স্বদেশ

পিউ যেদিন দেশ ছেড়ে পাকাপাকিভাবে থাকার জন্য বিদেশ পাড়ি দিল, সেদিন ভেবেছিল সে বুঝি বাবা-মায়ের সাথে বেড়াতে যাচ্ছে প্রতিবারের মতো। কয়েকদিন পরই আবার চলে আসবে।

কল্যাণী সেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Jan 2021, 04:11 AM
Updated : 16 Jan 2021, 04:11 AM

যখন সে বুঝতে পারলো তাদের অনেকদিন দেশে ফেরা হবে না, তখন থেকেই তার দেশের জন্য মন কেমন করতো। এখানে তার দাদা-দাদি, নানা-নানি আছে। খালা-মামা-চাচা-ফুপুরা রয়েছে। কাজিনরা রয়েছে। ওখানেতো মা-বাবা ছাড়া কেউ নেই। মন খারাপ লাগলেই সে ভিডিও কলে কথা বলে সবার সাথে।

তার সবচেয়ে বেশি কথা হয় মৌলি খালামনির সাথে। মাত্র একবছর হয়েছে পিউ দেশ ছেড়ে গেছে। অথচ খালামনি রোজ বলে, কত বছর তোকে কোলে নিই না পিউ সোনা! গতকাল ছিল পিউর ছয় বছরের জন্মদিন। এই প্রথম সে জন্মদিন পালন করলো তার প্রিয় খালামনিকে ছাড়া।

মৌলি আর্ট কলেজে পড়ে। পিউরও ছবি আঁকার প্রতি প্রচুর আগ্রহ। পিউ কোন ছবি আঁকলেই সাথে সাথে তার মাকে বলবে, খালামনিকে ছবি তুলে পাঠাবো আমার আঁকা ছবিটা? খালামনিও তার আঁকা ছবি দেখে খুব প্রশংসা করে। মাঝে মাঝে অবশ্য বলে এখানে এটা করলে ঠিক হতো, ওখানে ওটা করলে ভাল হতো এইসব আরকি।

পিউকে ছবি আঁকা শেখানোর জন্য মৌলি একটা নতুন খেলা শুরু করেছে। মৌলি গুগল থেকে একটা ছবি বের করে পিউকে পাঠিয়ে দেয়। সেই একই ছবি পিউও আঁকে, মৌলিও আঁকে। কারটা ভাল হলো সে বিচারের জন্য আবার ভোটাভুটি হয়। প্রতিবারই পিউ জিতে। তার ধারণা খালামনি ইচ্ছে করে পচা ছবি আঁকে, না হলে সবাইকে শিখিয়ে দেয় পিউরটা ভাল বলতে।

একদিন মৌলি পিউকে বললো, পিউ সোনা এ বছরতো বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী। তুমি বাংলাদেশকে নিয়ে একটা ছবি আঁকো। একদম তোমার মনের মতো করে। ব্যস পিউ ব্যস্ত হয়ে গেল বাংলাদেশকে নিয়ে কি ছবি আঁকবে সেই চিন্তায়।

এদিকে চারুকলার একদল ছাত্রছাত্রী স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে পাঁচ থেকে ষোল বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের হাতে আঁকা ছবি নিয়ে একটি চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করবে বলে ভাবে। তারা পরিকল্পনা করে, বয়স অনুযায়ী তাদের তিনটি গ্রুপে ভাগ করে ছবি আহ্বান করা হবে। বিষয় হবে ‘বাংলাদেশ’। সারাদেশ থেকেই অংশগ্রহনকারীরা ডাকযোগে, কুরিয়ারে অথবা সশরীরে এসে ছবি জমা দিতে পারবে।

সেরা ১০০ ছবি তারা প্রদর্শনীর জন্য বেছে নেবে। তারপর সেই ছবিগুলোকে নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উন্মুক্ত প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করবে। সেই সেরা ১০০জনকে সনদপত্রও দেওয়া হবে। শিশু-কিশোরদের চিত্রাঙ্কনে উৎসাহিত করতে একদল তরুণ চিত্রশিল্পীর একান্তই ব্যক্তিগত উদ্যোগ এটি। সেইমতো কাজও শুরু করে দিল তারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খবর ছড়িয়ে গেল। বেশ কিছু খরচাপাতি আছে। তাই একটি ফান্ড তৈরি করতে হবে। সবাই সবার সাধ্যমতো পরিচিত উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের কাজ শুরু করে দেয়।

কাজটি করার কথা যখন চিন্তা করা হয় তখন তারা ভাবতেও পারেনি এর আকার কত বড় হতে পারে। ছবি জমা দেয়ার সময় এখনও তিনদিন বাকি আছে। এর মধ্যেই ছবি জমা পড়েছে আড়াই হাজার। এগুলোর মধ্যে অসংখ্য ছবি এতো ভাল যে সেখান থেকে মাত্র ১০০ ছবি বাছাই করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। আবার বেশি ছবি নিতে গেলে খরচের খাত এত বড় হয়ে যাবে যেটা সামলানোও সম্ভব নয়।

কী করা যায় তা ভেবে ভেবে আয়োজকরা দিশেহারা। ঠিক তখনই দেশের একটি নামকরা শিল্পপ্রতিষ্ঠান এগিয়ে এলো তাদের সাহায্য করতে। তারা পুরো কার্যক্রমটি স্পন্সরের দায়িত্ব নিল। জাতীয় দৈনিক ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হলো। একশ নয় দুই হাজার ছবি প্রদর্শনীতে স্থান পাবে। আর পুরো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে জাতীয় ক্রীড়া কমপ্লক্সে।

মৌলী এই আয়োজকদের একজন। কাজের ব্যস্ততায় পিউর সাথে ভাল করে কথাই বলা হয়নি। খুব রেগে আছে মেয়েটা খালামনির ওপর। আজ শেষ দিনের সব কাজ শেষ করে পিউর মান ভাঙাতে মৌলি মোবাইলটা হাতে নিল। দেখলো পিউর একটি ম্যাসেজ এসেছে। সেটা খুলে মৌলি বিস্মিত। আবেগে তার চোখের কোণে কখন পানি জমা হয়েছে সে খেয়ালই করেনি।

জাতীয় ক্রীড়া কমপ্লেক্স লোকে লোকারণ্য। দৈনিক পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিকরাও এসেছে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে। সরকারি-বেসরকারি অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত রয়েছেন। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে পুরো এলাকা। মৌলি আয়োজক হিসেবে ভেতরেই রয়েছে। সে ভিডিও কল করলো পিউর মায়ের মোবাইলে। পিউদের ওখানে এখন রাত দশটা। জেগেই আছে মেয়েটা।

মৌলি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার ঠিক পেছনে সারি সারি ছবি সাজানো। এগুলো সব প্রতিযোগীদের আঁকা। মৌলি একটু সরে দাঁড়াতেই একটি ছবির উপর নজর গেল পিউর। সাথে সাথে সে এবং তা মা চিৎকার করে উঠলো। বিস্ময় কেটে গেলে আনন্দে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরলো মা-মেয়ে। ছবিতে দুটি শিশু বাংলাদেশের পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। একমাত্র প্রবাসী প্রতিযোগী হিসেবে পিউর আঁকা ছবিটি বিশেষ ক্যাটাগরিতে স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে। প্রবাসে থেকেও দেশমাতৃকার প্রতি ভালবাসা প্রকাশের এমন একটি চেষ্টাকে উপেক্ষা করতে পারেনি আয়োজকরা।

ছবি জমা দেওয়ার শেষ দিনের সব কাজ শেষ করে মৌলি যখন পিউর সাথে কথা বলার জন্য ফোন হাতে নেয় তখন দেখে পিউ এই ছবিটি এঁকে পাঠিয়েছে। মৌলির মনে হয়েছে এই ছবিটির প্রদর্শনীতে জায়গা পাওয়া উচিত। সে সাথে সাথে তার টিমকে ছবিটি দেখায়। যেহেতু আর কোন প্রবাসী প্রতিযোগীর ছবি জমা পড়েনি, তাই পিউর ছবিটি প্রিন্ট করে বিশেষ ক্যাটাগরিতে মনোনীত করা হয়। ছয় বছরের একটি মেয়ে বাংলাদেশের পতাকাকে তুলে ধরেছে এই ছবি বাদ দিতে চায়নি।

পিউ এসবের কিছুই জানতো না। সব শুনে সে মহাখুশি। সে একটি প্রশংসাপত্র পাবে শুনে তার মাকে বললো, চল মা আমরা বাংলাদেশে চলে যাই।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!