ছোটগল্প: রমা ও একটি আমগাছ

রমার যেদিন জন্ম হলো সেদিন ছিল জ্যৈষ্ঠ মাসের দ্বিতীয় সোমবার। রমার বাবা আমাকে রোপন করেছিল ওদের বাড়ির উঠোনের পূর্ব কোণে।

বিএম বরকতউল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Oct 2020, 11:37 AM
Updated : 13 Oct 2020, 11:47 AM

তিনি আগে থেকেই গর্ত করে শক্ত মাটিগুলো গুঁড়ো করে রেখে দিয়েছিলেন। আর গর্তের মাটিগুলো ছিল গোবর আর ছাই মেশানো। প্রায় দেড়ফুট গর্তের ভেতরে আমাকে রোপন করা হলো। তারপর রমার বাবা নরম হাতে ধীরে ধীরে গর্তের পাড়ের মাটিগুলো দিয়ে গর্তটি ভরাট করে দেয়।

তারপর এক বালতি পানি এনে ছিটিয়ে দিয়ে গর্তের ও পাশের মাটি ভিজিয়ে দেয়। আমি যাতে বাতাসে হেলেদুলে পড়ে না যাই সেজন্য আমার গা ঘেঁষে কোপে দেয় আমার সমান এক খণ্ড বাঁশ। তারপর রশি দিয়ে তিন জায়গায় বাঁশের সঙ্গে আমাকে ঢিলে করে বেঁধে দেওয়া হলো।

তখন অবশ্য আমার বোনদের কথাই বেশি করে মনে পড়ছিল। আমরা একই নার্সারিতে একসঙ্গে বেড়ে উঠেছি। রমার বাবা যখন আমাকে দর করে কিনে নিয়ে আসে তখন আরেকজন নিয়ে যাচ্ছিল আমার অন্য বোনদের। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কষ্টে মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমাদের।

কারণ আমরা জানতাম না কে কেমন মালিকের হাতে গিয়ে পড়ি। মালিক যদি বেখেয়ালি ধরনের হয় তবে কষ্টের সীমা থাকবে না। আমরা বিদায় নিয়ে যে যার মালিকের বাড়ি চলে গেলাম। আমার মতো যদি ওদের ভাগ্যটা ভাল হতো! আহারে আমার সোনা বোনেরা, জানি না কেমন আছে ওরা।

দুই.

আমার পরিষ্কার মনে আছে, আমাকে যেদিন রোপন করা হয় সেদিন রাতেই রমার জন্ম হয়। আমিই প্রথমে নবজাতকের কান্নার শব্দ শুনেছিলাম। ওর কাঁপা কাঁপা ছোট ছোট কান্নার শব্দের ভেতরে এক ধরনের আনন্দ মিশে ছিল। ওর কান্না শুনে প্রতিবেশিরা দৌড়ে এসে ঘরের সামনে ভিড় করে। তারা জানতে চেয়েছিল ছেলে হয়েছে, না মেয়ে।

তখন কেওরের একটি ডালা ফাঁক করে এক মহিলা ফিস ফিস করে বলল, মেয়ে হয়েছে গো মেয়ে। চান্দের লাহান! তখন সবার সঙ্গে আমিও আনন্দে নেচে উঠেছিলাম। নাচের তোড়ে আমার শরীর থেকে দুটো পাতা ঝরে পড়ে গিয়েছিল। আহ নতুনেরা কী বার্তা আর আনন্দ নিয়ে আসে পৃথিবীতে!

সেই রমা এর ওর কোল থেকে এক সময় ভেতরবাড়ির উঠোন পেরোলো। তারপর একদিন কচি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে আমাকে স্পর্শ করে বলেছিল, ‘এতা আমাল আমগাথ’, আর সেদিন আমার পুরো শরীর আনন্দে ভরে গিয়েছিল।

তারপর কত সময় গড়িয়ে গেল!

আমার সবুজ পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা রং ধরা আম ঠিকই রমার চোখে পড়ত। সে তখন তার আব্বু ও আম্মুকে আঙুলে দেখিয়ে বারবার বলতো, ওই যে পাকা আম, ওটা আমার। এখনই পেড়ে দাও। আদরের মেয়ে রমা। ওর আবদার রক্ষা না করে স্বস্তি পেত না কেউ।

রমা মনের সুখে আম খেতো। আমের রস কনুই বেয়ে নিচে পড়ে যেতে চাইলে সে জিহ্বাটা লম্বা করে সুরুত করে একটা টান দিয়ে রসটুকু খেয়ে ফেলতো। এই দেখে আমি ভারি মজা পেতাম।

রমা আমার শিকড়ে বসে ছোট ছোট মাটির পাতিলে বহুবার ভাত তরকারি পাক করেছে। সে মায়ের মতো বসে খাবার রান্না করে খেয়েছে ও অন্যদের বিলিয়ে দিয়েছে। আমাকেও খাইয়ে দিয়েছে। সে আমার যেমন প্রশংসা করতো তেমনি আবার আমার সঙ্গে অভিমান করতো। কখনো বা মায়ের মতো শাসন করতো। তখন খুব গর্ব হতো আমার। আমি যে রমাকে কতটা পছন্দ করি রমা মনে হয় সেটা ভাল করেই বুঝতে পারতো। এমনই শত সহস্র ঘটনার ভেতর দিয়ে রমা কখন যে বড় হয়ে গেছে টের পাইনি আমি।

তিন.

আজ রমার বিয়ে। একমাত্র আদরের মেয়ের বিয়েতে খরচও হবে মেলা। অনেক টাকা যোগাড়-যন্তের ব্যাপার। শেষমেষ রমার বাবা আমাকে বিক্রি করে দিল। করাতিরা এসে রেত দিয়ে করাতের দাঁতে শান দিচ্ছে। রেতের কর্কশ শব্দের ভেতরে আমি রমার বিয়ের সানাইয়ের সুর শুনতে পেলাম।

রমার বাবা ছুটে এসে বলল, আমি এক দিনে দুজনকে বিদেয় করতে চাই না। তোমরা বরং কাল এসো, তিনি একথা বলে করাতিদের বিদায় করে দিলেন। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

বাড়ি ভর্তি মানুষ-বাড়ি ভর্তি আনন্দ। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম সেই রমা কারূকাজ করা রঙ্গিন কাপড় মুড়িয়ে ঘোমটা টেনে বসে আছে। সবার মুখে হাসি। শিশুরা আনন্দে ছোটাছুটি করছে। সাজানো বাড়ির ভেতরে ও বাইরে হাসিমুখে মানুষের ব্যস্ত আনাগোনা। এরই মাঝে ধমক খেয়ে কয়েকটা কুকুর ছুটে এসে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। আবার ইনিয়ে বিনিয়ে চলে যায় সামিয়ানার তলে যেখানে অতিথিদের আদর-আপ্যায়ন চলছে।

চার.

বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল। রমার বিদায়ের পালা। গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসেছে সে। এখন গাড়িতে উঠবে। এরই মাঝে রমা একটি অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল। সে সবার মাঝ থেকে ছুটে এসে আমাকে পেঁচিয়ে ধরে চিঁ চিঁ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

বরপক্ষের লোকেরা অপ্রস্তুত ভাবে তাকিয়ে থাকল। আর রমার বাড়ির লোকজনেরা মুখ ঢেকে চোখের জল ফেলল। রমা কাঁদল, জল ফেলল। সে কিছু না বলেও তার চোখের জলধারা আমাকে অজস্র কথা বলে গেল। তারপর একজন মহিলা রমার হাতটি ধরে ধীরপায়ে গাড়িতে নিয়ে বসিয়ে দিল। গাড়িটি ধীরে ধীরে চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেল।

রাত পোহাতেই চলে এলো করাতিরা। আমাকে একটি ঠেলাগাড়িতে নিয়ে তোলা হলো। অতপর যে পথ ধরে গতকাল রমা শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল সে পথ ধরে ঠেলাগাড়িটি চলে গেল স’মিলের দিকে। তখনও রমার বিয়ের আনন্দের রেশ আমার সামনে আলোছায়ার মতো খেলা করছিল।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!