শিশুদের কোমল পানীয় কতটা ভালো

কোমল পানীয়ের জনপ্রিয়তা থাকলেও এর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে গবেষণার পরিমাণ খুব অল্পই। গত এক দশক থেকে এর ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় পুষ্টি বিজ্ঞানী, বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও খাদ্য সংস্থার টনক নড়েছে।

শেখ আনোয়ারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Nov 2020, 05:48 PM
Updated : 3 Nov 2020, 05:48 PM

বিশেষজ্ঞরা জানান, কোমল পানীয়ের মধ্যে যে সব উপাদান সচরাচর থাকে সেগুলোর প্রতিক্রিয়া ভয়াবহ। পরীক্ষায় দেখা যায়, ৫০০ গ্রামের কৌটাগুলোতে কার্বন, ১৭০ ক্যালরি সোডা এবং ১৫ চা চামচ চিনি ব্যবহার করা হয়ে থাকে যা ছোটদের ছোট শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

কোমল পানীয়তে কোন পুষ্টি উপাদান তো নেই-ই বরং দেহের জন্য ক্ষতিকর কিছু রাসায়নিক উপাদান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, জাম্বিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বেশ কিছু দেশের গবেষণার প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, কোমল পানীয়ত দাঁতের ক্ষয়রোগ সৃষ্টি করে। মাড়িকে দুর্বল করে তোলে। এর প্রভাবে ডেন্টাল ক্যারিজ বা দাঁত ক্ষয় হয়। হাড়ে, পেশির, লিভারের জটিল রোগ হয়। আর এসবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় শিশু-কিশোরদের।

গবেষণায় দেখা যায়, কোমল পানীয়ের অন্যতম উপাদান হচ্ছে ক্যাফেইন। ক্যাফেইন এক আসক্তিকর মাদক। যা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে উত্তেজিত করে। এটি দেহকে কৃত্রিমভাবে উত্তেজিত করে। হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি করে, সাময়িক বুদ্ধিবৃত্তি বাড়ায় এবং অবসন্ন ভাব বা ক্লান্তি-শ্রান্তি দূর করে। ছোটরা তাই একবার খেলে আবার খেতে চায়।

ক্যাফেইন ব্যবহার হয় বলে তা খেলে ছোটদের নেশা ধরায় আর বড়দের উদ্বিগ্নতা, নার্ভাসনেস এবং সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা সৃষ্টি করে। বেশি কোমল পানীয় খেলে শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। যার ফলে ক্যান্সারের সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়। বেশি ক্যাফেইন শরীরে ঢোকার ফলে তা কিডনি, মূত্রাশয় ও পাকস্থলির ক্যান্সার এবং উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করতে পারে।

এটি ছোট শিশুদের মধ্যে জন্ম বৈকল্য সৃষ্টি করে এবং পাকস্থলির দেয়ালের ক্ষতি করে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ফ্রান্সিসকো কন্টারাইজের মতে, ক্যান্সার হলো বৃক্ষের মতো আর অক্সিজেনবিহীন টিস্যু সেল হলো এর পৃষ্ঠপোষক।

কোমল পানীয় খেতে ছোটদের আগ্রহের কারণ এর টেস্ট। কোমল পানীয়কে সজীবতা ও অম্ল টেস্ট আনতে সাইট্রিক এসিড, ফসফরিক এসিড এবং কখনো মেলিক এসিড ও টারটারিক এসিড ব্যবহার করা হয়। ব্রিটিশ পুষ্টি সংস্থার মতে, অতি মিষ্টি পানীয় অথবা অম্ল স্বাদযুক্ত পানীয় পান করার পর দাঁত পরিস্কার করলেও দাঁতের ক্ষতি হয়।

ব্রিটেনে এক জরিপে দেখা যায়, যে শিশুরা নিয়মিত কোমল পানীয় পান করে তাদের মধ্যে শতকরা ২০ ভাগ দাঁতের রোগে ভোগে। ফেলে দেওয়া দাঁত কোমল পানীয়তে দু’দিন রেখে দিয়ে পরখ করে দেখা যায়, দাঁতটি নরম তুলতুলে হয়ে গেছে।

গবেষকরা বলেন, অধিকাংশ কোলা পানীয় ফসফরাস, ক্যালসিয়াম এবং হাড়ের ক্ষতিকে দ্রুত করে দেয়। মূলত খাবার হজম হবে ভেবে কোমল পানীয় খাওয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে কোমল পানীয় পরিপাকতন্ত্রের খাবার হজমে বাঁধা সৃষ্টি করে। যুক্তরাষ্ট্রের এক সমীক্ষায় বলা হয়, শারীরিক কঠোর পরিশ্রমের পর কোমল পানীয় খেলে ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়ামের অভাব ঘটতে পারে।

অতিরিক্ত ফসফরাস মানুষের পাকস্থলির হাইড্রোক্লোরিক এসিডের সঙ্গে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে পেটে গ্যাস এবং পাকস্থলি ফাঁপা ভাব বা বদহজম হয়। অধিক চাপের কার্বন-ডাই-অক্সাইড কোমল পানীয়তে বুদবুদ সৃষ্টি করে। কার্বন-ডাই-অক্সাইড একটি বিষাক্ত দূষিত পদার্থ। বাতাসে এর পরিমাণ বাড়লে বাতাস দূষিত হয়। অথচ এই দূষিত কার্বন-ডাই-অক্সাইড কোমল পানীয়ের সঙ্গে কি অবলীলায় না মানুষজন খায়। ভাবা যায়? ফলে ফুসফুসের জটিল রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

গবেষণায় দেখা যায়, কোমল পানীয়তে কৃত্রিম মিষ্টিকারক হিসেবে এসপারটেম, এসিসালফেম ও স্যাকারিন ব্যবহার করা হয়। এগুলো স্বাদে মিষ্টি হলেও এর পুষ্টিগুণ নেই। বরং এগুলো স্মরণশক্তি কমিয়ে দেয়। এছাড়া মৃগীর মতো খিচুনি, বমিভাব, ডায়রিয়া, অস্পষ্ট দৃষ্টি, মস্তিষ্কের ক্যান্সার, মূত্রাশয়ের ক্যান্সার সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি করে।

এসব খেলে লিভার সিরোসিসের মতো জটিল রোগ হতে পারে। ইনসুলিনের আবিষ্কারক চার্লস বেস্ট এর মতে, যারা অত্যধিক কোমল পানীয় গ্রহণ করে, তাদের লিভার সিরোসিস হওয়ার সম্ভাবনা তাদের সমপরিমাণ, যারা দীর্ঘদিন ধরে উচ্চমাত্রায় অ্যালকোহল গ্রহণ করে থাকে। আর সিরোসিসের একমাত্র আধুনিক চিকিৎসা হলো ‘লিভার ট্রান্সপ্লান্ট’। এছাড়া কোমল পানীয় মূল উপাদান ৯৯% ডিসটিলড ওয়াটার। সমীক্ষায় দেখা যায়, যে যতো বেশি ডিসটিলড ওয়াটার পান করবে তার মধ্যে ততো খনিজ পদার্থের স্বল্পতা ও এসিড অবস্থার সৃষ্টি হবে।

এছাড়া কোমল পানীয়ের সংরক্ষণ মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য কার্বলিক এসিড বেনজয়িক এসিড বা সোডিয়াম বেনজয়েট দেয়া হয়। এগুলো হাঁপানি, ফুসকুড়ি এবং শরীরের অতি সক্রিয়তার কারণ ঘটায়। পরিস্কার করতে যে সালফার ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করা হয় তা কোমল পানীয়তে সংরক্ষক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই পদার্থ শরীরে ঢুকে চোখ মুখ রক্তের মতো লাল লাল করে তুলে। এছাড়া মূর্ছাভাব, ত্বক স্ফীতি, মাংসপেশী ফোলা, দুর্বলতা, বুকের টান টানভাব ঘটায় এবং হাঁপানি রোগীর হাঁপানি বেড়ে যায়।

কোমল পানীয়তে ব্যবহৃত কৃত্রিম রঙের মূল উপদান টারট্রাজিন। দেখতে কমলা-হলুদের মতো। এটি মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষজ্ঞের মতে, এই রঙ অ্যালার্জিক বিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বলা হয়, এটি ক্যান্সার সৃষ্টিকারক এজেন্ট। নামকরা ব্র্যান্ডের পানীয়তেও টারট্রাজিন থাকে। তাই নরওয়ে ও সুইডেন, ফিনল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে কোমল পানীয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এছাড়া কোমল পানীয়কে ঠান্ডা রাখার জন্য ইথাইলিন গ্লাইকোল দেওয়া হয়। এই রাসায়নিক পদার্থ আর্সেনিক বিষের মতোই ধীরঘাতক। তাই এক ঘণ্টার মধ্যে ৪ লিটার কোমল পানীয় খেলে মৃত্যুবরণ করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

কোমল পানীয় গ্রহণে সবাইকে খুবই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। প্রয়োজনে পানিশূন্যতার জন্য ডাব বা লেবুপানি খাওয়া যেতে পারে। এছাড়া খাওয়া যেতে পারে গ্লুকোজযুক্ত স্যালাইন যা শরীরের লবণ-পানির শূন্যস্থান পূরণ করে ফিরিয়ে দেয় প্রাণচাঞ্চল্য।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!