সত্যিই এর আগে আমি নিজেও দুইবার মোংলা দিয়েই সুন্দরবন গিয়েছি। সাতক্ষীরা দিয়ে সুন্দরবন ভ্রমণ নতুন এক মাত্রা যোগ করবে। সেই পথেই ভ্রমণের সিদ্ধান্ত হলো। সবাই মুন্সিগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে এসে একত্রিত হব।
শ্যামনগরের নওয়াবেকিতে আছেন আমার পরিচিত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু নাইম ভাই। আযহার মাহমুদ ভাই রাতেই ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছেন, নাইম ভাইয়ের বাসায় রেস্ট নিয়ে দুপুরে মুন্সিগঞ্জ যাবেন। আমি সাতক্ষীরা শহর থেকে সকাল দশটায় রওনা দিলাম। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছোট ভাই আজাহার ইসলামও শ্যামনগরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে।
দুপুরের পরই আযহার ভাই, নাইম ভাই ও আমি মুন্সিগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে একত্রিত হলাম। আমরা একেবারে সুন্দরবনের ভেতরে ‘বরসা রিসোর্টে’ থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। রুমে ব্যাগ রেখে ফ্রেস হয়ে আশপাশে কী আছে তার সৌন্দর্য উপভোগ করতে বেরিয়ে গেলাম। পাশেই দেখা মিলল ‘আকাশনীলা ইকো ট্যুরিজম সেন্টারের’, টিকেট নিয়ে কাঠের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চললে যতদূর চোখ যায় শুধুই সবুজের সীমানা। শরীরে এসে ছুঁয়ে যায় বঙ্গোপসাগর থেকে ছুটে আসা জলভেজা শীতল হাওয়া।
রাত আটটার দিকে আজাহার ইসলাম মুন্সিগঞ্জ এসে পৌঁছাল। রাতে খাওয়া-দাওয়া করে যে যার মতো ঘুমোতে চলে গেলাম। পরদিন সকালে মুস্তাফিজুর রহমান ও মামুন বরসা রিসোর্টে চলে আসল। আমরা ৬ জনের একটি দল তৈরি সুন্দরবনে বেড়ানোর জন্য।
সকাল দশটায় বরসা রিসোর্টের পাশে চুনা নদীর কোলঘেঁষা কলবাড়ি মোড়ে নাস্তা সেরে নিলাম। বলে রাখা ভালো এই কলবাড়ি চুনা নদীর পাড়েই গত ১৮ ও ১৯ জানুয়ারি বিকেলে দুটি বাঘকে ঘোরাফেরা করতে দেখে স্থানীয় টাইগার টিমের সদস্যরা ও বনবিভাগ যৌথভাবে সন্ধ্যায় মাইকিং করে স্থানীয়দের সতর্ক করেছিল। তারপরও পরদিন তিন জেলে কাঁকড়া ধরতে সুন্দরবনে প্রবেশ করলে বাঘের কবলে পড়ে দুইজন নিহত একজন আহত হন।
কিছু শুকনা খাবার নিয়ে আমরা ভ্যানগাড়িতে চড়ে বুড়িগোয়ালিনীর নীলডুমুর খেয়াঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। যেতে যেতে রাস্তার দুইধারে চোখে পড়ল অসংখ্য চিংড়ি আর কাঁকড়া ঘের। ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের কাঁকড়া ঘেরটি নীলডুমুর যেতে রাস্তার বামপাশেই পড়বে। স্থানীয় ওসির মাধ্যমে মুন্সিগঞ্জ বনবিভাগের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে দুইজন গার্ড নিয়ে চলে গেলাম ইঞ্জিনচালিত নৌকার ঘাটে। খোলপেটুয়া নদীতে নোঙর করা আমাদের জন্য নির্ধারিত নৌকাতেই উঠলাম।
ইতোমধ্যে আমাদের নৌকা কলাগাছি নদীতে চলে আসল। নদীটি আগের নদী থেকে বড়, দুপাশেই সুন্দরবন। দুই ধারের সারি সারি গোলপাতা, কেওড়া, গেওয়া, গরান, বাইন, কাঁকড়া, সুন্দরী বন সত্যিই মুগ্ধ করে। আধ ঘণ্টা চলার পর নৌকা কলাগাছিয়া ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্রে প্রথম যাত্রা বিরতি করল। নৌকা তীরে ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই লাফিয়ে নামলাম।
নামতেই সবাইকে অভ্যর্থনা জানাল দুষ্টু বানরের দল। ভেতরে ঢুকলেই আশপাশে ভিড়ে বানরের দল। বনবিভাগের তৈরি করা কাঠের রাস্তার ওপর দিয়ে হেঁটে সবাই বনের অনেক ভেতরে চলে আসলাম এবং এখানেই হরিণের দেখা পেলাম। বন্য হরিণকে চিপস ও বানরকে মুড়ি খাওয়ালাম। ওদের খাওয়ানোর জন্য সঙ্গে বাদাম, চিপস, মুড়ি নিতে অবশ্যই ভুলবেন না।
গার্ড আমাদের কাদার ওপর বাঘের পায়ের ছাপ দেখিয়ে বলল, ‘বেশি সাহস দেখিয়ে বনের ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না, তাতে বিপদ হতে পারে। কাদায় নামার আগে খেয়াল রাখবেন পায়ের দিকে। গাছের খাড়া শ্বাসমূল পায়ে ফুটতে পারে।’ গার্ডের মাধ্যমে সুন্দরবনের সুন্দরী, গরান, গেওয়া, কেওড়া, কাঁকড়া, খলিসাসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, ফার্ন চিনতে পারলাম। দেখা পেলাম রং-বেরঙের ছোট কাঁকড়া।
ভেতরে ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়ল চারদিকে নারিকেল গাছ ও বিভিন্ন বৃক্ষবেষ্টিত একটি বড় মিঠা পানির পুকুর। পুকুর পাড়ে হরিণের দেখাও মিলল। গার্ড জানাল, ‘নদীর পানি নোনা হওয়ায় গভীর রাতে বাঘ এ পুকুরের মিঠা পানি খেতে আসে।’ এটাও জানাল রাতের বেলা ধৈর্য ধরে ওয়াচ টাওয়ারে অবস্থান করলে ভাগ্য সহায় হলে বাঘের দেখা পেয়েও যেতে পারেন। গার্ডকে বাঘ দেখেছেন কিনা প্রশ্ন করতে জানাল, ‘আসার সময় দোয়া পড়তে পড়তে আসি আল্লাহ এ যাত্রায় যেন বাঘের সামনে ফেলিও না।’
এ নীলডুমুর ঘাটে খাওয়া-দাওয়াটা সেরে নিতে পারেন স্পেশাল করে। বিশেষ করে এখানে এমন কিছু মাছ পাওয়া যায় যেগুলো দেশের অন্য কোথাও দেখা পাওয়া যায় না বললেই চলে। মাছগুলোও অনেক সুস্বাদু। খাবার হোটেলে রান্না করা যে মাছ পাবেন সেগুলা অথবা একটু সময় নিয়ে কিছু অতিরিক্ত টাকা যোগ করে নিজের ইচ্ছেমতো মাছ ফ্রাই, ভুনা করেও খেতে পারবেন। চিংড়ি, আবাদি, সিলেট মাছ, ভেটকি, ভাঙান, পাসসে, টেংরা, কাইন, বাঁশপাতা, খয়রা, তপস্বে, দাঁতনে, ছোট মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির নদীর মাছ খাওয়ার সুযোগ তো থাকছেই। তবে ভুল করে হরিণের মাংস খাওয়ার কথা মুখে না আনাই ভালো। কারণ এটা নিষিদ্ধ।
স্মৃতির পাতায় সুন্দরবন ভ্রমণের অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা নিয়ে রাতে ফিরলাম রিসোর্টে। আর মনের ভেতর অনুভব করতে লাগলাম, ‘আসলেই আমাদের মাতৃভূমি অনেক সুন্দর’। রিসোর্টের কালুর (কুকুর) কথাও বলতে হবে, সখ্যতা হয়েছিল প্রথম দিনেই। ‘কালু’ বলে ডাকলে যেখানেই থাকুক না কেন ছুটে আসত।
লেখক: শিক্ষার্থী, ভেটেরিনারি মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।
কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com । সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না! |