মা-ছেলের সংসার ‘কালো মেঘের ভেলা’

কবি নির্মলেন্দু গুণের তিনটি কবিতার চলচ্চিত্রায়িত রূপ আমরা পেয়েছি; ‘হুলিয়া’, ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ ও ‘শত্রু শত্রু খেলা’। আর তার কিশোর উপন্যাস ‘কালো মেঘের ভেলা’ এর স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্ররূপ দিয়েছেন মৃত্তিকা গুণ।

পিয়াস মজিদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Nov 2020, 07:47 AM
Updated : 28 Nov 2020, 07:47 AM

উপন্যাসটি যেমন কিশোর চরিত্রের অনুপম উদ্ভাসে ভরপুর, মৃত্তিকার এ চলচ্চিত্রটিও বাংলা চলচ্চিত্রে কিশোর-পরিসরকে ব্যাপ্ত করেছে নিঃসন্দেহে। রেলস্টেশনের কু-ঝিকঝিক জীবন। বাবা-হারা ছেলে দুখু৷ মা বাধ্য হয়েছিল দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে। সৎ বাবা যতটা ক্ষিপ্ত দুখুর উপর, দুখু যেন তারও চেয়ে বেশি৷

আর দুখুর অভিমান এবং ক্ষোভের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে অসহায়, মমতাময় মায়ের উপর। মা-ছেলের এমন রসায়ন উপন্যাসে নির্মলেন্দু গুণ আর চলচ্চিত্রে মৃত্তিকা গুণ যে অনন্য দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন যে তা যে কোনো দর্শককে স্থানকাল-অবস্থান ভুলে প্রতিস্থাপন করবে পারিবারিক প্রেক্ষণিতে৷

দুখু আর দশটা সাধারণ ছেলের মতো না৷ সে রেলস্টেশনের পরিত্যক্ত গদিতে ঘুরে বেড়ায়। ঘর তার কাছে একটা সীমাবদ্ধ ঠিকানা। কিন্তু ঘর তার কাছে অসীম মা-ও, যে নিজে বাঁধা আছে দুঃসহ সংসারের পরিধিতে৷ ভেতরে ভেতরে মাকে ভালোবেসেও সে তাই মায়ের হাতের অন্ন গ্রহণে গড়িমসি করে। দুখুর প্রাণান্ত দৌড় আর ভাতের থালা হাতে মায়ের ব্যাকুল পদবিক্ষেপ, এক অভূতপূর্ব দৃশ্যব্যঞ্জনার জন্ম দিয়ে চলে।

ওদিকে সৎ বাবার সঙ্গে দ্বন্দ্ব যেন দুখুকে দেখায় পৃথিবীটা কেবল মায়ের মতো মমতাবান নয়, সৎ বাবার মতো ভীষণ প্রতিপক্ষও বটে। দুখু রেলস্টেশনে কুলির কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায়, দুখু ছিন্নমূল শিশুকিশোরের অঘোষিত সর্দারের দায়িত্ব পালন করে, দুখু কুটিল সৎ বাবার সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। দুখুর দুরন্তপনার ফল ভোগ করে তার ভালমানুষ মা। স্বামীর পীড়নে সে মৃতপ্রায়, তবু ছেলের জন্য স্নেহবুভুক্ষ মার হাহাকার কোনো হিসেব মানে না।

দুখু পালায়। কিন্তু মায়ের কাছ থেকে পালিয়ে সে কতদূর যাবে? অভিমান করলেও মা-ই তো তার চেনাজানা স্বচ্ছন্দ পৃথিবী। তবু দুনিয়াটা তো মস্ত বড়। দুখু দূর গ্রামের এক গৃহস্থবাড়িতে আশ্রয় এবং ছোটখাট কাজ পায়। সঙ্গে তারই সমবয়সী আর একটি ছেলে৷ তারা গরু চড়ায়, মাঠে ঘুরে আর বটতলায় সাধুর ধ্যান দেখে তন্ময় হয়ে। নদীতে এক বেদেনীর নৌকোর সংসারে বৃষ্টিমাখা দুপুরে ভাত খেতে গিয়ে দুখুর নাকে এসে কি লাগে মায়ের ভাত বাড়ার সুবাস?

দুখু মাঝরাতে অস্থির হয়ে মাকে খুঁজে ফেরে। কিন্তু মা কাছের হয়েও তো গহীন সুদূর। মাঝে বয়ে গেছে ধূ ধূ রেলপথ। আচ্ছা, কু-ঝিকঝিক স্বরে মা-ই কি ডাকছে তার আদরের ছেলে, দুখুকে? দুখু এতকাল মায়ের সঙ্গে কথা বলেছে অভিমানাহত স্বরে। মায়ের অসহায়ত্ব সে বুঝতে চায়নি। কিন্তু আজ তারই জন্য অপত্য স্নেহের ধারা বহাতে গিয়ে দুর্বৃত্ত স্বামীর হাতে লাঞ্ছিত হয়ে মা এখন এক শায়িত রক্তনদী। দুখুকে সে প্রাণের বেশি ভালোবাস বলেই সে চায়, এই নরকের রাস্তাঘাট ছেড়ে দুখু চলে যাক দূরে, তার দৃষ্টিসীমার বাইরে, জীবনে ‘সুখু’ হোক সে।

কিন্তু দুখু এতকালের সব অভিমান ভুলে আজ থেকে যে থাকতে এসেছিল মায়ের কাছে। ভীষণ শক্তপোক্ত এবং আমাদের অভ্যস্ত চোখে বেমানান কঠিনপ্রাণ ছেলেটার চোখে হঠাৎ অসহায় অশ্রুর অবিরাম ফোয়ারা বইতে দেখে বিমূঢ় হতেই হয়৷ তার পায়ের নিচের সব মাটি সরতে থাকে যেন মায়ের বলা দূরে চলে যাবার প্রস্তাবে কারণ মা-ই তো তার একমাত্র মাটি, পৃথিবী আর দিগন্তবিশাল।

সৎ বাবা আর নিষ্ঠুর বর্তমান থেকে ছেলেকে বাঁচাতে অবশেষে মা তাকে তুলে দেয় ট্রেনে, অজানা গন্তব্যে। দুখুর তারস্বর চিৎকার মায়ের বুক ভেঙে দেয়, কিন্তু মাকে ছেলের জীবনের জন্যই পিছুটান ত্যাগ করে আবার ফিরতে হয় নরকের কুণ্ডে। রাতে হয়তো মাতাল স্বামীর মারধর বরাদ্দ তার। আর কাল থেকে আর দুখুর পেছনে দুটো ভাত নিয়ে ছুটে বেড়ানোর আনন্দও থাকবে না তার জীবনে।

ট্রেনটা চলে যায়, মার সঙ্গে দুখুর বিচ্ছেদিয়া কান্না কু-ঝিকঝিককেও গৌণ করে দেয়, অজানা আগামীতে দুখু কোনোদিন ‘সুখু’ হবে কিনা কে জানে! হয়তো হাজারও ছিন্নমূল শিশু-কিশোরের মতো হারিয়ে যাবে পথের বাঁকে। কিন্তু নীল আকাশে যখন ভাসতে থাকবে শাদা মেঘের ভেলা, তখন ‘দুখু’ নামে আমাদের নিজস্ব আকাশে এক অসহায় জননীর নিঃশব্দ আর্তির মূর্তিকে আমরা মেঘের গড়নে চাক্ষুষ করব। মা-ছেলের আর কখনও দেখা না হোক, তাদের মেঘের সংসারকে কোন সাহসে আমরা ‘অলীক’ বলব!

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!