মাহতাব হোসেনের গল্প: অভিশপ্ত ট্রেন

খয়রাত নগর স্টেশন। নীলফামারী জেলার মফস্বলের একটি রেলওয়ে স্টেশন। জীর্ণ প্লাটফর্ম, নেই স্টেশন মাস্টার। ইলেকট্রিসিটির বালাই নেই।

মাহতাব হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Oct 2020, 04:39 AM
Updated : 10 Oct 2020, 01:45 PM

রেল স্টেশনের পশ্চিমে একটি ছোট বাজার, সেখানে হাতেগোনা কিছু চা-আনাজের দোকান। দুর্বল কিছু ইলেকট্রিক সোলার প্যানেল দিয়ে সেইসব দোকানে আলো জ্বলে, ক্যাসেট প্লেয়ারে গান বাজে। সন্ধ্যা নামার পর সেই বাজার প্রাণহীন হয়ে গেছে।

এখন বাজে রাত দেড়টা। শীতের রাত, কুয়াশা ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। এই রাতে ভগ্ন প্লাটফর্মে আমরা ৫ জন বসে আছি। নিরবতা ঘনীভূত হয়ে আসছে। বাস স্ট্রাইক, তাই সন্ধ্যা থেকে লোকাল ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। গোয়ালন্দঘাট নামে রাত দশটায় একটা ট্রেন আসার কথা, অথচ এখনও সেই ট্রেনের হদিস নেই।

 আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কথা বলে শাহেদ, সেই শাহেদও হাজারবার ট্রেনের গুষ্টি উদ্ধার করে এখন চুপ। একটানা ঝিঁঝিঁ ডেকে যাচ্ছে। এই নির্জন মধ্যরাতে একটি মফস্বল স্টেশনে বসে আঁধার দেখছি ৫ তরুণ। সোহেলের কথা শুনলে অবশ্য এই দুর্ভোগ পোহাতে হতো না। আমরা যদি পায়ে হেঁটে অন্তত সৈয়দপুর পর্যন্ত যেতে পারতাম তাহলে হয়তো দুর্ভোগ হতো না। ইশ! কেন যে অলস রিফাতের কথা শুনে থেকে গেলাম। নিজের উপরই রাগ লাগছে।

এরই মধ্যে জুয়েলের কাছে থেকে একটা গল্প শুনে সবাই চুপসে গেছে। চুপসে যাবেই বা না কেন, এটা তো গা শিউরে ওঠার মতো গল্প। এই রেলপথে নাকি মাঝে মাঝে একটি অভিশপ্ত ট্রেন চলাচল করে। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় সৈয়দপুরের হিন্দু মাড়োয়ারিদের নিরাপদে ভারতে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে একটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করে পাক মিলিটারিরা। তাদের কথায় বিশ্বাস করে কয়েকশ পরিবার সেই ট্রেনে আরোহন করে।

ট্রেন সৈয়দপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে খয়রাত নগর আর সৈয়দপুরের মাঝামাঝি পৌঁছলে আকস্মিক থামিয়ে সমস্ত যাত্রীকে হত্যা করে পাকিস্তানি মিলিটারিরা। গুলি, ব্রাশফায়ার, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে সবাইকে হত্যার পর মালামাল, স্বর্ণালংকার লুট করে নেয় তারা।

তারপর থেকে নাকি এই রেলপথে মাঝে মাঝে ভৌতিক এই ট্রেনের আবির্ভাব ঘটে। এই গল্প জুয়েল তার দাদুর কাছে ঢাকাতেই শুনেছিল। দাদুর এক বন্ধু তখন সৈয়দপুর রেলকারখানায় চাকরি করতো।

না! ট্রেনের কোনও চিহ্নই নেই। আজ আসবে কিনা তাও আর বলা যাচ্ছে না। স্টেশন মাস্টার থাকলে তাও বুকে সাহস থাকতো। পেটে ক্ষুধা কিছুটা জানান দিচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে কেন এই সফরে আসলাম। উফ! অবশ্য একেবারে অকারণ সফর ছিল না এটা। আমরা এসেছিলাম এখানকার টেক্সটাইল মিলে। আমাদের প্রত্যেকেরই কলেজে ডিপ্লোমার সাবজেক্ট টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং। তাই প্রত্যক্ষ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ, বিশেষ করে সরকারি টেক্সটাইলে মিলের জন্যই এই ভ্রমণ।

এই মফস্বল এলাকার টেক্সটাইল মিলটিকে বেছে নেওয়ার জন্য অবশ্য আরেকটি কারণ আছে। এর আশপাশে তিস্তার বিশাল বিশাল কৃত্রিম সেচ ক্যানেল তৈরি করা হয়েছে। সেইসব ক্যানেল দিয়ে স্বচ্ছ টলটলে পানি প্রবাহিত হয়। আছে সাইফন। সামনে ছোট ছোট নদী পড়লে নদীর উপর দিয়ে ক্যানেলের পানি প্রবলবেগে ছুটে যায়। এসব রোমাঞ্চকর দৃশ্য দেখার জন্যই এ এলাকা সফর।

রাত যত গভীর হচ্ছে শীত তত বাড়ছে। শাহেদ আর রিফাতের মধ্যে এ শীতেও চলছে খুনসুটি। তবে যতই কষ্ট হোক না কেন সোহেল আর আমি এ ভ্রমণ দারুণ এনজয় করেছি। নদীর উপর দিয়ে আরেকটি নদীর মতো ক্যানেল দিয়ে ছুটে যাচ্ছে পানির স্রোত। সেই স্রোতে ভেসে গেছি আমি আমার পিছনে সোহেল উফ! কী রোমাঞ্চকর ব্যাপার।

জুয়েলের রিস্টওয়াচে রাত দু’টার সংকেত পড়ে। ভাগ্যিস জুয়েল এ রিস্টওয়াচটা সঙ্গে নিয়ে এসেছিল, না হলে মুঠোফোনের যুগেও এ রাত-বিরেতে সময় জানা হত না। আমাদের কারো ফোনে চার্জ নেই।

হঠাৎ করেই রিফাত আর সোহেল চিৎকার দিয়ে উঠে- ট্রেন আসছে। দূরে ট্রেনের ইঞ্জিনের ক্ষীণ আলো রেখা দেখা দেয়। কুয়াশা ভেদ করে আলো আরো কাছে আসে। নিকশ আঁধারে সবার মুখের উচ্ছ্বাস বোঝা যাচ্ছে। ট্রেন এসে থামতে না থামতেই আমরা হুড়মুড়িয়ে ট্রেনে উঠে পড়ি।

কামরায় আলো নেই, বিন্দুমাত্র আলো নেই। উফ! লোকাল ট্রেনের কমন বৈশিষ্ট্য। অন্ধকারে কারো মুখ দেখা যায় না। ট্রেনের সিটগুলো অস্বাভাবিক নরম, গদির মতো। গার্ডও মনে হয় ঘুমিয়েছে। কারণ, হুইসেল ছাড়াই ট্রেন চলতে শুরু করেছে।

কামরায় অন্য কোনও যাত্রী নেই, আমরা শুধু পাঁচজন। আলো না থাকলেও অন্যান্য লোকাল ট্রেনের চেয়ে এ ট্রেনের বগিগুলোর ভেতরটা অনেকট উন্নত। এমনকি জামালপুর কমিউটার ট্রেনের চেয়ে শতগুণে ভালো। নাকে বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধি আসছে। রিফাত তার ঢাকার পরিকল্পনার কথা বলতে শুরু করে, ঢাকায় গিয়ে কী করবে, এটা-সেটা, আরো কত হাবিজাবি।

ট্রেন খুবই ধীরগতিতে চলতে শুরু করেছে। শাহেদ ব্যাগ থেকে দু’দিন আগের স্যান্ডউইচ আর পানি বের করে খেতে শুরু করে। এবার নাকে উৎকট গন্ধ এসে ধাক্কা খায়। হঠাৎ শাহেদ উফ করে শব্দ করে। কারণ বুঝলাম না। পানির বোতল ছিটকে আমার গায়ে এসে পড়ে। হঠাৎ শাহেদ গোঙাতে গোঙাতে সামনের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

সেদিকে তাকাতেই বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে আমার। আবছা আলোয় অনেকগুলো কাটা মাথা লুটোপুটি খাচ্ছে ট্রেনের কামরায়। কি আশ্চর্য! কি ভয়ানক! ট্রেনের গতি তো রকেটের চেয়ে বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে। ট্রেন উড়ে যাচ্ছে নাকি? সোহেল আর আমি বাকি তিনজনকে ধরে ট্রেন থেকে লাফ মেরেই জ্ঞান হারালাম।

চোখ যখন মেলি- দেখি আমি হাসপাতালের বিছানায়। মনে পড়ল ট্রেনের কথা। কারো কারো হাতে পায়ে ফ্র্যাকচার ছাড়া তেমন ক্ষতি হয়নি। বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। তবে আম্মুর হাত থেকে রেহাই নেই। সবারই আব্বু অথবা আম্মু রংপুর আসছে। খুব সকালে যারা জমি চাষ করতে গিয়েছিল তারাই আমাদের অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তি করিয়েছে এবং ঢাকায় খবর দিয়েছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো এসে পৌঁছবে সবাই। নতুন খবর পেলাম যে এ অভিশপ্ত ট্রেনে চড়ে ওই এলাকার অনেকেই নিরুদ্দেশ হয়েছে। গোয়ালন্দঘাট ট্রেনটি গতরাতে চিলাহাটিতে লাইনচ্যুত হয়েছে, তাই আসতে পারেনি।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com । সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!