নীল জাদুকর ও তার সুচ

নিজেকে একটা বালুর বস্তা বলে মনে হচ্ছে ঝিঙ্কুর। সে ক্রমাগত নিচের দিকে পতিত হচ্ছে আর ভাবছে, ইস যদি মেঘ হতাম তবে তো ভেসে যেতে পারতাম। যদি পাখি হতাম তাহলে উড়ে যেতাম কোন সুদূরে।

কল্যাণী সেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Nov 2020, 07:06 PM
Updated : 18 Nov 2020, 07:27 PM

এর কিছুই হলো না। নিচের দিকে নামতে নামতে ঝিঙ্কু গিয়ে পড়ল একটা বালুর স্তুপের উপর। সজোরে পড়েই ভেতরে ঢুকে গেল অনেকখানি। সেখানে দুই তিন ফুটের একটা গর্তের সৃষ্টি হল ঝিঙ্কুর শরীরের আকৃতির মত।

পাহাড়ের ওপর একটা একতলা বাড়ি গাছগাছালিতে ঘেরা। বাড়ির সবচেয়ে ছোট সদস্য নাবিলা। সে পড়ে ক্লাস সিক্সে। বেশিরভাগ সময়ই তার সঙ্গী থাকে বই নয়তো ট্যাব। তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট। অবসর পেলেই তার সঙ্গে গল্প করে। হয়তো বলবে, একটা গল্প শোনাও। নয়তো বলবে, একটা কৌতুক শোনাও।

কিছুক্ষণ পর বলবে, এবার ইংরেজিতে কথা বলো। একটু পর হয়তো আবার বলবে, এবার বাংলায় বলো। যন্ত্র বন্ধুটিও ফরমায়েশ মতোই আচরণ করতে থাকে। বাড়িতে কারো কিছু জানার থাকলে সোজা নাবিলাকে এসে জিজ্ঞেস করে। সঙ্গে সঙ্গে গুগল সার্চ দিয়ে উত্তর দিয়ে দেয় সে। আর এই কাজটা সবচেয়ে বেশি করে লাবনী। নাবিলার বড় বোন সে। কলেজপড়ুয়া সর্বগুণী এই মেয়েটি নাচ, গান, আবৃত্তি, উপস্থাপনা, অংকন, সেলাই সব বিষয়ে পারদর্শী।

সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে রান্না করতে। এক তরকারি যে কত রকম রান্না করা যায় তা লাবনীর চেয়ে ভালো বোধ হয় কেউ জানে না। এত গুণ যার তার একটা কিছু কমতি থাকবে না তা কি হয়। তার এই কমের জায়গাটি হচ্ছে লেখাপড়া। সে অনেক জানে, অনেক খোঁজ-খবর রাখে, কিন্তু পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল হয় না। আশানুরূপ বলছি কেন, সবসময়ই কানের পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে যায়। ৫০% নম্বর পেয়ে এসএসসি পাশ করেও লাবনী মহাখুশি। জীবনে কোনদিন আর তাকে গণিত বইয়ের মুখ দেখতে হবে না।

সেই লাবনীর কোন কিছু জানার প্রয়োজন হলেই নাবিলাকে বলবে, বোনু আমাকে এই জিনিসটা বের করে দাও তো দেখি। তোমাকে সুন্দর একটা কেক বানিয়ে খাওয়াবো। তবুও নিজে কষ্ট করবে না। নাবিলা অবশ্য আপুনির খুব ভক্ত। তাই কখনো না বলে না।

সন্ধ্যে হতেই বাড়িতে লোকজন আসতে শুরু করলো। আজ নাবিলার জন্মদিন। খাবারের দায়িত্ব লাবনী একা সামলাচ্ছে। কোনটা মাইক্রোওয়েভ ওভেনে দিচ্ছে, কোনটা দিচ্ছে ইলেকট্রিক ওভেনে। কোনটা ইনডাকশান ওভেনে বসাচ্ছে, কোনটা আবার গ্যাসস্টোভে করছে। রাইস কুকার, প্রেসার কুকার যখন যেটাতে সুবিধা হচ্ছে সেটাতেই রান্না করছে। তিন ঘণ্টার মধ্যে ২৫টি আইটেম টেবিলে নিয়ে এলো লাবনী। এখন শুধু কেক ডেকোরেশন বাকি। সেটাও হয়ে যাবে চোখের পলকে। নাবিলার বন্ধুরা সবাই এসে গেছে। আর কিছু আত্মীয়-স্বজন আসা বাকি।

লাবনী খুব চমৎকার একটি কেক সাজিয়ে নাবিলার সামনে এনে রাখলো। তার বন্ধুরা সেই কেক নিয়ে নানারকম ছবি তুলছে। ছোটমামা না আসা পর্যন্ত সে কিছুতেই কেক কাটবে না। ছোটমামা প্রতিবছর একটা চমক নিয়ে হাজির হয় এবং যথারীতি সবার শেষে আসে। নাবিলা অপেক্ষা করে বসে আছে সেই চমকের জন্য। ছোটমামা তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ।

ঠিক সেই মুহূর্তে হৈচৈ করতে করতে ছোটমামা এসে ঘরে ঢুকলেন। তিনি এরকমই একজন মজার মানুষ। নাবিলা দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো মামাকে। মামাও জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালেন নাবিলাকে। নাবিলা খুব উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো, আমার জন্য কি এনেছো? মামা হঠাৎ মনে পড়লো এমন ভঙ্গিতে বললেন, ও তোর জন্য একটা দারুণ উপহার আছে। একটু দাঁড়া, আমি এক্ষুণি নিয়ে আসছি।

ছোটমামা বেরিয়ে গেলেন এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে ফিরে এলেন। তার পেছন পেছন তেইশ-চব্বিশ বছরের একটি ছেলেও এলো। ছেলেটা বেশ লম্বা। প্রায় পাঁচ ফুট আট-নয় ইঞ্চির মতো হবে। বেশ ফর্সা ও ছিমছাম গড়ন। মাথাভর্তি একরাশ কোকরা চুল। পরনে কালো রংয়ের একটা চামড়ার প্যান্ট ও জ্যাকেট। এই গরমে এরকম পোশাকে সে কীভাবে দাঁড়িয়ে আছে কে জানে। ছোটমামা আলাপ করিয়ে দিলেন, উনি একজন জাদুকর। অফিস থেকে বেরিয়ে দেখলাম একটা বড়সর জটলা। লোকজন খুব উৎসুক হয়ে কিছু একটা দেখছে। কাছে যেতেই দেখলাম উনি জাদু দেখাচ্ছেন। দেখে খুব ভাল লাগলো। তাই নিজে থেকেই আলাপ করলাম। আমার ভাগ্নির জন্মদিনে জাদু দেখানোর অনুরোধ করলাম। তিনি খুশি মনে রাজি হয়ে গেলেন। ব্যস নিয়ে চলে এলাম। আমার বিশ্বাস আজকের আসরটা একদম জমে যাবে।

পরিচয় পর্ব শেষ। এবারে কেক কাটার পালা। নাবিলা কেকটা কাটলো। সবাই মিলে তাকে কেক খাওয়ালো। নাবিলার বাবা-মা আত্মীয়-স্বজনদের খাওয়া-দাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। নাবিলার বন্ধুরা তখন জাদুকরকে ঘিরে ধরেছে জাদু দেখানোর জন্য। সে একটার পর একটা চমকপ্রদ জাদু দেখিয়ে যাচ্ছে আর সবাই মুগ্ধ হয়ে হাততালি দিচ্ছে। প্রত্যেকটা জাদু নাবিলা তার ট্যাবে একই সঙ্গে ভিডিও করছে ও ছবি তুলছে।

ঠিক এই সময় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। নাবিলার এক বান্ধবী উত্তেজনায় এমন এক লাফ দিয়েছে, নাবিলা তার পেছনেই দাঁড়িয়ে ভিডিও করছিল, তার হাতের ধাক্কা লেগে ট্যাবটা হাত থেকে গেল পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে পুরো ডিসপ্লেটা ভেঙে চুরমার হয়ে স্ক্রিনটা কালো হয়ে গেল। ট্যাবটা নাবিলার অসম্ভব প্রিয়। গত জন্মদিনে ছোটমামাই এটা তাকে দিয়েছে। নাবিলা হাপুস নয়নে কাঁদতে শুরু করলো। বান্ধবীটি তাকে যতই সরি বলে নাবিলার কান্না ততই বাড়তে থাকে।

ভেতর থেকে ছোটমামা, বাবা, মা সবাই বেরিয়ে এলেন। কিন্তু কেউ নাবিলাকে থামাতে পারে না। ছোটমামাই বললেন, এটা আমি দোকান থেকে ঠিক করে এনে দিব। কিন্তু নাবিলা তাও মানতে চায় না। কাঁদতেই থাকে। তখন একটা দারুণ ব্যাপার হলো। জাদুকর ছেলেটি এগিয়ে এলো নাবিলার দিকে। তার সামনে বসে বললো, আমি কিন্তু জাদু করে তোমার ট্যাবটা আগের মতো করে দিতে পারি। দেখবে? এবারে নাবিলা কান্না থামালো, তাহলে দিন।

ছেলেটি নাবিলার হাত থেকে ট্যাবটি নিল। তার মাথার কোঁকড়া চুলের ভিতর থেকে একটা স্বচ্ছ সুচ বের করলো, খুব ভাল করে খেয়াল না করলে সুচটা প্রায় দেখাই যায় না। সুচের অগ্রভাগ কাচের ভাঙা অংশের ওপর জোরে চেপে ধরে রাখলো। সবাই অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো খুব ধীরে ধীরে কাচের ভাঙা অংশগুলো মসৃন হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। একটা অংশ ঠিক হয়ে গেলে জাদুকর অন্য অংশে সুচটা চেপে ধরছে। এভাবে আস্তে আস্তে পুরো ট্যাবের ডিসপ্লেটা ঠিক আগের মতো হয়ে গেল। কেউ দেখলে বুঝতেই পারবে না এটা ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। সবাই মুগ্ধ হয়ে গেল তার জাদু দেখে। এমন জাদু তারা আগে কখনো দেখেনি।

রাত হয়ে গেছে। বাইরে বেশ জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। অতিথিরা সবাই খেয়ে দেয়ে চলে গেছে। শুধু জাদুকর ছেলেটি কিছু খায়নি। সে নাকি মাছ-মাংস খায় না। ছোটমামা জিজ্ঞেস করলেন, আপনার বাড়ি কোথায়? চলুন আমি নামিয়ে দেই। বাইরে অনেক বৃষ্টি। পাহাড়ি রাস্তায় যেতে অসুবিধা হবে।

অলঙ্করণ: বিভোর সায়ন্তন, বয়স ৭

ছেলেটি কী যেন ভাবলো। তারপর বললো তার বাড়ি অনেক দূরে। বৃষ্টি থামলে চলে যাবে। ছোটমামা চলে গেলেন। ঘরে রইলো শুধু পাঁচজন। নাবিলা, লাবনী, তাদের বাবা-মা আর জাদুকর ছেলেটি।

বাবা মা-ও তাদের ঘরে চলে গেছে। হঠাৎ নাবিলা জাদুকর ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললো, আপনি কে বলুনতো? কোথা থেকে এসেছেন?

ছেলেটি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল নাবিলার প্রশ্ন করার ধরন শুনে। মুখে একটু হাসি টেনে বললো, আমি একজন জাদুকর। জাদু দেখাই।

তাতো দেখলামই। আমি জানতে চাইছি আপনার নাম কি?

আমার নাম জে।

জে কি কারও নাম হয়?

কেন? তোমাদের দরজাতেইতো লেখা আছে ‘টি কে ভিলা’। তোমার মামার মুখে শুনেছি ‘টি কে’ তোমার বাবার নাম।

বাবার নাম তৌহিদ খন্দকার। সংক্ষেপে ‘টি কে’। তাহলে আপনার পুরো নাম এবার বলুন।

এবারে লাবনীও অবাক হলো নাবিলার কথা শুনে। এসব কি হচ্ছে নাবিলা? তুমি উনার সঙ্গে এভাবে কথা বলছো কেন? উনি আমাদের অতিথি।

বেশ বিরক্ত হল লাবনী। কিন্তু নাবিলা তাকে পাত্তা না দিয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললো, আমরা জানি জাদু হচ্ছে বিজ্ঞানের খেলা। কৌশল বা ভেলকির মাধ্যমে দর্শকের মনে বিভ্রম সৃষ্টি করার মধ্যেই জাদুশিল্পীর কৃতিত্ব। কিন্তু আপনি আজ যা দেখালেন তাতো ভেলকি নয়। ভেলকি হলে ট্যাবের ডিসপ্লে আবার আগের মতো ভাঙাই থাকতো। আপনার জাদুকরি ক্ষমতা নিশ্চয়ই চিরস্থায়ী নয়।

ছেলেটি এবার শব্দ করে হেসে উঠলো। বললো, আমার গুরুর অনেক ক্ষমতা। তার শিষ্য হওয়া খুব ভাগ্যের ব্যাপার। হাতে গোনা দু'একজনকে তিনি দীক্ষা দেন। যেমন আমাকে দিয়েছেন।

এমন গুরুর নাম কেউ জানলো না কেন, শুধু আপনি ছাড়া? তার নামতো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার কথা। নাবিলাও ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়।

আমার গুরু প্রচারবিমুখ মানুষ।

আপনি কি জানেন আজ একটা খবর বেরিয়েছে? প্রত্যেকটা পত্রিকা, টিভি চ্যানেলের খবর, অনলাইন নিউজপোর্টাল সব জায়গায় সারাদিন ধরে সেই একই খবর দিয়ে যাচ্ছে।

কি খবর?

দেশের আকাশে গতকাল রাতে উল্কাপাত দেখা গেছে। অনেকেই সেই  উল্কাপাত দেখেছে।

তার সঙ্গে জাদুর কি সম্পর্ক?

সম্পর্ক আছে আমিতো সেকথা বলিনি একবারও। আমি বলতে চাইছি সেটা আসলে উল্কাপাত ছিল না।

তাহলে কী ছিল?

কী ছিল সেটাতো আপনি বলবেন। কারণ আপনার চেয়ে ভালো তো সেটা কেউ জানে না।

লাবনী অবাক হয়ে শুনছিল তাদের কথা। নাবিলার কথার এক বর্ণও সে বুঝতে পারছে না।

এবারে ছেলেটি এক অদ্ভুত মুগ্ধতা নিয়ে নাবিলার দিকে তাকিয়ে থাকলো।

তুমি সত্যিই খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে। এত ছোট তুমি। তবু তোমার বুদ্ধি দেখে আমি চমৎকৃত না হয়ে পারছি না। তুমি ঠিকই ধরেছো। ওই যে তোমরা ভিনগ্রহবাসীদের কী যেন বলো, এলিয়েন। আমি হচ্ছি এলিয়েন।

লাবনীর মনে হলো সে মাথা ঘুরে পড়েই যাবে। কী বলছেন উনি এসব আবোল তাবোল। নাবিলা ছেলেটির পাশে গিয়ে বসলো।

আপনি বলুন। আমি শুনতে চাই।

আমার নাম ঝিঙ্কু। তোমাদেরই মতো একটা ছোট্ট গ্রহে আমার বাস। আমি যেখানে থাকি সে জায়গাটিও এখানকার মতো পাহাড়ি এলাকা। প্রচুর গাছপালা চারদিকে। আমরা শাকপাতা খেয়ে বাঁচি। তৃণভোজী প্রাণী বলতে পারো আমাদের। আমাদের কখনো অসুখ-বিসুখ হয় না। সর্দি, কাশি, জ্বর, পেটের সমস্যা, হজমের সমস্যা এসব আমাদের হয় না। আমরা অনেক পরিশ্রম করতে পারি।

তাহলে অমন শান্তির জায়গা ছেড়ে আপনি এখানে এলেন কেন?

আমি তো নিজে থেকে আসিনি। আমার দেশের কিছু ক্ষমতাবান লোক আমাকে এখানে ফেলে গেছে।

কেন?

চুরির অপরাধে।

চুরি! আপনি চুরি করেছেন নাকি?

করেছিতো বটে। কিন্তু সেটা প্রমান হয়নি।

তার মানে?

তারা জানে আমি চুরিটা করেছি। কিন্তু জিনিসটা কোথায় রেখেছি সেটা খুঁজে পায়নি। অনেক চেষ্টা করেছে অবশ্য। অনেক কষ্ট দিয়েছে আমাকে। শেষে ভয় দেখানোর জন্য মানচিত্র দেখে দেখে আমাকে এখানে ফেলে গেছে। আমার ওপর তারা ঠিকই নজর রাখছে। তারা জানে আমার জীবনের মূল্য তাদের কাছে অনেক। কারণ আমি হারিয়ে গেলে তাদের কাঙ্ক্ষিত জিনিসটিও চিরদিনের মতো হারিয়ে যাবে।

কি চুরি করেছেন আপনি?

একটা সুচ।

সুচ!

এটা কোন সাধারণ সুচ নয়। এর সাহায্যে কাচের ভাঙা অংশ জোড়া লেগে একদম আগের মতো হয়ে যায়।

যেটা দিয়ে আপনি আমার ট্যাবের ফাটা স্ক্রিন জোড়া লাগিয়েছিলেন?

হ্যাঁ। জিনিসটা এমনভাবে তৈরি যে সেটা ভাঙা কাচের ওপর চেপে ধরলে যতদূর পর্যন্ত এর তরঙ্গটা ছড়ায় ততদূর পর্যন্ত কাচ আপনা আপনি জোড়া লেগে যায়।

এটা আপনি চুরি করলেন কেন?

এটা আমার বাবার আবিষ্কার। বাবাকে বঞ্চিত করে বাবারই এক সহকর্মী এটি নিজের নামে চালাতে চাইছে। বাবা সেটা মানতে পারছেন না। বাবা যে তাকে আটকাবে সেই শক্তিও তার নেই। ছেলে হয়ে তো আমি বাবাকে হারতে দেখতে পারি না, তাই না?

একজনের আবিষ্কার আরেকজন চাইলেই নিজের নামে চালাতে পারে?

ও, তুমি ব্যাপারটা বুঝতে পারোনি। বাবা যখন প্রজেক্টটা নিয়ে কাজ করছিলেন তখন তার সহকারী আরও কয়েকজন ছিলেন। বাবা ছিলেন প্রধান গবেষক। প্রজেক্ট যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে সেই সময়ে ল্যাবরেটরিতে একটা বড় দুর্ঘটনা ঘটে। সেই দুর্ঘটনায় বাবা শারীরিক কর্মক্ষমতা হারান। তার বাকশক্তিও নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু তার মস্তিষ্ক কাজ করে। তিনি সব দেখতে ও শুনতে পান। বুঝতেও পারেন।

বাবার সহকর্মী অবশিষ্ট কাজ শেষ করে সেটি পেটেন্টও করিয়ে নেন। অর্থাৎ একচ্ছত্র অধিকার অর্জন করেন। আমরা সেটা জানতে পারি সবকিছু ঘটে যাওয়ার পর। বাবার চোখ দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে শুধু পানি ঝরছে। গতকাল সুচটি আনুষ্ঠানিক উন্মোচনের কথা ছিল। কিন্তু আমি সেটি হতে দেইনি।

তাহলে কি আপনি আর কখনো সেখানে ফিরতে পারবেন না?

জানি না। তবে বাবার কাজের কৃতিত্ব আমি অন্য কাউকে নিতে দিব না। তাতে যদি আমার কোনদিন সেখানে ফিরে যাওয়া না হয়, হবে না। অথবা আমি যদি মারা যাই, যাব। আমার কিছু যায় আসে না।

আচ্ছা আপনি বেঁচে আছেন না মরে গেছেন, সেটি গ্রহবাসীরা জানবে কী করে? তারা যদি আপনাকে ফিরিয়ে নিতেও চায় সেটাই বা নিবে কী করে?

আমার বাজুতে একটি বেল্ট বাঁধা আছে। যতক্ষণ আমার হৃদযন্ত্র সচল থাকবে ততক্ষণ আমার সঙ্গে গ্রহের যোগাযোগ থাকবে। তবে আমার নিজে থেকে যোগাযোগ করার সুযোগ নেই। আর ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলছো? সেটা যেভাবে এখানে ফেলে দেওয়া হয়েছে সেভাবেই নেবে।

এবারে লাবনী বলে উঠলো, আচ্ছা ওই উল্কার রহস্যটা কি আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবেন?

ঝিঙ্কু বললো, আমাকে যখন স্পেসশিপ থেকে নামানো হয় তখন আমার চারপাশে একটা বলয় তৈরি করা হয়েছিল। এটি একটি সুরক্ষা বলয়। রাতের অন্ধকারে সেটাকে আলোর বলয় বলে মনে হয়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় খসে পড়া নক্ষত্রের টুকরো বা উল্কা। মাটির কাছাকাছি আসতেই বলয়টি অদৃশ্য হয়ে যায়। আমাকে ভয় দেখিয়ে তারা জিনিসটা উদ্ধার করতে চেয়েছিল। মেরে ফেললে তো আর কোনদিনও পাবে না। নতুন করে তৈরিও করতে পারবে না। কারণ এর সম্পূর্ণ ফর্মুলা শুধু আমার বাবা জানেন। তারা পেটেন্ট করিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু বাজারজাত করতে পারতেন না।

ঠিক সেইসময়ে লাবনীর বাবা এসে ঘরে ঢুকলেন। ঝিঙ্কুর দিকে তাকিয়ে বললেন, বৃষ্টিতো আরও জোরে শুরু হয়েছে। আজ রাতে বোধ হয় আর থামবে না। তুমি বরং আজ রাতে এখানেই থেকে যাও বাবা। বাড়িতে একটা ফোন করে দাও।

লাবনীর মা-ও পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। বললেন, সেই ভাল। তাছাড়া তুমিতো কিছুই খেলে না। একটু কিছু করে দেই, খাও।

লাবনী বললো, মা উনিতো ভেজিটারিয়ান। আমি বরং সেরকম কিছু করে আনি। লাবনী রান্নাঘরে চলে গেলো। বাকিরা সবাই বসে গল্প শুরু করলো।

ঝিঙ্কুর সামনে পাটশাকের বড়া, কুমড়ো ফুল ও বকফুলের বড়া, লালশাক, ডাটাশাক, লাউশাক ও পালংশাক। লাবনী একটা একটা করে চিনিয়ে দিচ্ছে আর বলছে, কোনদিনতো খাননি। আজ খেয়ে দেখুন। জীবনেও ভুলবেন না। ঝিঙ্কু একেকটা জিনিস মুখে দিচ্ছে আর তৃপ্তিদায়ক একেকটা শব্দ করছে। সত্যিই সে এমন খাবার কোনদিন খায়নি। নাবিলা লাবনীর দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমি করে বললো, আপুনি তোমার গাল দুটো এমন লাল হয়ে গেছে কেন?

লাবনী নাবিলার দিকে তাকিয়ে কপট চোখ রাঙালো বটে, তবে মনে মনে সত্যিই একটু লজ্জা পেল। ঝিঙ্কু টের পাচ্ছে তার বাজুতে বাঁধা বেল্টটি সংকেত দিচ্ছে। সে একটু আড়ালে গিয়ে যোগাযোগ করলো তার গ্রহের সঙ্গে। ফিরে এসে বললো, আমাকে চলে যেতে হবে। হঠাৎ জরুরি দরকার পড়েছে। লাবনীর বাবা-মা চিন্তিত হয়ে বললেন, কিন্তু বৃষ্টিতো এখনো থামেনি।

চিন্তা করবেন না। পাহাড়ে চলাচল করার অভ্যেস আমার আছে। আপনাদের সঙ্গে কাটানো আজকের সন্ধ্যেটা আমি কোনদিন ভুলবো না।

লাবনী ও নাবিলা গেট পর্যন্ত এসেছিল ঝিঙ্কুকে বিদায় জানাতে। ঝিঙ্কু বললো, গোয়েন্দা সংস্থা থেকে যোগাযোগ করেছে। আসল অপরাধীরা তাদের দোষ স্বীকার করেছে। আমাকে ফিরিয়ে নেওয়ার সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তোমাদের কথা আমার আজীবন মনে থাকবে। নাবিলা তুমি ভীষণ বুদ্ধিমতী মেয়ে। তুমি একদিন অনেক নাম করবে। আর লাবনী আপনার রান্নার খ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে। মিলিয়ে নেবেন আমার কথা। চলি।

বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে ঝিঙ্কু একসময় অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

পরদিন সকালে নাবিলার সেই বান্ধবীটি এলো যার হাতের ধাক্কায় ট্যাবটা পড়ে ভেঙে গিয়েছিল। জিজ্ঞেস করলো, তোর ট্যাবটা ঠিক আছে? একশ ভাগ, নাবিলা উত্তর দিল। বান্ধবী বললো, বাবা বলেছে তোর ট্যাবের আসলে কিছুই হয়নি। ওটা জাদুকরের ভেলকি ছিল। তা না হলে ভাঙা কাচ কি কখনো জোড়া লাগে? মুচকি হাসলো নাবিলা, আঙ্কেল একদম ঠিক বলেছে। তা-ই হবে। অন্তত বিজ্ঞানতো সে কথাই বলে।

লেখক পরিচিতি: শিক্ষক, ভিকারুননিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজ

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!