জাদুর কাঠি

টুকটুকির আজ আবার শরীর খারাপ করেছে। মেয়েটার দুদিন পরপর এমন অসুখ করে। ডাক্তার বাসায় এসে দেখে যান, ওষুধপত্র দিয়ে চলে যান।

সুফি বাংলার পান্থবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Jan 2021, 04:52 AM
Updated : 7 Jan 2021, 04:52 AM

যাবার সময় বেশ খানিকটা সময় বাবা মায়ের সাথে কথা বলেন। ডাক্তার কথা বলার সময় কেমন মুখ গম্ভীর করে কথা বলেন। মা-বাবা অসহায় হয়ে তাকিয়ে থাকেন। চলে যাওয়ার সময় বাবার কাঁধে হাত রাখেন। মা তখন নিজের কান্না সামলাতে পারেন না। অথচ এতো কিছুর পরও টুকটুকিকে কেউ কিছু বলে না।

ডাক্তার আঙ্কেলের সাথে মা-বাবার কথোপকথন পর্ব অবশ্য টুকটুকি কখনো দেখতে পায় না। তার সামনে সবাই কেমন হাসি হাসি ভাব করে কথা বলে। এসব হলো টুকটুকির নিজস্ব কল্পনা। সে আরও অনেক কিছু কল্পনা করে। কেউ কিছু না বললেও অনেক কিছু সে বুঝতে পারে। সে জানে তার অসুখটা খুব খারাপ ধরণের।

তাছাড়া এ অসুখ ভালো হওয়ার তেমন কোনো মেডিসিনও নেই। দেশে এবং দেশের বাইরে এর কোনো ভালো চিকিৎসাও নেই। ভালো ওষুধ থাকলে তার বাবা নিশ্চয়ই তা এনে দিত। তাকে চিকিৎসা করিয়ে ভালো করে দিত। কারণ টুকটুকি জানে তার বাবা মা তাকে খুব ভালোবাসে। এজন্য অসুখ হলে তার নিজের খুব মন খারাপ হয়। মন খারাপের ব্যাপারটা সে কাউকে বলতে চায় না।

বাইরে পাখি ডাকছে। বাগানে নতুন ফুল ফুটেছে। বাইরে কী সুন্দর হাওয়া বইছে। ফুলের গন্ধে পুরো বাড়ি ভরে গেছে। তবুও আজ টুকটুকির মন বেশ খারাপ। কেমন যেন থেকে থেকে কান্না পাচ্ছে। কম্বল জড়িয়ে বিছানায় একদম শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গেছে। বিকেলে অফিস থেকে ফেরার সময় কিছু আনতে হবে কিনা জিজ্ঞেস করেছে। সে বাবাকে কিছু বলেনি। তবুও সে জানে বাবা ফেরার সময় তার জন্য অনেক কিছু নিয়ে আসবে।

কিছুক্ষণ আগে মা আতপ চালের নরম ভাত আর এক বাটি মুরগির স্যুপ এনে পুরোটা শেষ করে গেছে। আজ চামুচে তুলে খাওয়ালো। অথচ টুকটুকি নিজে নিজে খেতে পারে। সে কারো মন খারাপ দেখতে চায় না। তার মুখ মুছে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। চুল আঁচড়ে দুইপাশে দুইটা ঝুঁটি করে দিয়েছে। খাবার সময় গালে হাত রেখে বলেছে অসুখ কমেছে কিনা। টুকটুকি সাথে সাথে বলল, হ্যাঁ মা। অনেকখানি কমেছে। এখন ভালো লাগছে।

আসলে মোটেই তার ভালো লাগছে না। কথাটা মাকে বললে মার মন খুব খারাপ হয়ে যেত। তার অন্য কারো মন খারাপ করতে ভালো লাগে না। মায়ের মন তো কোনভাবেই না।

টুকটুকির বাইরে বাগানে ঘুরতে ইচ্ছে করছে। খোলা মাঠে এলোমেলো ছুটোছুটি করতে মন চাচ্ছে। ঘরের ভিতর কম্বল জড়িয়ে শুয়ে থাকতে একদম ইচ্ছা করছে না। কিছুতে ভালো লাগছে না। কিন্তু মা রুম থেকে অফিসে বের হওয়ার আগে বলে গেছেন, টুকটুকি লক্ষ্মী সোনা। জাদুর কণা। রাজকন্যা টুকটুকি আজ রুম থেকে বাইরে বের হবে না! খালি পায়ে বাগানে যাবে না! মা বাসায় ফিরে টুকটুকিকে বেড়াতে নিয়ে যাবে।

টুকটুকি লক্ষ্মী মেয়ের মতো মাথা নেড়েছে। তারপর রেশমি কম্বল জড়িয়ে মুখটা বের করে জানালার দিকে তাকিয়ে থেকেছে। মা এখন অফিসে যাবেন। কিন্তু তিনি বাবার আগে বাসায় ফিরে আসবেন। মা দুপুরের পরপর চলে আসতে পারেন। সে সম্ভাবনা অনেক বেশি। বাবা আসেন সন্ধ্যার পর। বাবার অফিসে অনেক কাজ থাকে, সেজন্য আসতে দেরি হয়। মা টুকটুকিকে তা বুঝিয়ে বলেছে।

টুকটুকিদের বাসায় কাজের লোক আছে। সে তাকে দেখাশোনা করে। কিছু দরকার হলে এনে দেয়। কিন্তু তার টিভিতে ছবি দেখার অনেক নেশা। বাবা-মা অফিসে চলে যাওয়ার সাথে সাথে সে টিভি রুমে ঢুকে পড়ে। সারাক্ষণ শুধু টিভি দেখে। টিভি দেখা সময়ের মধ্যে কেবল টুকটুকি ডাকলে একবার এসে তাকে দেখে যাবে। যা লাগবে দিয়ে বলবে তার নাকি খুব জরুরি জব আছে। তাকে ঘন ঘন ডাকা নাকি নিষেধ!

টুকটুকি তাকে ঘন ঘন তাকে ডাকি না। তার খুব জরুরি জবে ব্যাঘাত ঘটায় না! টুকটুকি তার মা-বাবাকেও কখনো কিছু বলে না। তাছাড়া ফুলবানু এমনিতে ভীষণ ভালো। তার সাথে প্রায় সময় খেলা করে। গল্প করে। টুকটুকিরা নিজেদের মাঝে পুতুলের বিয়ে বিয়ে খেলে। বাবা-মা বাসায় থাকলে সে সবসময় তার আশপাশে থাকে। শুধু বাবা-মা অফিসে গেলে তার খুব জরুরি কাজ পড়ে যায়!

ফুলবানু আজ টিভির সাউন্ড বেশ খানিকটা বাড়িয়ে দিয়ে সিনেমা দেখছে। টুকটুকি তাকে বেশ কয়েকবার ডাকল, সে শুনতে পেল না। টুকটুকির আজ শরীরটাও বেশ খারাপ লাগছে।

ফুলবানুকে ডেকে আর লাভ নেই। তার এই টিভির নেশা এখন আর সহজে কাটবে না। এদিকে টুকটুকির মাথা ব্যথাটা ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে। তার অসুখ হলে কেন জানি ঘন ঘন পানির তৃষ্ণা পায়। পানি সামনে দিলে আর খেতে ইচ্ছে করে না। কেমন জানি তিতা মনে হয়।

অলঙ্করণ: ধ্রুব এষ

ফুলবানু আমায় একটু পানি দেবে। খুব তৃষ্ণা পেয়েছে। এখন আর কাজের মেয়েকে ডাকতে ইচ্ছা করছে না। বিছানায় শুয়ে থাকতেও একটু ভালো লাগছে না। তার কেমন যেন একা একা লাগছে। মাঝে মাঝে তার একা একা লাগে। একা একা লাগলে ভয় লাগে। আর খুব ভয় পেলে তার কান্না পায়। এখনও তার কান্না আসি আসি করছে। সে কান্না ধরে রাখার চেষ্টা করছে। শুধু শুধু কান্না করে তার লাভ কী?

সে সাহস করে বিছানা থেকে নামল। বিছানা থেকে নেমে কাপড়ের জুতাটা নিজে নিজে দুই পায়ে পরে নিল। তার শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে। সে একা একা ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল বের করল। টেবিল থেকে গ্লাস নিল। তারপর কি মনে করে যেন টেবিলে থাকা জগের নরমাল পানি গ্লাসে ঢালতে লাগল। মা ঠান্ডা পানি খেতে নিষেধ করেছে। সে নরমাল পানি কয়েক চুমুক খেয়ে নিল। সে লক্ষ্মী মেয়ের মতো সবকিছু গুছিয়ে রাখল। তারপর টুকটুকি কাউকে কিছু না বলে বাগানে চলে গেল।

তাদের বাগানটা অনেক বড়। অনেক ধরনের ফুল ফুটে আছে। ফুলের গন্ধে কেমন যেন ঘুম ঘুম ভাব চলে আসে। টুকটুকির কী যে ভালো লাগে। অথচ তার মা তাকে বাগানে ঘুরতে দেয় না। তবুও সে চুপি চুপি কাউকে কিছু না বলে বাগানে চলে আসে। বাগানের ফুলদের সাথে সে কথা বলে। ফুলেরা হেলে দুলে তার কথার জবাব দেয়!

সে কখনো এসব কথা অন্য কাউকে বলে না। বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না।

এমন সময় দমকা এক হাওয়া বইতে শুরু করল। মনে হল গাছপালা বাড়িঘর সব উড়িয়ে নিয়ে যাবে। সাথে সাথে চারদিকে এক সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়ল। টুকটুকির চুল বাতাসে উড়ছে। তার কী যে ভালো লাগছে। কিছুটা কাঁপুনি ধরে যাচ্ছে। সে এগিয়ে গেল, এমন সময় সে অদ্ভুত এক জিনিস দেখতে পেল।

পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়ে এক কিশোর রাজপুত্র তাদের বাগানে নেমেছে। এতক্ষণ ভয় না লাগলেও এখন একটু একটু ভয় লাগছে।

রাজপুত্র মিটিমিটি হেসে টুকটুকির দিকে এগিয়ে আসছে। টুকটুকি ভয়ে ভয়ে বলল, তুমি কে গো?

তুমি আমাকে চিনবে না। আমি দূর দেশের রাজকুমার।

রাজকুমার! তো তুমি এখানে কেন?

মা বাবাকে না বলে পঙ্খিরাজ ঘোড়া নিয়ে আকাশে ঘোরাঘুরি করছিলাম। হঠাৎ তোমাদের পৃথিবীটা দেখে নিচে নেমে এলাম। তুমি বাগানের ফুলদের সাথে কথা বলছো দেখে তোমার বাগানে নেমে এলাম।

ওহ্ তাই নাকি। বেশতো তুমিও আমার বাগানের ফুলদের সাথে কথা বলতে পার! এসো রাজকুমার, তোমাকে আমার ফুলদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।

টুকটুকি রাজকুমারকে তার বাগানের সব ফুলদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। অচিন রাজকুমারের সাথে বাগানের ফুলদেরও খুব ভাব হল।

টুকটুকি আর রাজকুমার ডালিম বাগানে একটা ডালিম গাছের নিচে বসে আছে। পঙ্খিরাজ ঘোড়াটা দূরে দাঁড়িয়ে ঘাড় নাড়িয়ে চারপাশ দেখছে। রাজকুমার টুকটুকিকে বলে, তুমি আমার বন্ধু হবে?

বন্ধু হবে বললেই তো আর বন্ধু হওয়া যায় না!

কেন যায় না?

বন্ধু হতে হলে মনের মিল লাগে। তুমি থাকো একদেশে আর আমি থাকি আরেক দেশে আমাদের মনের মিল কিভাবে হবে?

হওয়ালে হবে। আজ থেকে আমরা দুজন বন্ধু।

রাজকুমার ডালিম গাছের পাকা ডালিম দেখিয়ে বলল, এটা কি ঝুলে আছে?

ওহ্ এটা হলো ডালিম।

বল কি!

এটা তো আমার নাম। আমি ডালিম কুমার।

তুমি রাজপুত্র ডালিম কুমার!

হ্যাঁ আমিই রূপকথার সেই ডালিম কুমার।

ছোটবেলায় তোমার গল্প কত শুনেছি। আজ তোমায় প্রথম দেখলাম!

ডালিম ফলটাও যে আমি প্রথম দেখলাম!

তোমাদের দেশে এই ফল নেই, অথচ তোমার মা বাবা তোমার নাম রেখেছে ডালিম কুমার!

আমার মা বাবা বলেছিলেন পৃথিবীতে এ ফল পাওয়া যায় এবং পাকা ডালিম ফল নাকি মানুষের খুব প্রিয়। সেই থেকে আমার নাম ডালিম কুমার।

টুকটুকি বলল, বন্ধু ডালিম কুমার আমি তোমাকে আমার বাগানের পাকা ডালিম দেব। তুমি তোমাদের দেশে নিয়ে যাবে। সেই ডালিমের বীজ থেকে নতুন গাছ হবে। তোমার দেশ ডালিমে ডালিমে ভরে যাবে।

ডালিম কুমার বলল, তাহলে তো বেশ হয়।

আচ্ছা বন্ধু, তুমি এত ভালো মেয়ে আর এমন এক ভয়ংকর অসুখ বাঁধিয়ে বসে আছো! তোমার খারাপ লাগে না?

আমার যে অসুখ তা তুমি জানলে কি করে?

আমি তো তোমার বন্ধু। বন্ধুরা বন্ধুদের সবকিছু জানে!

তুমি আর কি কি জানো, ডালিম কুমার?

আমি জানি একদিন তোমার এ অসুখ পুরোপুরি ভালো হয়ে যাবে। তুমি খালি পায়ে বাগানে আবার ঘুরতে পারবে। বৃষ্টিতে ভিজতে পারবে।

তুমি সত্যিই বলছো তো; ডালিম কুমার?

আমি শুধু শুধু মিথ্যা কেন বলব!

আচ্ছা ডালিম কুমার তুমি কি মানুষের ভবিষ্যৎ বলতে পারো?

হ্যাঁ পারি।

তাহলে তুমি জাদু জানো নাকি?

জানি তো!

উ-উ-হু। তুমি আমাকে বোকা মেয়ে পেয়ে এমনি এমনি মিথ্যা বলছ। আমি ঠিক ধরে ফেলেছি।

তুমি আসলেই বোকা মেয়ে! আমি সত্যি রাজকুমার। তোমাদের রূপকথার বইয়ে আমার সাদা পঙ্খিরাজ ঘোড়া নিয়ে লেখা পড়নি। কাছে এসে দেখ এখানে আমার পঙ্খিরাজ ঘোড়া। এবার তো বিশ্বাস হয়েছে!

হয়েছে তো! ত-বে-এ ডালিম কুমার তুমি আমাকে একটা জাদু দেখাও। এখনি দেখাও। কোন কথা শুনব না।

বন্ধু তুমি সত্যি সত্যি জাদু দেখতে চাও?

হ্যাঁ চাই। জাদু দেখতে চাইতো!

আচ্ছা ঠিক আছে বন্ধু, তোমাকে এক্ষুণি একটা জাদু দেখাচ্ছি।

ডালিম কুমার চোখ বন্ধ করে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কী সব মন্ত্র পড়তে লাগল।

ইকরি মিকরির ছোট ছা

যা বলি তাড়াতাড়ি তা হয়ে যা!

মা মুড়মুড় এই দেশের ভাষার বোল

এইখানে এদের পৃথিবীটা হল গোল

যা পাবার তা পেয়ে যা

ইকরি মিকরির ছোট ছা

স্বর্গের দরজা খুলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যা

সে জাদু কাঠি আমার হাতে এসে যা

সব শিশুরা মায়ের কোলে চলে যা

আমার ইকরি মিকরির ছোট ছা।

ডালিম কুমারের মন্ত্র এটুকু শুধু বোঝা গেল। বাকি মন্ত্রটুকু অন্য ভাষায় পড়া হলো খুব দ্রুত। টুকটুকি তারপরে আর কিছু বুঝতে পারল না। মন্ত্র শেষ হওয়ার সাথে সাথে ডালিম কুমারের হাতে একটা জাদুর কাঠি এসে গেল। ধবধবে সাদা কাঠির মাথায় আকাশের তারা লাগানো। কেমন চকচক করছে! টুকটুকি ভীষণ খুশি হলো। ডালিম কুমার টুকটুকির হাতে জাদুর কাঠি এগিয়ে দিল। এটা হলো জাদুর কাঠি। বন্ধু তুমি যখন যা চাইবে জাদুর কাঠি তখন মুহূর্তে তোমার ইচ্ছা পূরণ করে দেবে! বিশ্বাস না হলে এখনি তুমি কিছু চাও। সাথে সাথে প্রমাণ হয়ে যাবে!

বন্ধু তুমি এই জাদুর কাঠির মাধ্যমে তোমার অসুখ এক্ষুণি সারিয়ে নিতে পারবে!

তুমি কাঠিটি বুকের কাছে ধরে পর পর সাতবার বলো, টুকটুকির অসুখ ভালো হয়ে যাক। টুকটুকির অসুখ এক্ষুণি ভালো হয়ে যাক।

এই এতটুকুতে আমার সব অসুখ সেরে যাবে? আমি আবার আগের মতো ভালো হয়ে যাব। আমি স্কুলে যেতে পারব। আমার বন্ধুদের সাথে খেলতে পারব। বাগানে খালি পায়ে হাঁটতে পারব। বন্ধুদের সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে পারব। সত্যি তো?

হ্যাঁ পারবে। যা বলেছি তা কর বন্ধু। চোখ বন্ধ করে বল!

টুকটুকি কোনো ভুলযোগ ছাড়া ডালিম কুমারের কথা মতো সবকিছু করল। তারপরই তার শরীরটা কেমন যেন শিরশির করে উঠল! মনে হচ্ছে মাথা ব্যথাটা হঠাৎ করে চলে গেছে।

এরপর ডালিম কুমার টুকটুকিকে বলল, এ জাদুর কাঠির কথা তুমি যদি অন্য কাউকে বলো তা হলে কাঠির সব ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে। কাঠিও চলে যাবে!

আমি কখনো কাউকে কিছু বলব না ডালিম কুমার।

আচ্ছা ঠিক আছে।

এরপর টুকটুকি ডালিম কুমারকে জাদুর বিশেষ কিছু দিল না। তার কাছে জাদুর কাঠির মতো কিছুতো নেই। সে দিল তার গাছের পাকা সাত সাতটা ডালিম ফল! ডালিম কুমার এতে মহা খুশি হল। সে খুশিতে বাগানে মাটির উপর লাফাতে শুরু করল।

এক সময় ডালিম কুমারের লাফালাফি থামল। তারা পাশাপাশি বসে আছে। ডালিম কুমার আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো তার দেশের কথা, তার মা বাবার কথা মনে পড়ছে।

ডালিম কুমার তুমি তোমার দেশের একটা গল্প শোনাও।

কি গল্প শুনতে চাও?

রূপকথার কোনো গল্প বলো।

তোমাদের ভূত কিংবা তোমাদের রাক্ষসের গল্প।

আমাদের রূপকথায় কোনো ভূতের গল্প থাকে না। সেগুলো তো রূপকথা নয়, সত্যি। আমাদের রূপকথায় আছে মানুষের গল্প! দানবের গল্প।

সেই গল্পগুলো বলো না ডালিম কুমার।

এমন সময় ফুলবানুর চিৎকার শোনা গেল!

কই আপামনি, কোথায় গেলেন আপামনি! টুকটুকি আপমনি।

মনে হচ্ছে আজ টিভিতে ছবি শেষ হয়ে গেছে। না হয় মায়ের অফিস থেকে ফিরে আসার সময় হয়েছে। ফুলবানু খুঁজতে খুঁজতে এদিকে এগিয়ে আসছে। ডালিম কুমারের পঙ্খিরাজ ঘোড়াটা চিঁ-ই-ই করে ডাক দিল। অমনি ডালিম কুমার একলাফে পঙ্খিরাজে উঠে পড়ল। আর অমনি পঙ্খিরাজ তার বিশাল সাদা পাখা দুটো বের করে আকাশে উড়াল দিল। বাগানের চারদিকে হঠাৎ ধুলোর ঝড়ের মতো সব ঝাপসা হয়ে গেল!

আপামনি এ ধুলাবালির মধ্যে আপনি কি করেন? এই কথা শুনে টুকটুকি মনে মনে একটু হাসলো। এখনি আম্মা চইলা আসব। তাড়াতাড়ি আসেন আপামনি। হাত মুখ ধুয়ে বিছানায় তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে। দুপুরের খাবার খাওন লাগব তো। কতো কাম যে বাকি!

টুকটুকি ফুলবানুর সাথে ঘরে এলো। বাথরুমে গিয়ে ভালোভাবে হাত মুখ ধুয়ে ফেলল। দুপুরের খাবারও খেল। তারপর চুপিচুপি জাদুর কাঠিটা তার কাপড়ের বাক্সের ভিতর লুকিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। তার ঘুম ঘুম লাগছে। লাল কম্বল জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভেঙ্গে দেখে রাত হয়ে গেছে। মা এসে মুখে তুলে খাইয়ে দিল। টুকটুকি আবার ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন খুব সকালে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল।

মাকে ডালিম কুমারের কথা তো এখনো বলা হয়নি। আমার যে অসুখ সেরে গেছে তাও তো জানানো হয়নি!

তারপর টুকটুকি ডালিম কুমারের গল্পটা তার মার কাছে হুবহু বলল। মা তো ভীষণ হেসে কুটিকুটি। মা বাবাকে ডেকে বলেছে, ওগো টুকটুকির বাবা; এখানে এসে শুনে যাও তো। তোমার মেয়ের সাথে পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়ে নাকি কোন রাজপুত্র দেখা করতে এসেছে। সে নাকি জাদুর কাঠিও দিয়ে গেছে! এক্ষুণি টুকটুকির ঘরে এসে দেখে যাও গো!

টুকটুকির ভীষণ রাগ লাগলো, মা ডালিম কুমারের কথা কিছুতেই বিশ্বাস করছেন না। এক্ষুণি সব প্রমাণ হয়ে যাবে। মাকে এক্ষুনি জাদুর কাঠিটা দেখিয়ে দিতে হবে। টুকটুকি লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে ড্রয়ার খুলে কাপড়ের ভিতর জাদুর কাঠি খুঁজতে লাগল। কিন্তু কিছুতে টুকটুকির জাদুর কাঠি খুঁজে পাওয়া গেল না। ঠিক এখানে গতকাল সে নিজে জাদুর কাঠিটা লুকিয়ে রেখেছিল। তবে তা কোথায় হারিয়ে গেল!

তখন হঠাৎ ডালিম কুমারের কথা মনে পড়ে গেল। জাদুর কাঠির কথা অন্য কাউকে বললে তা তো চলে যাবে। টুকটুকির মন খারাপ হল। বেশ অনেক মন খারাপ হল। মাকে না বললে ভালো হতো!

টুকটুকি মায়ের কাছে ফিরে গিয়ে বলল, মা জাদুর কাঠিটা হারিয়ে গেছে। ভুল বলছি। ঠিক হারিয়ে যায়নি, যেখান থেকে এসেছিল সেখানে চলে গেছে! মা আমি একদম মিথ্যা বলছি না। বিশ্বাস না হয় দেখ আমি একদম ভালো হয়ে গেছি। এই কথার পর টুকটুকির মা টুকটুকিকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ আদর করল। মাথায়, কপালে ও গালে চুমো দিল।

মা আমি সত্যি ভালো হয়ে গেছি। ডালিম কুমার আমাকে ভালো করে দিয়েছে।

তারপর এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে গেল। টুকটুকি আবার স্কুলে যেতে শুরু করল। তার বন্ধুদের সাথে গোল্লাছুট, কানামাছি খেলতে শুরু করল। নিয়মিত পড়াশোনা আর হোমওয়ার্ক করতে লাগল। কিন্তু টুকটুকি মাঝে মাঝে একা বাগানে গিয়ে তার বন্ধু ডালিম কুমারের জন্য অপেক্ষা করে। অপেক্ষার ব্যাপারটি সে কাউকে বলে না।

কিছুদিন পর সে শিশু ডাক্তার আবারও টুকটুকিদের বাড়িতে এলো। আবারও টুকটুকির মেডিকেল চেক-আপ করানো হল। এখন ডাক্তার আঙ্কেল আগের মতো মুখ গম্ভীর করে কথা বলেন না। এখন মা তার কথা শুনে হঠাৎ করে কেঁদে ওঠেন না। টুকটুকির অসুখ ভালো হওয়ায় বাড়িতে খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছে। নানা ও দাদাবাড়ির সব আত্মীয় এক এক করে দেখতে আসছে। কতো উপহার নিয়ে আসছে!

সবাই তো অবাক। কি করে অসুখ সারলো সে তো এক বিরাট রহস্য। টুকটুকির অসুখটা ছিল খুব খারাপ ধরণের। বেশ ভয়ংকর সহজে সারার কথা ছিল না। কিভাবে কিভাবে যেন ভালো হয়ে গেল! সবাই যখন মায়ের কাছে জানতে চায়, মা তখন মজা করে বলে দূর দেশের ডালিম কুমার একদিন সাদা পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়ে এসে জাদুর কাঠি দিয়ে আমার টুকটুকি মামণির অসুখ ভালো করে দিয়ে গেছে! সবাই হো হো করে হেসে লুটোপুটি খায়। হঠাৎ হাসি বন্ধ। আবারও হাসি আরম্ভ। হো হো হো। হা হা হা।

টুকটুকিদের পরিবারের কেউ এখনো জাদুর গল্প বিশ্বাস করে না। কিন্তু একমাত্র টুকটুকি জানে জাদুর গল্পটি সত্যি গল্প। তারপরও টুকটুকি অন্য সবার ভুল ভাঙাতে যায় না। সে এখন নিয়ম করে বাগানে একা একা ঘুরে বেড়ায়। ডালিম কুমারের জন্য অপেক্ষা করে। রাজকুমারের জন্যে অপেক্ষা করতে ছোট্ট টুকটুকির কেন জানি ভালো লাগে।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!