পিপীলিকা কাহিনি

ক’দিন ধরে খুবই অশান্তিতে আছে দীপ। ঘরে পিঁপড়ের এতো আনাগোনা হয়েছে যে টেকা দায়।

মাহীর আলী রুশোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Dec 2020, 04:21 PM
Updated : 10 Dec 2020, 04:21 PM

এতোদিন এমন ছিল না, হঠাৎ করেই যেন হয়েছে। বেশ বড়ো সাইজেরই বলা চলে, সাদাটে রঙের। এমন পিঁপড়ে সে আগে কখনও দেখেনি। কয়েকদিন পরই অন্য ফ্ল্যাটে চলে যাওয়ার কথা তার, তাই আর অতো মাথা ঘামায়নি।

এখন দেখা যাচ্ছে একটা দিন কাটানোও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। শেষ অবধি পিঁপড়ে মারার পাউডারও কিনে আনে, কিন্তু যে কে সেই। পোকামাকড় নিয়ে ভয়ের কোনো ব্যাপার নেই দীপের, তবে পিঁপড়েকে সে বিশ্বাস করে না। ছোটো থেকে জানতো লাল পিঁপড়েরা বদমাশ হয় আর কালোগুলো নিরীহ।

কিন্তু একবার তার এক বন্ধুর হাতে কালো রঙের দাঁড়াওয়ালা একটা পিঁপড়ে এমন কামড়ে দিয়েছিল, তারপর থেকে দীপ সমঝে চলে। আর এগুলো এমন অদ্ভুত রঙের যে আগে কখনও দেখেনি, সাবধানে থাকাই ভালো। বিষটিষ আছে কিনা কে জানে!

এ ফ্ল্যাটে তার সঙ্গে আরো তিনজন থাকে, তাদের আবার ট্রেকিং এর শখ আছে। মনে মনে ভাবে দীপ, এরাই নির্ঘাত এমন পিঁপড়ে নিয়ে এসেছে কোথাও থেকে। কোথায় লাগেজের মধ্যে করে চলে এসেছে হয়তো। তারা আবার বাড়িতেও নেই এখন, আবার কোথাও একটা গেছে। অগত্যা সব ঝামেলা এখন তার। ঠিক আছে, দুদিনের তো ব্যাপার। তারপর এরা মজা টের পাবে।

শরবত খেতে খেতে দীপ ল্যাপটপে কাজ করছিল। অফিস থেকে একটা ফোন আসায় তড়িঘড়ি করে রিসিভ করতে গিয়ে গ্লাস থেকে কিছুটা শরবত ছলকে পড়ে টেবিলের উপর। বিরক্ত হয়ে সে ল্যাপটপটা নিয়ে অন্য ঘরে গিয়ে ফোনের কাজটা সেরে নেয়। এসে দেখে কয়েকটা পিঁপড়ে জড়ো হয়েছে, টেবিলের উপর যেটুকু শরবত পড়েছে সেটাকে ঘিরে।

দেখেই রাগ ধরে যায় দীপের। হাতের কাছে একটা খালি বাক্স থাকায় সেটা দিয়ে পিঁপড়েগুলোকে মেরে দেয় দীপ। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, পরিষ্কার করার সময় দেখে কিছু পিঁপড়ের পেটের দিকটা কমলা হয়ে আছে, আর কিছু পিঁপড়ের সাদা।

বেশ ইন্টারেস্টিং লাগে তার। এগুলো তো সেই পিঁপড়েগুলোর মতো যাদেরকে স্বচ্ছ পিঁপড়ে বলা হয়। যে রঙের খাবার খায়, সেই রঙের হয়ে যায় পেটটা। তবে সেসব অন্যদেশে থাকে, আফ্রিকা, কানাডা, ফ্লোরিডা। তাদের আকারও বেশ ছোটো, আর এখানে তো এমনটা আসার কথা নয়।

পরীক্ষা করার জন্য মেঝের একটা কোণে কিছুটা চিনি-গোলা জল ফেলে তার রং করার শিশি থেকে তাতে একফোঁটা নীল রং ঢেলে দেয় আর পাশে বসে ল্যাপটপে কাজ করতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পর কয়েকটা পিঁপড়ে জড়ো হয় সেখানে। অতি সন্তর্পণে ভালো করে দেখে যা ভেবেছে তাই, কয়েকটার পেট নীল হয়ে গেছে। এরা তার মানে খেয়ে নিয়েছে নীল জলটা।

সন্ধ্যেবেলায় টিভি দেখতে দেখতে হঠাৎই একটা পচা গন্ধ এসে নাকে লাগে। এদিক ওদিক দেখতে দেখতে রান্নাঘরে এসে দেখে গ্যাস সিলিন্ডারের পেছনের দিকের কোণে একটা মাঝারি সাইজের ইঁদুর মরে পড়ে আছে। গা গুলিয়ে ওঠে দীপের। এটাকে এখন তুলে ফেলতে যেতে হবে বাইরে। হাতে একটা প্লাস্টিক পরে ফেলতে গিয়ে দেখে ইঁদুরটার পেটের দিকে বেশ কিছুটা জায়গা আবার খোবলানো। দেখেই কেমন লাগে!

পরদিন বেলার দিকে একটা দরকারি কাজে নিচে যেতে গিয়ে দেখে সিঁড়ির পাশে একটা বেড়াল মরে পড়ে আছে, তারও পেটটা খোবলানো। কিছুতে খেয়েছে যেন। অ্যাপার্টমেন্টের কেয়ারটেকারকে বলায় সে পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করে দেয়। তবে বেড়ালটাকে দেখে কাল সন্ধ্যেবেলার ঘটনাটা মনে পড়ে যায় দীপের। পেটের জায়গাটা একইরকম খোবলানো। একটু ভয় ভয় লাগে তার। যাতেই এরকম করে থাকুক না কেন, সেটা ওর ফ্ল্যাটের মধ্যেই আছে। আর এখন ওর রুমমেটরাও কেউ নেই।

দুপুরে খাওয়ার পর বাসন মাজতে গিয়ে সিঙ্কের পাশে গোটাকতক পিঁপড়েকে ঘোরাঘুরি করতে দেখে দীপ। সেইদিনের ঘটনার পর থেকে পিঁপড়েগুলোকে দেখলে আগে ওদের পেটের দিকেই চোখ যায়। আজও সেরকম দেখতে গিয়ে দেখে পেটটা লাল হয়ে আছে। বাসন ধুতে ধুতে ভাবতে থাকে দীপ। আজ তো লাল রঙের কোনো খাবার বানায়নি, খিচুড়ি আর ডিমভাজা খেয়েছে। টম্যাটোগুলো খেয়ে নিল নাকি!

কিন্তু তা কিভাবে খাবে, টম্যাটো তো ফ্রিজে। তাও ফ্রিজ খুলে দেখে, ও বাবা, টম্যাটো তো নেই-ই। তাই তো, কাল সকালেই তো শেষ হয়ে গিয়েছিল। রাতে হোম ডেলিভারি আনিয়েছে, খিচুড়িতেও দেয়নি। তাহলে লাল কি খেলো পিঁপড়েগুলো!

হঠাৎ করে বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে দীপের। ইঁদুর আর বেড়ালের কীর্তিটা এদের নয়তো! ভয় পেয়ে সরে আসে ওখান থেকে। পিঁপড়েগুলো এমন ভয়ানক হলে তো ওরও অমন হাল করে দিতে পারে। তারপর থেকে একটা আতঙ্ক ঢুকে যায় দীপের মনে। সকাল বিকেল যখনই কাজে বসে মশারি টাঙিয়ে রাখে, তার মধ্যে বসে। তাও ভয় যায় না। পেট খুবলে খেয়ে নিচ্ছে, মশারি আর এমন কি ব্যাপার এদের কাছে!

তবুও বাঙালির মশারি ভরসা। নতুন ফ্ল্যাটের মালিককে ফোন করে জিজ্ঞাসা করে সেখানে পিঁপড়ের উৎপাত আছে কিনা। যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। ওসব দুর্ভোগ নেই ওখানে। দুদিন কোনোমতে কাটিয়ে দিয়ে নতুন ফ্ল্যাটের দিকে রওনা দেয় দীপ। ইতোমধ্যে তার পুরনো রুমমেটরাও এসে গেছে। দীপের যাওয়া ছিল বিকেলে, কিন্তু ওরা সকালে ফিরে আসায় তারপরই বেরিয়ে পড়ে সে।

তারাও অবাক, এতো তাড়াহুড়োর কি ছিল! কিছুক্ষণ গল্প করা যেতো না হয়। সে যাই হোক, নতুন ফ্ল্যাটটা অফিসের কাছেই। যাতায়াতে সুবিধা হবে, ওই জন্যই আসা। দীপ এসেই রুমমেটদের থেকে যাচাই করে নিশ্চিন্ত হয় যে এখানে পিঁপড়ের কোনো ঝামেলা নেই।

এক সপ্তাহ ভালোই কাটলো বেশ। শনিবার বিকেলবেলা, ল্যাপটপে একটা মুভি দেখছে। দীপের এখানে দুজন রুমমেট। একজন বাড়ি গেছে, আরেকজন গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে বেড়িয়েছে। হঠাৎ জানলার উপর চোখ পড়ে যেতেই দীপ তটস্থ হয়ে যায়। সেই পিঁপড়ে! না না, চোখের ভুল নয়। সেইরকম রং, সেইরকম আকার। দীপ মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখতে থাকে। সামনে দিয়ে একটা টিকটিকি আসে, মনে হয় পিঁপড়েটাকে খাবে বলে এসেছিল।

দীপের মনে হলো ও স্পষ্ট দেখলো পিঁপড়েটা সামনের দাঁড়া দুটোকে সোজা করতেই টিকটিকিটা পালিয়ে গেল। কিন্তু ওর রুমমেট কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না। এতোদিন ধরে আছে এখানে, কোথায় পিঁপড়ে!

দীপের মনে হতে লাগলো ওকে সবাই পাগল বলে ধরে নিয়েছে। সারাদিন মশারির মধ্যে বসে থাকে, সারা ঘরে পিঁপড়ে মারার পাউডার ছড়িয়ে বেড়ায়। ওর রুমমেটরা বিরক্ত হয়ে ফ্ল্যাটের মালিককে অভিযোগ করায় ওকে অন্য জায়গায় উঠে যেতে বলেছে। ওর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে পিঁপড়েদের উপর। যেখানেই যা পিঁপড়ে দেখে, মেরে বেড়ায়।

নাহ্, এখানে আর কাজ করা সম্ভব হলো না দীপের। ওর মনে একটা ভীষণ ভয় ঢুকে গেছে। সবসময় মনে হয় যেন পিঁপড়েগুলো ওকে লক্ষ্য রাখছে, সুযোগ পেলেই পেটটা খুবলে নেবে। রাতে ভালো ঘুম হয় না, মাঝেমধ্যে দুঃস্বপ্নও দেখে। অগত্যা ব্যাঙ্গালোর থেকে কলকাতা রওনা দিল। তার বারবার ভয়ার্তদৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকানোয়, লাগেজগুলো বারবার পরিষ্কার করায় আশপাশের লোকজন বিরক্ত হতে লাগলো তার উপর।

কিন্তু দীপের সেদিকে হুঁশ নেই। তার একটাই চিন্তা, পিঁপড়েগুলো আবার পিছু নিল না তো!

লেখক পরিচিতি: ছাত্র, সপ্তম শ্রেণি, মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!