আদিগ্রন্থ ‘চর্যাপদ’ থেকে শুরু করে বর্তমানের বাঙলা সাহিত্যের রচয়িতাদের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে সংক্ষিপ্ত অথচ সহজ ভাষায়। চব্বিশজন বৌদ্ধ বাউল কবি যারা চর্যাপদ রচনা করেছিলেন, এরপর হাজার বছরের বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে আরও কতশত কবি সাহিত্যিক বাঙলা সাহিত্যে অবদান রেখে গেছেন। 

এ বইয়ে বাঙলা ভাষা ও সংস্কৃতির পাশাপাশি বাঙলা নামের উৎসেরও অনুসন্ধান করা হয়েছে। লেখকের ভাষায়, ‘কেউ কেউ মনে করেন বাঙলা ভাষার উদ্ভব ঘটেছে সপ্তম শতাব্দীতে। কিন্তু আজকাল আর বাঙলা ভাষাকে এতো প্রাচীন বলে মনে করা হয় না; মনে করা হয় ৯৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি কোন সময়ে বাঙলা ভাষার জন্ম হয়েছিলো।’

‘বাঙলাদেশ’ নামের অনুসন্ধান করতে গিয়ে লেখক লিখেছেন, ‘এ দেশের নামের কাহিনি বলেছেন সম্রাট আকবরের সভার এক রত্ন আবুল ফজল। তিনি বলেছেন, বঙ্গ শব্দের সঙ্গে আল শব্দটি মিলিত হয়ে এদেশের নাম হয়েছে বাঙ্গাল বা বাঙ্গালা। আমরা আজ বলি বাঙলা।’

বইটির প্রথম প্রচ্ছদ, ১৯৭৬

এরপর বাঙালিদের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে লেখক লিখেছেন, ‘বাঙলা সাহিত্য বাঙলাদেশ এবং বর্তমানে যাকে পশ্চিম বাঙলা বলা হয় তার মিলিত সম্পদ। নৃতাত্ত্বিকেরা গবেষণা করে সিদ্ধান্তে এসেছেন আমাদের পূর্বপুরুষ হচ্ছে সিংহলের ভেড্ডারা। এরা অনেক আগে সারা ভারত ছড়িয়ে ছিলো। আমাদের শরীরের রক্তে তাদের রক্ত রয়েছে বেশি পরিমাণে। তবে আমরা অজস্র ধারার মিশ্রণ।’ বাঙালি মুসলমানের প্রসঙ্গে লেখক বলেছেন, ‘বাঙালি মুসলমানেরা কিন্তু প্রকৃতই বাঙালি।...অনেকে বিজয়ী শক্তির মোহে, অনেকে ধর্মের মোহে এবং অধিকাংশ দারিদ্র ও অত্যাচার থেকে মুক্তির জন্য মুসলমান হয়েছে। এরা জাতিতে বাঙালি আর ধর্মে মুসলমান, যেমন আমরা। আমাদের প্রধান পরিচয় আমরা বাঙালি।’

এরপর বাঙলা ভাষার উদ্ভবেরও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস রয়েছে এ বইতে। লেখকের ভাষায়, ‘বাঙলা ভাষা আরও একটি পুরোনো ভাষার ক্রমবদলের ফল। ওই পুরনো ভাষাটির নাম ‘প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা’। এ প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা মানুষের মুখে মুখে বদলে পরিণত হয়েছে বাঙলা ভাষায়।...ভাষা বদলের কিছু নিয়ম আছে; খামখেয়ালে ভাষা বদলায় না। ভাষা মেনে চলে কতগুলো নিয়মকানুন। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা একদিন পরিবর্তিত হয়ে রূপ নেয় ‘পালি’ নামক এক ভাষায়।...পালি ভাষা ক্রমে আরও পরিবর্তিত হয়; তার উচ্চারণ আরও সহজ সরল রূপ নেয়, এবং জন্ম নেয় ‘প্রাকৃত ভাষা’। ...তারপর দশম শতকের মাঝভাগে এসে এ-প্রাকৃত ভাষার আরও বদলানো একটি রূপ থেকে উদ্ভূত হয় একটি নতুন ভাষা, যার নাম বাঙলা। এ ভাষা আমাদের।’

দশম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে রচিত হচ্ছে বাঙলা সাহিত্য। তাই বাঙলা সাহিত্যের বয়স এক হাজার বছরেরও বেশি। হাজার বছরের বাঙলা সাহিত্যকে ভাগ করা হয় তিনটি যুগে। যুগ তিনটি হচ্ছে- প্রাচীন যুগ: ৯৫০ থেকে ১২০০ পর্যন্ত, মধ্যযুগ: ১৩৫০ থেকে ১৮০০ পর্যন্ত, আধুনিক যুগ: ১৮০০ থেকে আজ পর্যন্ত, আরও বহুদিন পর্যন্ত।

১২০০ থেকে ১৩৫০ পর্যন্ত বাঙলা ভাষায় আর কিছু রচিত হয়নি। কালো বা ফলশূন্য এ সময়টিকে বলা হয় ‘অন্ধকার যুগ’।

এছাড়া লেখক বাঙলা সাহিত্যের স্বরূপ অনুসন্ধান করেছেন এ বইতে। লেখকের ভাষায়, ‘বাঙলা সাহিত্য সম্মন্ধে আরও একটি কথা মনে রাখার মতো। এ সাহিত্য জন্ম থেকেই বিদ্রোহী; এর ভেতরে জ্বলছে বিদ্রোহের আগুন। কেনো এ-আগুন? বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য সমাজের উঁচুশ্রেণীর কাছে মর্যাদা পায়নি। এর জন্মকালে একে সহ্য করতে হয়েছে উঁচুশ্রেণীর অত্যাচার, উৎপীড়ন। দশম শতকে বাঙলা সাহিত্য জন্ম নিচ্ছিলো, তখন সংস্কৃত ছিলো সমাজের উঁচুশ্রেণীর ভাষা, তারা সংস্কৃতের চর্চা করতো। ঠিক তখনি সংগোপনে সাধারণ লোকের মধ্যে জেগে উঠেছিলো বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য। সাধারণ মানুষ একে লালন পালন করেছে বহুদিন।’

বাঙলা সাহিত্যের প্রথম বইটির নাম হলো ‘চর্যাপদ’। এ বইটি হাতে নিলে চমকে উঠতে হয়, এটা যে বাঙলা ভাষায় লেখা হয়েছে বিশ্বাস হয় না। কেননা হাজার বছর আগে আমাদের ভাষাটিও অন্যরকম ছিলো, তা পরিবর্তিত হতে হতে আজকের রূপ ধরেছে। এ বইটার কবিতাগুলো ছোট ছোট, কবিদের মনের কথা এগুলোতে স্থান পেয়েছে। কিন্তু এরপরই দেখা দেয় বড় বড় বই, বিরাট বিরাট গল্প, এবং কবিরাও মনের কথা বলছেন না, বলছেন মানুষ ও দেবতার গল্প। এরপর আবার আসে ছোটো ছোটো কবিতা, এগুলোকে আমরা বলি ‘বৈষ্ণব পদাবলি’। এগুলোতে প্রবল আবেগ আর মনের কথা বড় হয়ে ওঠে। এভাবে সাহিত্য বদলায়।

‘চর্যাপদ’ জ্বলে ওঠে বাঙলা ভাষার প্রথম প্রদীপের মতো, আলো দিতে থাকে আমাদের দিকে, আর সে আলোতে পথ দেখে দেখে হাজার বছরের পথ হেঁটে আসি। ‘চর্যাপদ’ পড়ার মানে হলো চমৎকার ধাঁধার ভেতরে প্রবেশ করা। একটি কবিতায় এক দুঃখী কবি তার সংসারের অভাবের ছবি এতো মর্মস্পর্শী করে এঁকেছেন যে পড়তে পড়তে শিউরে উঠতে হয়। কবির ভাষা তুলে দিচ্ছি:

টালত মোর ঘর নাহি পড় বেষী

হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী

বেগ সংসার বড্ হিল জাঅ

দুহিল দুধু কি বেন্টে যামাঅ

কবি বলেছেন, ‘টিলার ওপর আমার ঘর, আমার কোন প্রতিবেশী নেই। হাঁড়িতে আমার ভাত নেই, আমি প্রতিদিন উপোস থাকি। ব্যাঙের মতো প্রতিদিন আমার সংসার বেড়ে চলেছে। যে দুধ দোহানো হয়েছে তা আবার ফিরে যাচ্ছে গাভীর বাটে।’

ঠিক এভাবে লেখক বাঙলা সাহিত্যের প্রতিটি যুগের প্রত্যেকটা সাহিত্য এবং সাহিত্যিককে ছোট পরিসরে বিশ্লেষণ করেছেন এ বইতে। তাই বইটা পড়লে  পুরো বাঙলা সাহিত্যের প্রতি এক ধরণের অকৃত্রিম ভালোলাগা তৈরি হবে। মনে হবে বাঙলা সাহিত্যের সব বই কিনে এক্ষুণি পড়তে বসে যাই। বাঙলা সাহিত্যের সব শাখাকে আলাদা আলাদা আলোচনা করা হয়েছে। বাঙলা সাহিত্যের শক্তিমান এবং দুর্বল দিকগুলোর দিকে আলোকপাত করা হয়েছে।

এভাবে বাঙলা সাহিত্য আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবে আরও হাজার হাজার বছর ধরে। ততদিনে হয়তোবা বাঙলা সাহিত্যে আরও অনেক পরিবর্তন আসবে। বাঙলা সাহিত্য হবে আরও সমৃদ্ধ। লেখকের ভাষায়, ‘আগামী শতকে দেখা দেবে নতুন চেতনা। হয়তো তার আভাস দেখা দেবে বিশ শতকের শেষ দশকেই। তা হয়তো বহুবর্ণের দীপাবলি হয়ে দেখা দেবে একুশ শতকের প্রথম বা দ্বিতীয় বা তৃতীয় দশকে। চিরকাল জ্বলবে বাঙলা সাহিত্যের লাল নীল দীপাবলি।’

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!