আহমদ ছফার ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’

বই: অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী, লেখক: আহমদ ছফা, ধরণ: উপন্যাস, প্রকাশক: মাওলা ব্রাদার্স, প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৬, মূল্য: ২০০ টাকা

মো. ইয়াকুব আলীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Nov 2020, 07:04 PM
Updated : 5 Nov 2020, 07:07 PM

বইটার ফ্ল্যাপে লেখা আছে ‘সত্য কল্পকাহিনির চাইতে আশ্চর্যতরো। এটা আপ্তবাক্য। যে কাহিনির মূলে সত্যের স্পর্শ নেই, সে কাহিনি মূল্যহীন। লেখক একেকটি নারী চরিত্রকে এমন জীবন্তভাবে উপস্থাপন করেছেন, নারীদের মনোজগতের এমন উন্মোচন ঘটিয়েছেন, গ্রন্থটি পাঠ করলে মনে হবে জীবনের করুণতম অভিজ্ঞতার উৎস থেকেই জন্ম লাভ করেছে এই সমস্ত চরিত্র।’

বইটি পড়ে আমারও একই কথা মনে হয়েছে। এই বইটার প্রত্যেকটা নারী চরিত্র আসলে লেখকের বাস্তব জীবনের চরিত্র। লেখক যদিও নিজের নাম বদলে এখানে ‘জাহিদ হাসান’ নাম নিয়েছেন, কিন্তু জাহিদ হাসানের দৈনন্দিন কার্যক্রম একটু ভালোভাবে দেখলেই বুঝা যাবে জাহিদ হাসান আসলে স্বয়ং লেখক। লেখকের অন্যান্য বই পড়া থাকলে ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার বোঝা যাবে। উপন্যাসের একটা চরিত্র আবুল হাসনাত জাহিদ হাসানকে ‘মৌলবী জাহিদ হাসান’ বলে সম্বোধন করে, আমাদের সেই সন্দেহটাকে আরো পোক্ত করেছে।

যাই হোক, উপন্যাসের কথায় আসা যাক। তৃতীয় পুরুষে উপন্যাসটি লেখা। প্রধান চরিত্র জাহিদ হাসানের বয়ানে উপন্যাসটির কাহিনি এগিয়েছে। উপন্যাসটিতে জাহিদ হাসান তার একজন প্রেয়সীকে পত্র লিখছেন। সেই পত্রের ভাষ্যই উপন্যাসটির অনুজীব্য।

শুরুতেই প্রেয়সীকে জাহিদ হাসান একটা নাম দিতে চেয়েছেন, কারণ তার ভাষায় যেটা আসলে লেখকেরই ভাষা- ‘আমি ভেবে দেখেছি নামের চাইতে মাথা ঘামাবার উপযুক্ত বিষয়বস্তু দুনিয়াতে দ্বিতীয় কিছু নেই। আল্লাহতায়ালা তো প্রথম মানব আদমকে নাম শিক্ষাই দিয়েছিলেন। তার মানে নাম শিক্ষা দেয়ার ছলে নামের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে ফেলেছিলেন। নামের বাঁধন ছিঁড়ে আদমের পালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। আদমের বংশধরদেরও কারো নামের বন্ধন ছিন্ন করা সম্ভব হবে না।’

‘...তোমার নাম রাখতাম ঈশ্বরী। একমাত্র সঙ্গীতই তো বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত অপ্রকাশকে মুহূর্তে মূর্ত করে তুলতে পারে। সুতরাং তোমার নাম রাখলাম সোহিনী। সোহিনী রাগের নামে তোমার নামকরণ। সৌন্দর্যের সাথে কষ্টের একটা সংযোগ আছে এটাই সোহিনী রাগের বৈশিষ্ট্য। রাত যতই শেষের দিকে গড়াতে থাকে, এই রাগটির সৌন্দর্য ততই প্রস্ফুটিত হতে থাকে। কিন্তু একটা কথা সঙ্গীতশাস্ত্রে যে গাইয়ে বিশুদ্ধি এবং নির্ভরতা অর্জন করেনি, তার কণ্ঠে সোহিনী রাগ কখনো গহন সৌন্দর্য নিয়ে ধরা দেবে না।...সোহিনী তুমি আমার কাছে অর্ধেক আনন্দ, অর্ধেক বেদনা। অর্ধেক কষ্ট, অর্ধেক সুখ। অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী।’

এরপর প্রেয়সীকে প্রথম দেখাতে জাহিদের মনের অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেছেন এভাবে- ‘তোমার সঙ্গে যখন প্রথম দেখা হলো, সেদিন কি বার, কোন মাস, দিবসের কোন প্রহর, কিছুই মনে নেই। শুধু মনে আছে তোমার সঙ্গে দেখা হলো। চরাচর চিরে তুমি যখন আবির্ভূত হলে, রজনীগন্ধার বোঁটার মতো যখন ঈষৎ নত হয়ে দাঁড়ালে, আমার শরীরের সমস্ত রক্ত মিছিল করে উজানে চলতে আরম্ভ করলো। চেতনার স্তরে স্তরে উৎসবের সাড়া পড়ে গেলো। আচমকা আমি বলে উঠলাম, আমি পেয়েছি, আমি পেয়ে গেছি।... দুটো গানের কলি ঢেউ দিয়ে মনের মধ্যে জেগে উঠলো- সোহাগ ভরে অনুরাগে জড়িয়ে ধীরে ধীরে/ বেনারশি প্যাঁচ দিয়েছে শরীর বল্লবীরে। আমি বিড়বিড় করে বলতে থাকলাম, তুমি আমার জীবন। তোমাকে না পেলে আমি বাঁচবো না। তুমি আমার গন্তব্য, আমার মঞ্জিলে মকসুদ।’

এরপর জাহিদ আরও বলেছেন- ‘সোহিনী, তুমি আমার বুকে কী এক দুঃসাহসের জন্ম দিয়েছো! কী এক অসম্ভব আশা আমার মনে রক্ত শতদলের মতো ফুটিয়ে তুলেছো। আমার শরীরের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে কী অপার শক্তির লহরি খেলিয়ে তুলেছো। আমি তোমাকে বারণ করতে পারছিনে। একটা দুর্বার গতিবেগ আমাকে ছুটিয়ে নিতে চাইছে। তুমি আমার পথ, আমার গন্তব্য।...তোমার অভিমুখে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোন পথ খোলা নেই, যখন বুঝতে পারলাম, মনটা বিষাদে ছেয়ে গেলো। মনে হলো জেনেশুনে একটা ফাঁস গলায় পরলাম। এই ফাঁসই আমাকে টেনে নিয়ে যাবে। ধরে নিলাম আমার মৃত্যুদণ্ড লেখা হয়ে গেছে। কখন কার্যকর হবে শুধু ঘোষণাটা হয়নি।’

এইটুকু পাঠ করলে বোঝা যায় জাহিদ হাসানের মনে তার প্রেয়সীকে নিয়ে কি ভাবনা খেলা করছে। এই ভাবনাটা আসলে লেখকের এবং আরো সহজ করে বললে সব পুরুষের। সব পুরুষই তার প্রেয়সীকে এমনসব অভিধায় অলঙ্কৃত করেন যেটাকে অন্যের কাছে বাড়াবাড়ি মনে হলেও প্রেমিক পুরুষের তাতে কিছুই যায় আসে না। সে শুধু তার ধ্যান জ্ঞানে তার প্রেয়সীকে ধারণ করেন। তাকে বর্ণনা করার জন্য খুঁজে ফিরেন অভিধানের সবচেয়ে সুন্দর শব্দমালা, গানের সবচেয়ে মধুর কলিজোড়া।

প্রেয়সীর প্রতি এই টানকে লেখক ফাঁসির আসামির সঙ্গে তুলনা করেছেন যার ফাঁসির আদেশ হয়ে গেছে শুধু কার্যকর করার বাকি। বাস্তবেও যুগে যুগে প্রেমিক পুরুষদের দেখা যায় তারা তাদের প্রেয়সীকে পাওয়ার জন্য নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে ছুটে চলেছেন প্রেমিকার পানে, যেমন কীটপতঙ্গ ছুটে চলে আলোর পানে, নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও। এখানে প্রেম মহান, এটাই প্রেমের ক্ষমতা।  

এরপর জাহিদ তার প্রেয়সীর কাছে স্বীকারোক্তি করেছেন এভাবে- ‘অতীতে যেসব নারী আমার জীবনে এসেছিলো, এখন দেখছি, তাদের কেউ বিদেয় হয়নি। বুকের ভেতর রাজ্যপাট বিস্তার করে বসে আছে। তোমার দিকে পা বাড়াই কি সাধ্য! তারা কেউ অধিকার ছেড়ে দিতে রাজি নয়।...এখন তাদের কেউ নেই। নেই বলে কি একেবারে নেই? মাটির গভীরে দেবে যাওয়া বোমা যেমন সমস্ত তেজস্ক্রিয়তাসহ আত্মগোপন করে থাকে, নাড়াচাড়া লাগলেই বিস্ফোরিত হয়; তেমনি আমিও যতোই অতীত থেকে নিজের অস্তিত্ব টেনে আনতে চাই, কেউ হেসে, কেউ কেঁদে, কেউ ধমক দিয়ে কথা বলতে থাকে, না না আমরা তোমাকে এক পা-ও নড়তে দেবো না।’

‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’ বইটির প্রচ্ছদ

এরপর জাহিদ তার প্রাক্তন প্রেয়সীদের কথা বলেছেন। তার অতীত জীবনের দুজন প্ৰেয়সীর সঙ্গে তার সম্পর্কের আদ্যোপান্ত এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু। সেগুলো বলতে গিয়ে জাহিদ কোন প্রকার রাখঢাক করেননি। তার মনে যখন যে ভাবের উদয় হয়েছে সেটাকে অবলীলায় ব্যক্ত করেছেন। আমরা অনেক সময় নিজের অব্যক্ত আবেগকে ভাষায় ব্যক্ত করার সময় একটু পরিমিত করে লিখি, জাহিদ তা করেননি। এটাই এই উপন্যাসের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। জাহিদের মনে পরিস্থিতির তাড়নায় যে উপমা এসেছে সেটাই প্রকাশ করেছেন নিঃসংকোচে।

মানুষ আসলে কেন নারীর প্রেমে পড়ে? এই প্রশ্নেরও উত্তর সন্ধান করা হয়েছে এই উপন্যাসে। তাহলে কি নারীর মধ্যে ঈশ্বর বসবাস করেন! তার মধ্যে আছে ঐশ্বরিক কোন টান। সেই জন্যই কি নারী আসলে অর্ধেক নারী আর অর্ধেক ঈশ্বরী! যার ফলে পুরুষ বারবার তার কাছে ফিরে আসে। যদি টান থেকে থাকে তবে সেই টানের উৎস কি? সেই টানের উৎস কি তার শরীর নাকি তার মন নাকি আলাদা কোন সত্তা যেটা পুরুষ মানসে ধরা দেবো দেবো করেও ধরা দেয় না। পুরুষ আসলে কখন একজন নারীর প্রেমে পড়ে বা বুঝতে পারে কোন নারীর প্রতি তার প্রেমবোধ তৈরি হয়েছে, সেই প্রশ্নেরও উত্তর সন্ধান করা হয়েছে।

আর প্রেমে পড়লেই কি কোন পুরুষ সেই নারীকে শরীর মনে একান্তভাবে পেতে চায় নাকি সারাজীবন শুধু পাশাপাশি পথ চলতে চায়। কতদিন থাকে সেই টান? কেন সেই টান নষ্ট হয়? এসব প্রশ্নের উত্তরও সন্ধান করা হয়েছে। সেটা করতে গিয়ে জাহিদ তার দুজন প্রাক্তন প্রেমিকার কথা বলেছেন। এবারে সেদিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। 

প্রথমজনের নাম ‘দুরদানা আফসারিয়াব’, লোকে বলতো দুর্দান্ত ঠান্ডার। জাহিদের ভাষায়- ‘আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে একটি ঊনিশ বছরের তরুণী ঢাকার রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে কলেজে আসছে, যাচ্ছে।...ওই রকম অঘটনঘটনপটিয়সী, দুর্দান্ত সাহসী একজন তরুণীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্টতা হয়েছে, এটাকে আমি ভাগ্যের ব্যাপার বলেই ধরে নিলাম।..আমার মনে হতো দুরদানার প্রতিটি প্যাডেল ঘোরানোর মধ্য দিয়ে মুসলিম সমাজের সামন্তযুগীয় অচলায়তনের বিধিনিষেধ ভেঙে নতুন যুগ সৃষ্টি করছে।’

অন্যান্য লোকের শত সমালোচনা সত্ত্বেও সে ছিলো জাহিদের চোখে- ‘আমার মনে হয়েছে দুরদানা এক অসাধারণ তরুণী।’ বরং সমালোচনাগুলোকে জাহিদের কাছে মনে হয়েছে ‘কর্তৃত্বপ্রয়াসী কতিপয় ঝুনো পণ্ডিতের নিছক অক্ষম কাপুরুষতা।’

জাহিদ অন্য এক জায়গায় বলেছেন- ‘দুরদানা একটি মেয়ে, একটি অজানা পৃথিবীর প্রতীক। এই আমার জন্য যথেষ্ট ছিলো। তার শারীরিক সৌন্দর্য কখনো আমার ধর্তব্যে আসেনি। একজন যৌবনবতী নারীর রূপ ধরে আমাদের দেশের ইতিহাসের পাল্টা স্রোত, যা গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্র হাজার বছরের বাঁধন ঠেলে বেরিয়ে আসার জন্য রক্তপাত ঘটাচ্ছিলো, সেই প্রবাহটার সঙ্গেই দুরদানা আমার পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছিলো। নারী আসলে যা, তার বদলে যখন সে অন্যকিছুর প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়, তখন তার আকৰ্ষণ করার শক্তি হাজার গুণ বেড়ে যায়।’

দুরদানার সঙ্গে একসময় জাহিদের সম্পর্কের অবসান হয়। জাহিদের ভাষায় ‘অমেয়েমানুষী দুরদানা এতোদিন আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। তার মেয়েমানুষী পরিচয় বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমি ভেতরে ভেতরে একরকম শঙ্কিত হয়ে উঠলাম, একে নিয়ে আমি কি করবো? একে তো কোনদিন ভালোবাসতে পারবো না।...দুরদানা ও আমি দু’জনাই অনুভব করেছিলাম, আমাদের ভেতরকার তাজা সম্পর্কটা আপনা থেকেই মরে যাচ্ছে। গাছের একটা ডাল যেমন শুকিয়ে যায়, প্রক্রিয়াটা অনেকটা সেরকম।...তা সত্ত্বেও দুরদানা আমার কাছে আসতো, আমি দুরদানার কাছে যেতাম। এটা একটা পুরনো অভ্যাসের জের। ট্রেনের ইঞ্জিন বন্ধ করার পরও যেমন অন্তর্গত বেগের ধাক্কায় কিছুদূর পর্যন্ত সচল থাকে, এ-ও ঠিক তেমনি।’

এরপর জাহিদের জীবনে আসে শামারোখ, যাকে জাহিদ নাম দিয়েছেন ‘কন্যা শামারোখ’। শামারোখকে প্রথম দেখার পর জাহিদের মনে নিম্নোক্ত পংক্তিমালা বিদ্যুতের মতো চমক দিয়ে জেগে উঠছিলো,

‘ষষ্ঠ দিন শ্রম অন্তে প্রভু

অপূর্ব বিস্ময় ভরে করে উচ্চারণ

পরবর্তী সৃষ্টি হবে দিব্যি অনুপম।

তখনই ডাগর আঁখি মেলেছে নন্দিনী

মরি, মরি দৃষ্টি হেরি,

আপন অন্তর তলে বিধাতাও

উঠিছে শিহরি।’

শামারোখের ছিলো বিদেশি ডিগ্রি, ভালো কবিতা লিখতে পারতেন। অবশ্য জাহিদের ভাষায় সেগুলো কবিতা হয়ে উঠেনি পুরোপুরি। তবে লেখার মধ্যে একটা জ্বালা, এমন একটা যন্ত্রণাবোধের সাক্ষাৎ জাহিদ পেয়েছিলেন যে পড়ার সময় তার মনে হয়েছিলো শামারোখ যদি তখন তার সামনে থাকতো তাহলে তার সারা শরীরে শীতল বরফের প্রলেপ দিয়ে তার মনের যন্ত্রণা হরণ করার চেষ্টা করতেন।

জাহিদ অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করেছেন শামারোখের শারীরিক সৌন্দর্য তাকে আকর্ষণ করেছিলো। এক দুপুরে শামারোখ জাহিদের বিছানায় ঘুমিয়েছিলো, সেটাকেই জাহিদ তার নিঃসঙ্গ জীবনের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলে মানেন। তখন শামারোখ পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে অঝোরে কেঁদেছিলেন। জাহিদের ভাষায়- ‘ক্রন্দনরত অবস্থায় শামারোখের শরীর থেকে এক ধরণের বিশেষ সৌন্দর্য ফুটে বের হয়ে আসছিলো। তার শরীরে বয়সের ছাপ পড়েছে। চুলের মধ্যে অনেকগুলো রুপোলি রেখা দেখতে পাচ্ছি। তারপরও শামারোখ কি অপূর্ব সুন্দরী।...অর্ধ আনত এমন সুন্দরী একটা নারীর শরীর এতো কাছ থেকে আমি দেখতে পাচ্ছি। বালিশের দু’পাশে তার চুলগুলো ছড়িয়ে রয়েছে। সমুদ্রের অতল থেকে দেবী ভেনাসের আবির্ভাবের যে ছবি শিল্পী এঁকেছেন, শামারোখকে কিছুটা সেরকম দেখাচ্ছে। তার নাক-মুখ-চিবুক সবকিছু যেন দেবী ভেনাসের অংশ। আমি এরকম শরীরের কোন নারী জীবনে দেখিনি।’

‘শামারোখ তার শারীরিক সৌন্দর্য সম্পর্কে অতিমাত্রায় সচেতন, একথা সত্য। কিন্তু মাসিক পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারটি তার কাছে তার চাইতেও বড়। কিন্তু পরিস্থিতি যখন চাপ দিতে থাকে, অনেক সময় বনের বাঘও ঘাস চিবিয়ে খেতে বাধ্য হয়।’

শামারোখের চরিত্র বুঝাতে জাহিদ উপরের লাইনগুলো বলেছেন। এরপর শামারোখের সঙ্গে সম্পর্কের ইতি কেন ঘটলো সেটা বুঝতে গিয়ে লিখেছেন, ‘শামারোখের শারীরিক সৌন্দর্য প্রথমদিকে পূর্ণিমার চাঁদ যেমন সমুদ্রের জলকে আকর্ষণ করে সেভাবে আমাকে আকর্ষণ করেছিলো। কিন্তু তার সঙ্গে মেলামেশার এক পর্যায়ে তার সৌন্দর্যের প্রতি আমি পুরোপুরি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। শেষের দিকে ভয় করতে আরম্ভ করেছিলাম। তার শরীর দেখলে আমার রং করা মাংস বলে মনে হতো। এই সৌন্দর্যের ফাঁসে যাতে আমি আটকে না যাই, পালিয়ে বাঁচতে চেষ্টা করতাম।’ এভাবেই একসময় শামারোখের সঙ্গে জাহিদের সম্পর্কেরও অবসান হয়।

উপন্যাসটা দুই খণ্ডে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রথম খণ্ড শেষ করার পর লেখকের মৃত্যু ঘটে, তাই আমরা লেখকের প্রেয়সী সোহিনী সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতে পারি না। পাশাপাশি বঞ্চিত হয় আরো অনেক নারীর কথা যাদের সঙ্গে লেখকের সংযোগ ছিলো। পুরুষের জীবনের নারীর অবদান বা পুরুষ মানসে নারীর চিত্রই এই উপন্যাসের গতিকে এগিয়ে নিয়েছে। পুরুষের জীবনের নারী কখনও নারীর ভূমিকায় আবার কখনও চালকের ভূমিকায় অবতীর্ণ যেটাকে লেখক ঈশ্বরীর স্বরূপ হিসেবে কল্পনা করেছেন। আর সবকিছু ছাপিয়ে নর-নারীর সেই চিরায়ত প্রেমের জয়গান গেয়েছেন।

জাহিদ তথা লেখকের ভাষায়- ‘মানুষ একজন মাত্র নারীকেই মনে-প্রাণে কামনা করে। আর সেই সম্পূর্ণ নারী। আর সেই সম্পূর্ণ নারী জগতে মহামূল্যবান হীরক খণ্ডটির চাইতেও দুর্লভ। তাই খণ্ড খণ্ড নারীকে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকার ভান করতে হয়। তোমার মধ্যে একটা অখণ্ড নারীসত্তার সন্ধান আমি পেয়েছি। আমার কেমন জানি আশঙ্কা হয়, এই কাহিনি যখন আমি শেষ করবো, তুমি হয়তো এই বিশাল পৃথিবীর কোথাও হারিয়ে যাবে। তবু আমার সুখ, আমার আনন্দ, আমার প্রাণের সমস্ত উত্তাপ কেন্দ্রীভূত করে একটি সম্পূর্ণ নারীকে ভালোবাসতে পেরেছি। জীবনে ভালোবাসার চাইতে সুখ কিসে আছে?’

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com । সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!