একটি পতাকার জন্য লড়াই
ইনতিসার হাসিন চৌধুরী, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published: 16 Dec 2020 10:50 AM BdST Updated: 16 Dec 2020 11:01 AM BdST
-
কোলাজে ব্যবহৃত অলঙ্করণ: সারওয়ানা নাওয়ার চৌধুরী, প্রথম শ্রেণি, ভিকারুননিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজ
-
অলঙ্করণ: সারওয়ানা নাওয়ার চৌধুরী
-
অলঙ্করণ: সারওয়ানা নাওয়ার চৌধুরী
১৯৭১, জুন মাস। কুষ্টিয়ার ছেলে রতন। চার সদস্যের একটি পরিবার। রতন, তার ছোট বোন পদ্ম, মা সরলা আর বাবা হারাণসহ তাদের বসবাস একটি ছোট্ট কুঁড়েঘরে।
রতনের বাবা একজন জেলে। খেটে খাওয়া মানুষ, কখনো খেয়ে কখনো না খেয়ে থাকাটা তাদের কাছে অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। ১৯৭১, জুন মাস চলছে। চারদিকে বাঙালিদের স্বাধীনতার দাবিতে যুদ্ধ ও হানাদার বাহিনীর পৈশাচিক তাণ্ডব।
ইতোমধ্যে কুষ্টিয়ায় হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প বসার খবর মিলেছে। চারদিকে আতংকের ছায়া উঁকি দিচ্ছে। সব মিলে ভয়ানক পরিস্থিতি। এমনি করে দিন কয়েক কেটে যায়। চারদিকে হানাদার বাহিনীর টহল বেড়ে যায় ক্রমশ।
রতনের বাবা প্রতিদিনের মতো এক সকালে মাছ ধরতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এমনিতেই চারদিকে যুদ্ধের দামামা, আর অন্যদিকে তারা ধর্মে মুসলমান নয় বলে এক আতঙ্ক। রতনের মায়ের মন আতঙ্কে কেঁপে ওঠে। সরলা স্বামীকে বলে, ‘সাবধানে যাইয়ো, বিপদ কিন্তু আসতিসে...আমাদের মতো মানুষের আরও গজব। ইশ কবে যে ওই পাকিস্তানি জালিমরা দ্যাস ছাড়বো ভগনবানই জানে।’
রতনের বাবা বলল, ‘চিন্তা কইরনা, তুমরা সাবধানে থাকিও। আমি আইলাম একটু বাদেই।’ রতনের বয়স ১৩, পদ্মের বয়স ৭। তাদের দিকে মুচকি হেসে রতনের বাবা বিদায় নিলো। রতন মাকে হঠাৎ বলে উঠল মাগো, ‘বাবার জন্য চিন্তা হসসে। বাবার আইজ কাজে না গেলে কি হত?’ রতনের মা বলল, ‘মাথা ঠিক আসে তর? বাবা কাজে না গেলি পরে সকলে খাব কেমনে?’
রতন তার মনের ভেতর হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এক আগুনের পিণ্ডকে জ্বলতে অনুভব করল। মনে মনে ভাবতে লাগলো, এ কেমন বিচার পাকিস্তানিদের? ওরা থাকুক ওদের মতো, আমরা থাকি আমাদের মর্জি মতো। আমাদের কি স্বাধীনতা পাবার জন্য রক্তের শেষ বিন্দুও দান করতে হবে? না, না আমরা একদিন স্বাধীন হবই। যারা দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারে, তারা স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনবেই। ধ্বংস হবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তার মন যেন আকুল হয়ে উঠছে নিজের মাতৃভূমির জন্য, দেশের জন্য ও দেশের মানুষের জন্য।
সন্ধ্যা নেমে এল। রতনের বাবা মাছ ধরা শেষে বাড়ি ফেরার পথে। এমন সময়ে তার পথ আগলে দাঁড়ালো কয়েকজনের এক হানাদার দল। সঙ্গে ছিল দেশদ্রোহী দু-একজন বাঙালি রাজাকার। তারা হারাণের দিকে এক পৈশাচিক হাসি হেসে বলল, ‘এই ব্যাটা জেলে সন্ধ্যাবেলায় কি করিস এখানে? হিন্দু না মুসলিম?’
চরম ভীতি মনে লুকিয়ে হারাণ জবাব দিল, ‘হিন্দু’। রাজাকার বলে উঠল, ‘লজ্জা করে না, হিন্দু হয়ে পাকিস্তানে আছিস? এটা হিন্দুস্থান না। এটা পাকিস্তান।’ বলেই রাজাকার মিলিটারিদের বলল, ‘লে যাইয়ে ইসকো, ব্যাটা হিন্দু হ্যাঁয়।’

অলঙ্করণ: সারওয়ানা নাওয়ার চৌধুরী
হারাণ দৃঢ়চিত্তে বলে, ‘আমি বাঙলায় জন্ম নিয়েসি। মৃত্যু হইলেও বলে যাব জয় বাংলা, বাংলার জয় হবেই।’ তারপর সেই হতদরিদ্র মানুষটির এক গুলিতেই নিভে যেতে পারত জীবন প্রদীপ যেখানে, সেখানে দানবীয় আক্রোশে ৫-৬টা গুলিতে ছিন্ন-বিছিন্ন করল তার শরীর সেই জন্তুর দল।
চারদিকে হইচই। কুষ্টিয়ার প্রথম শহীদ হারাণ। নদীর পাশে দেখা মিলেছিল হারাণের নিথর দেহটি। হারাণের প্রাণহীন দেহটির পাশে বসে ছিল তার শোকে স্তব্ধ পরিবারটি। তাদের ঘিরে দাঁড়ানো অশ্রুসিক্ত পুরো গ্রামবাসী। হারাণের স্ত্রী সরলা যেন হাহাকারের ভাষা হারিয়ে এক নিস্তব্ধ পাথর। আর রতন? চোখের পানি তার শুকিয়ে গেছে এরই মধ্যে। এখন যেন সে সংকল্পবদ্ধ, তার বাবার খুনিদের সে শাস্তি দেবেই। এ বাংলা থেকে উৎখাত করতে হবে মানুষরূপী এই নরপিশাচদের।
বাড়ি ফিরে রতন তার মাকে বলল, ‘যাদের জন্য তোমার-আমার মতো কতো স্ত্রী হয়েছে স্বামীহারা, সন্তান হয়েছে পিতৃহারা। তাদের সঙ্গে সামনে থেকে লড়তে হবে ছোট-বড় সবাইকে।’ কিন্তু রতনের মায়ের বুক ভয়ে কেঁপে উঠল। মা বলল, ‘বাবারে তুই আমাদের পরিবারের একমাত্র ভরসা। যদি…। আমি আর কাউকে হারাতে চাই না।’
কান্নায় ভেঙে পড়ে রতনের মা। রতন বলে, ‘মাগো, তোমার আমার এমন হাজারো মানুষের কষ্ট মোচন করতে আমাদের অনেক আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়ে হলেও হানাদারমুক্ত করতে হবে আমাদের এ বাংলাকে। স্বাধীন বাংলায় একটি স্বাধীন পতাকার যে বড় স্বাদ আমার। যেখানে থাকবে না কোন ধর্ম-জাতির ভেদাভেদ।’
একথা শুনে রতনের মা আর যেন ছেলেকে বাধা দিতে পারে না। পরদিন ভোরে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে রতন তার মা ও ছোটবোন পদ্মকে রেখে এক অনিশ্চিত গন্তব্যে অনিশ্চিত জীবন নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। রতনের মা মনে মনে ভাবে এই বুঝি ছেলের সঙ্গে শেষ দেখা!
দু-চারদিন কেটে যাওয়ার পর রতনের সাক্ষাৎ মেলে এক মুক্তিবাহিনীর। আজ যেন তার লক্ষ্যের প্রথম ধাপ উত্তীর্ণ হলো। সদ্য পিতৃহারা রতনের জীবনের করুণ কাহিনী, তীব্র দেশপ্রেম ও বীর মানসিকতার কারণে মুক্তিবাহিনীর লোকেরা রতনকে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে গেল। সেখানে বেশ কিছুদিন ধরে চলল তার প্রশিক্ষণ। অবশেষে মিশনের কনিষ্ঠতম সদস্য হিসেবে যুক্ত করা হয় অদম্য সাহসী কিশোরটিকে।
একদিন পরিকল্পনা করা হলো একটি বড় মিশন সম্পন্ন করার। সিদ্ধান্ত হলো ধ্বংস করার পাকিস্তানি সেনাদের এক বৃহৎ কর্মযজ্ঞের। অনুমতি না থাকলেও সেদিনের সে মিশনে রতন লুকিয়ে নিজের সঙ্গে বন্দুক ও কিছু গ্রেনেড নিয়ে তাদের পিছু নেয়। মিশনটা যে কতটা ভয়াবহ ছিল তা রতন জানত। কিন্তু দেশের টানে সে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারল না।

অলঙ্করণ: সারওয়ানা নাওয়ার চৌধুরী
চরম বিস্ফোরণ ঘটে। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা হতভম্ব। এ কীভাবে সম্ভব? এত ছোট ছেলে এত বড় মিশনের এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়ে কাজে আসছে? যুদ্ধ চলতে থাকে। রতনের হাতের মেশিনগান কমপক্ষে ৭ জন মিলিটারিদের মেরেছে। তার এই অদম্য, অভাবনীয় সাহসিকতার ফলে পাকিস্তানিদের এই ক্যাম্পটি প্রায় ধ্বংসের পথে চলে গিয়েছে।
কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। একটা শক্তিশালী গ্রেনেড এসে পড়ে রতনের পাশে। তার শরীরের একপাশ মারাত্মক ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। কিন্তু তার হাতের মেশিনগানটা ও প্রাণটুকু তখনো বলবত রয়েছে। রতনের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, মৃত্যু আসার শেষ মুহূর্তেও সে থামবে না। যে পৈশাচিক শক্তি তার পরিবারকে, তার দেশকে ধ্বংস করে দিয়েছে এবং দিচ্ছে তাদের সে ছাড়বে না। তার হাতের মেশিনগানটি চলতে থাকে। মুক্তিবাহিনী রীতিমত অবাক। এ কেমন ছেলে, যার এত দৃঢ় পণ!
এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনীর এক গুলি এসে লাগে রতনের বুকের বাম পাশে। সব কিছু নিস্তব্ধ। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা রতনের কাছে ছুটে যায়। তখনো রতনের প্রাণ ছিল। কিন্তু কোন আশা ছিল না। অনবরত রক্তক্ষরণ হচ্ছে তার শরীর থেকে। সে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের খুব কষ্টে বলে, ‘আমি আমার দেশের জন্য প্রাণ দিলাম। আমার দৃঢ় প্রত্যাশা, এ দেশ একদিন স্বাধীন হবেই। এমন এক সূর্য উদিত হবে যার আলো থাকবে শুধু আমাদের জন্য। আমার পরিবারকে জানিয়ে দেবেন।’ বলেই চিরনিদ্রায় চলে যায় রতন।
আজ ১৬ ডিসেম্বর। আমরা আজ স্বাধীন। চারদিকে লাল-সবুজের ছড়াছড়ি। রতনের মায়ের হাতে একটি বড় পতাকা। পদ্মের হাতেও ছোট একটি পতাকা। রতনের মা কিছুক্ষণ পতাকার দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই পদ্মকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকেন।
লেখক পরিচিতি: ছাত্র, সপ্তম শ্রেণি, উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়
কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না! |