মাস্ক এলো কেমন করে
শেখ আনোয়ার, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published: 03 Dec 2020 10:42 AM BdST Updated: 03 Dec 2020 10:42 AM BdST
-
কোলাজে ব্যবহৃত ছবি: ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু মহামারীর সময়ে তোলা দাবি করে সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া কিছু ছবি
-
উ লিয়ান থে (১৮৭৯-১৯৬০), ছবি- উইকিপিডিয়া
মহামারীতে বিশ্বজুড়ে এক টুকরো মাস্ক হয়ে ওঠেছে নিয়মিত পোশাক। মাস্ক পরা এখন বাধ্যতামূলক। স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা তাদের সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার করলেও সাধারণ লোকের মাস্কে চলে এসেছে নানা রঙ-নকশা। স্পোর্টস দলের লোগো, সুপারহিরো বা নানা বাণী মুদ্রিত মাস্ক দেখা যায় এখন।
মহামারীতে আমরা যে মাস্ক পরছি তার একটা ইতিহাস আছে। উনিশ শতকের শেষের দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুতে দমকলকর্মী ও সৈন্যদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম হিসেবে এ মাস্ক ব্যবহার করা হতো। প্রথম সার্জিক্যাল মাস্কটি আসে ১৮৯৯ সালে, যখন কার্ল ফ্লেজ (১৮৪৭-১৯২৩) যক্ষ্মার জীবাণু সম্পর্কিত সংক্রমণের তত্ত্বটি আবিষ্কারের গবেষণা চালাচ্ছিলেন।
এ তত্ত্বটি প্রমাণ করেছিল যে অণুজীবগুলো শ্বাসযন্ত্র থেকে ছিটকে বাষ্পকণা হিসেবে অন্য ব্যক্তির কাছে পৌঁছতে পারে। ফ্লেজ, তার শিষ্য এবং উত্তরসূরিরা আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে জানান যে- কথা বলা, কাশি দেওয়া, ফুঁ দেওয়া এবং হাঁচি দেওয়ার সময় বিশেষত জলীয় কণাগুলো বাতাসে ভেসে বেড়ায়।
যাই হোক, মহামারীর সময় আমরা যে মাস্ক পরতে শিখেছি তার কারণ হলেন মালয়েশিয়ার পেনাং শহরে জন্মানো চীনা চিকিৎসক উ লিয়ান থে (১৮৭৯-১৯৬০)। তার আসল নাম ‘গো লেয়ান টাক’। লিভারপুলে ‘স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন’-এ স্যার রোনাল্ড রস এর অধীনে এক বছর পোস্ট-গ্রাজুয়েট রিসার্চ করেন তিনি। তারপর ম্যালেরিয়া ও টিটেনাস নিয়ে গবেষণা করেন প্যারিসের পাস্তুর ইনস্টিটিউটে।
১৯১০-১১ দুই বছর চীনে ‘মনচুরিয়ান প্লেগ’ নামে এক মহামারী চলে। ক্যাম্ব্রিজ-পাশ তরুণ উ লিয়ান থে প্লেগ আক্রান্ত এলাকা কিছুদিন সরেজমিনে ঘুরে দেখলেন। তারপর যে বার্তা দিলেন তাতে অনেক চিকিৎসক-বিজ্ঞানীদের ভ্রু কুঁচকে গেলো। হাসপাতালে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত এ তরুণ চিকিৎসক প্রথম বলেন, ‘মাস্ক পরলেই আটকানো যাবে মহামারী।’
উ লিয়ান বুঝতে পেরেছিলেন যে মানুষের মধ্যে রোগটি কত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি জানালেন, ‘এই প্লেগের বৈশিষ্ট্য অন্য প্লেগ থেকে ভিন্ন। এটা অসুস্থ প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে এলেও রোগ ছড়ানোর জন্য এখন মানুষ-বাহক আর দরকার হচ্ছে না। বাতাসে ছড়াচ্ছে রোগ। এটা নিউমোনিক প্লেগ। রোগ আটকাতে নাক-মুখ ঢাকতে হবে। মাস্ক পরতে হবে।’
লিয়ান অল্প বয়সি হওয়ার কারণে প্রায় সব চিকিৎসক তাকে অবজ্ঞা ও অপমানিত করেছিলেন। এদিকে মহামারী আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর পুরো এলাকাজুড়ে চিকিৎসকরা মাস্ক না পরেই রোগীদের চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এদের নেতৃত্বে ছিলেন ফরাসি চিকিৎসক জারাল্ড মেসনি। তিনি মাস্ক ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তায় বিশ্বাস করতেন না, তিনি উ লিয়ানকে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছিলেন এবং বর্ণবাদী আচরণ দিয়ে অপমান করেছিলেন। মেসনি প্লেগ হাসপাতালের অসুস্থদের সেবা দিতেন, কিন্তু মাস্ক না পরেই। ফল হিসেবে মেসনি এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন কিছুদিনের মধ্যেই।
চিকিৎসক মেসনির মৃত্যুতে গোটা চিকিৎসক সম্প্রদায় হতবাক হয়ে পড়। মাস্ক ব্যবহারের পক্ষে সমর্থন দ্রুত বাড়তে থাকে। চিকিৎসকরা সতর্ক হওয়া শুরু করলেন, মাস্ক পরা আরম্ভ করলেন। এর ৭ মাস পর প্লেগ নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। মনচুরিয়ান প্লেগ মহামারী চলার সময় উ লিয়ানের নকশা করা গজ মাস্ক পরতেন চিকিৎসকরা।
নয় ইঞ্চি চওড়া দুটো সার্জিক্যাল গজের টুকরোর মাঝখানে ছয় ইঞ্চি বাই চার ইঞ্চির একটি তুলোর টুকরো রেখে সেলাই করে ওই মাস্ক তৈরি করা হতো। এটা দিয়ে নাক থেকে শুরু করে থুতনির নিচ পর্যন্ত ঢাকা থাকতো। সার্জিক্যাল গজের দুই প্রান্ত দড়ির মতো করে কাটা থাকতো, যাতে কানের উপর দিয়ে নিয়ে মাথার পেছনে বাঁধা যায়।

উ লিয়ান থে (১৮৭৯-১৯৬০), ছবি- উইকিপিডিয়া
মাস্কের আবিষ্কর্তা চীনা চিকিৎসক উ লিয়ান থে এভাবেই বিস্তারিত লিখে গেছেন নিজের ডায়রিতে। শুধু মাস্ক পরার প্রচলনই নয়, লিয়ান থে-র কারণেই প্লেগ নিয়ন্ত্রণ ও মহামারীর গোটা বিষয়টার রহস্যভেদ করা বিজ্ঞানীদের পক্ষে সহজ হয়। নোবেল পুরস্কারের জন্য তার নামও মনোনীত হয়। তার দেখানো পথ ধরে এখনও গোটা বিশ্বে ইনফ্লুয়েঞ্জা, স্প্যানিশ ফ্লু থেকে শুরু করে, সার্স ও হালের করোনাভাইরাস রুখতে কাপড়ের মাস্ক ব্যবহৃত হচ্ছে। ঠিক যে পদ্ধতিতে লিয়ান থে ‘অ্যান্টি-প্লেগ মাস্ক’ তৈরি করেছিলেন আজও চলছে সেই পদ্ধতিই। একটুও বদলায়নি।
১৯৬০ সালে মালয়েশিয়ায় নিজ গ্রামে মারা যান মাস্ক আবিষ্কারক বিজ্ঞানী উ লিয়ান থে। তিনি নেই। কিন্তু তার মাস্ক আজও মানুষের নাকে-মুখে বসে করোনাভাইরাস জীবাণু সংক্রমণ প্রতিরোধে সার্বক্ষণিক পাহারাদার হিসেবে কাজ করছে।
লেখক পরিচিতি: গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না! |
সর্বাধিক পঠিত
- তোমার নামের অর্থ কী?
- পিঁপড়া ও ডায়নোসরের গল্প
- জালাল উদ্দিন রুমির ৩০টি অমিয় পংক্তি
- এ পি জে আবদুল কালামের ৩০টি অমিয় বাণী
- চারটি মজার গল্প
- পথশিশুদের নিয়ে অভিনব ‘পথের ইশকুল’
- উড়ুক্কু সাপ ও পিরামিড রহস্য: শেষ কিস্তি
- অংক, সংখ্যা আর গণিতের খেলা
- একটি ভূতের গল্প লেখার পরের ঘটনা
- বঙ্গবন্ধুর বাংলা জন্ম তারিখ কি আমরা জানি!