‘বাঙালির মস্তিষ্ক ও তাহার অপব্যবহার’

বই: বাঙালির মস্তিষ্ক ও তাহার অপব্যবহার, লেখক: প্রফুল্লচন্দ্র রায়, প্রকাশক: বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, প্রথম প্রকাশ: ১৯১০

অভিজিৎ চক্রবর্তীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Nov 2020, 08:39 AM
Updated : 12 Nov 2020, 09:20 AM

ভারতীয় প্রাচীন রসায়নবিদ, চিকিৎসক, দার্শনিক ও কবি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তার ‘বাঙালির মস্তিষ্ক ও তাহার অপব্যবহার’ বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯১০ সালে।

‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ থেকে প্রকাশিত বইটির তখন মূল্য ছিলো এক আনা। সে বছরই বইটির ইংরেজি সংস্করণ আনে ‘সিটি বুক সোসাইটি’, ‘বেঙ্গলি ব্রেইন অ্যান্ড ইটস মিসইউজ’ নামে। প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণের পর বইটির তৃতীয় সংস্করণ আনা হয় ‘চক্রবর্তী চ্যাটার্জী কোম্পানি’ থেকে। এসময় বইটির ৩ হাজার কপি প্রকাশ করা হয়।

বইটির মূল পৃষ্ঠাসংখ্যা ৩৯। সেই সংস্করণেরই একটি দুর্লভ কপি আমি পড়ি। বইটি কর্মবিমুখ, অলস, চাকরিপ্রিয়, হীনমন্য বাঙালির জন্য একটি দূরদর্শী রচনা এ ব্যপারে কোন সন্দেহ নেই। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র বলতেন তিনি ভুলক্রমে রসায়নবিদ হয়েছেন। তাঁর বরাবরই অনুরাগ ছিলো ইতিহাস, জীবনী সাহিত্য ও সাধারণ সাহিত্যের প্রতি।

বইটি সম্পর্কে তিনি তার বিভিন্ন আলোচনায় বলেছেন, ‘আমি বাঙালি চরিত্র বিশ্লেষণ করে তাদের দোষ-ত্রুটি দেখাতে দ্বিধা করিনি, অস্ত্রচিকিৎসকের মতোই তাদের দেহে ছুরি চালিয়েছি এবং ব্যাধিগ্রস্ত অংশ নির্ণয় করে তার সমাধান দেয়ার চেষ্টা করেছি।’

বইটির শুরুতে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় উল্লেখ করেছেন যে প্রায় সহস্র বছর ধরে হিন্দুজাতি একপ্রকার মৃতপ্রায় হয়ে রয়েছে। ভারতবর্ষে তিমিরাচ্ছন্নতার সূচনা হয় দ্বাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে স্বাধীনচিন্তার স্রোত প্রকাশের পর থেকে। এক্ষেত্রে তিনি সে সময়ের প্রখ্যাত অধ্যাপক ওয়েবারের মতামতের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বলেন- ‘ভারতবর্ষে মুক্ত ও স্বাধীনচিন্তার শেষ নক্ষত্র ভাস্করাচার্য’।

তিনি দ্বাদশ শতাব্দীর বেশ কয়েকজন মহামহোপাধ্যায়কে নিয়ে টিপ্পনি কেটে বলেন- ‘তাদের কাজ ছিলো বিবিধ টীকা রচনা করে টোলের ছাত্রদের মধ্যে আতঙ্ক উৎপাদন করা। পরবর্তী সময়গুলোতে এ ধারা অপরিবর্তিত থাকে, এদিকে সে সময় ইউরোপের গ্যালিলিও, কেপলার, নিউটন ইত্যাদি মনীষীরা প্রকৃতির নতুন নতুন তত্ত্ব উদঘাটন ও উপস্থাপন করছিলেন।’

অন্ধকার এ অবস্থার জন্য তিনি দায়ী করেন সে সময়ের হিন্দু সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কারাচ্ছন্ন নিয়ম-কানুনকে যা মানুষের মধ্যে বড়-ছোট জাত নির্ণয়ে ব্যস্ত ছিলো এবং সে সময়ে দুই শ্রেণির লোকের ব্যাপক প্রভাব বিস্তার হলো। এক শ্রেণি শাস্ত্রকার ও অপর শ্রেণি ব্যাখ্যাকার। প্রাচীন ব্রাহ্মণ সমাজের গ্রহণযোগ্যতা ও আধিপত্যের পরের প্রজন্মের হিন্দুসমাজ তাদের পূর্বপুরুষদের মতো জ্ঞানচর্চায় মনোযোগ না দিয়ে শুধু পূর্বজদের নাম ব্যবহার করে নিয়মতান্ত্রিকার চাবুক কষে সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে চায়। যার ফলে স্বাধীনচিন্তার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মৌলিকতাও চলে যায়।

তবে বৌদ্ধধর্মের উৎপত্তি, বিকাশ ও ছড়িয়ে পড়ার সময়টায় স্বাধীনচিন্তার বিকাশ ঘটেছিলো। এসময়ে জ্যোতিষশাস্ত্র ও গণিতশাস্ত্রে অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন আর্চভট্ট, ব্রহ্মগুপ্ত ও বরাহমিহিরসহ প্রভৃতি মনীষীরা। শাসনামল পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নব্য হিন্দু সম্প্রদায়ের হাতে আবার ক্ষমতা চলে আসে সমাজকে শাসন করার এবং তাদের তৈরি কট্টর নিয়মের জন্যই তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে থাকেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিলো কঠোর শাস্ত্রের তাড়না, জাত্যাভিমান, কুলমর্যাদা ও সমুদ্রযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা।

অনেকে মনে করেন মুসলিম শাসনামল ভারতে জ্ঞানচর্চাকে সে সময় অনেকাংশে ব্যহত করে, প্রফুল্লচন্দ্র এ ব্যাপারে সহমত প্রকাশ করেননি। তিনি বলেন, ‘সে সময়ে মুসলিম শাসন স্থায়ীরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাছাড়া মুসলিম শাসনামলেও বাংলাদেশে বিশেষত নবদ্বিপ ও বিক্রমপুরে হিন্দুশাস্ত্রের যথেষ্ট চর্চা ছিলো।’

ইংরেজ বণিকদের আগমনের পরে তারা যখন শাসন প্রতিষ্ঠা করলো বাঙালি সন্তানরা তখন পূর্বজদের ব্যবসা ছেড়ে দলে দলে বিভিন্ন সেক্টরে কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত হওয়া শুরু করলেন। কিন্তু তারা এই সুযোগের অপব্যবহার করলেন এবং প্রতিটি বিভাগ থেকে কিছুই না শিখে কেবল নিজের আখের গোছালেন। বাষ্প ইঞ্জিন আবিষ্কারের পর এ অবস্থার আরও উন্নতি হলো ঠিক, কিন্তু ইংরেজ শাসকরা এদেশের তৈরি পোশাক পাশ্চাত্যে পাঠানো শুরু করলেন।

এর ফলে দেশের তাঁতি ও জোলাসহ ছোট ব্যবসায়ীরা জাতিগত ব্যবসা ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এ অবস্থার কারণে ভারতীয় দেশীয় শিল্পে সুতীক্ষ্ণ কুঠারাঘাত পড়ে। তখন ইংরেজদের কেরানিগিরি করা সমাজে সম্মানের বিষয় হিসেবে পরিলক্ষিত হওয়া শুরু হয় এবং বাংলার মনন ও মগজ চিরতরে চাকরপ্রবৃত্তিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। স্বাধীনচিন্তা নামক শব্দটি সযত্নে নিজেদের শব্দকোষ থেকে পরিত্রাণ পায়।

ইংরেজদের ছুড়ে দেওয়া চাকরি লাভের আশায় বাঙালিরা ধীরে ধীরে মুখস্থ ও নির্দিষ্ট বিদ্যাচর্চায় মনোনিবেশ করলো। তিনি এর কারণ হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যার্জনের প্রতি ঝোঁককেই দায়ী করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত মস্তিষ্ক ব্যাকরণ ও অন্যান্য বে-দরকারি শাস্ত্রপাঠ ও আত্মস্থ করে বোঝাই হয়ে গেছে। এমন স্থিরচিত্তে যদি কেউ ব্যবসাও করে তবে তাতেও উন্নতি সম্ভব।

প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেন, ‘যতোদিন মানুষের মনে তাদের সহচরদের উপর প্রাধান্য লাভ করবার ইচ্ছা থাকবে, যতোদিন এক জাতি অন্য জাতিকে নিজের স্বার্থের জন্য দাসশৃঙ্খলে বন্ধ রাখার চেষ্টা করবে সে জাতিকে শীঘ্রই অন্যের দাসত্বে জীবন কাটাতে হবে। ভারতবর্ষ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণস্থল।’

বইটির শেষাংশে তিনি বলেন, ‘আপনি যদি সমাজের মত মতো না চলেন তবে সমাজ আপনার পথে বেত্রাঘাত করবে, আপনাকে একঘরে করে রাখবে। অথচ সমাজকে কলুষিত করে রেখেছে মিথ্যাচার।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণ আবশ্যক এবং তা ধীরে ধীরে আসবেই। সেজন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় বস্তু হলো স্বাধীনচিন্তা, অন্যের গোলামির বলয় থেকে বেড়িয়ে স্বতন্ত্র কর্মসংস্থান তৈরি।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!