আমাদের দেশে উৎপাদিত ও ব্যবহৃত বিদ্যুৎ আসলে জলবিদ্যুৎ বা হাইড্রো ইলেকট্রিক কারেন্ট। এ বিদ্যুতে চাহিদা পূরণ না হওয়ায় বর্তমানে পারমাণবিক শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তর করে বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রচেষ্টা চলছে।
কেমন করে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়?
তাইতো? কিভাবে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়? ঠিক জবাবটা কোথায় পাই? অথচ বিদ্যুৎ ব্যবহার সবাই করছি। তবু আশ্চর্য! ব্যাপারটা আমরা অনেকেই জানি না। বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় টারবাইনের সাহায্যে। পানি শক্তি চালিত যন্ত্রের বড়ো বড়ো চাকাকে বলে টারবাইন। টারবাইন ঘুরে পানির সাহায্যে। কারণ পানি প্রবাহের চাপ শক্তি খুবই প্রচণ্ড। এই প্রচণ্ড চাপ শক্তির দ্বারা বড়ো বড়ো মেশিন চালানো যায়। পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এ শক্তিটাই বিদ্যুৎ শক্তি হিসেবে কাজে লাগানো হয়।
বিদেশে আছে জলপ্রপাত। জলপ্রপাতের যেখানে অনেক উপর থেকে পানি গড়িয়ে নিচের দিকে নামে প্রচণ্ড বেগে, ঠিক সেখানে টারবাইনের পাখাটা পেতে দেওয়া হয়। আর পানির প্রচণ্ড ধাক্কায় পাখাটাও বনবন করে ঘুরতে থাকে। তা থেকে তৈরি হয় বিদ্যুৎ।
এখন বিজ্ঞানীরা সাগরের ঢেউকেও বিদ্যুৎ উৎপাদন কাজে ব্যবহারের কথা ভাবছেন। সাগরের অবিরাম ঢেউগুলো প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে সবকিছুকে ধাক্কা মেরে ফেলে আসে। ঢেউয়ের এই শক্তিকেই কাজে লাগাতে চাইছেন বিজ্ঞানীরা। সাগরের তীরে যেখানে দূর থেকে ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে, সেখানেই ব্লেড পেতে রাখা হবে। অবিরাম চলতে থাকবে ঢেউয়ের ধাক্কা। সেই ধাক্কায় একদিন আমাদের পাখা ঘুরবে, তৈরি হবে বিদ্যুৎ।
চলো এবার একটা ছোটো খাটো পরীক্ষার দ্বারা ঘরে বসে তেমনই একটা জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বা টারবাইন বানিয়ে বাড়ির সবাইকে অবাক করে দেই।
কেমন করে বানাতে হয়?
বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বানাতে হলে তোমার দরকার হবে একটা বড় ছিপি বা কর্ক, পানির বা কোল্ড ড্রিংক্স এর পুরনো কয়েকটা শক্ত প্লাস্টিক বোতল। সেভেন আপ এর বোতলগুলো সাধারণত শক্ত হয়। তাই দেড় লিটারের সেভেন আপের বোতল ব্যবহার করা যেতে পারে।
এছাড়া লাগবে শক্ত প্লাস্টিক পাইপ বা স্ট্র, এক্ষেত্রে উল বুনোনের মোটা সুঁই বা কাঠি বা কাটাও ব্যবহার করা যেতে পারে। সে সঙ্গে দরকার বেশ লম্বা এক টুকরো সুতো, একটা সিডি এবং কিছু পরিমাণ শক্ত বাইন্ডিং টেইপ।
ছিপিটার লম্বা অংশের মধ্য দিয়ে উল বুননের মোটা বা শক্ত কাঁটা ঢোকাতে হবে। এবার চিত্র অনুযায়ী কর্কের চারপাশে সমান দূরত্ব রেখে ছয়টা শক্ত প্লাস্টিক বোতলের অর্ধেক অংশ বসাও। এই প্লাস্টিকের পাত বা প্লাস্টিক বোতলের ফালি করে কেটে আগেই আলাদা করে রাখা হয়েছে। নিশ্চয়ই মনে আছে? এবার সেগুলো শক্ত বাইন্ডিং টেইপ দিয়ে চিত্র দেখে দেখে সমান দূরত্বে বসাও।
এসময় খেয়াল রাখবে, যাতে উল বোনার কাঁটা বা শক্ত প্লাস্টিকের পাতের সঙ্গে নব্বই ডিগ্রি কোণ উৎপন্ন করে প্লাস্টিকের পাতগুলো বাঁধা থাকে। এজন্য চিত্রের মতো করে খুব শক্তভাবে হাতের আঙুলে চাপ দিয়ে প্রতিটা কাটা অংশে একটা করে প্লাস্টিকের পাতলা পাত ঢোকাও ও টেইপ দিয়ে মজবুত করে আটকাও। এবার পানি ঢালার জন্য একটা প্লাস্টিক বোতলের পাত (চিত্রের মতো) ঢেউ আকারে কেটে নাও। এমনভাবে তা বসাবে যেনো কল থেকে পানি ছেড়ে দিলেই ওই ঢেউ খেলানো চোঙার মধ্য দিয়ে পানি প্রবাহ সরাসরি তোমার বানানো টারবাইনের ব্লেডগুলোর উপরে এসে পড়ে।
এবার আগেই সংগ্রহ করা কম্পিউটারের বাতিল একটা সিডি বা ডিভিডি ডিস্ক নাও। এক্ষেত্রে অন্য কোন হালকা ওজনের জিনিস হলেও চলবে। এই ডিস্কের সঙ্গে বেশ কিছুটা লম্বা সুতো বেঁধে সুতোর প্রান্তটা শক্ত কর্কের সঙ্গে মজবুত করে বাঁধা প্লাস্টিক দণ্ড বা উলের কাঁটার সঙ্গে বাঁধো।
ব্যস। এবার খেলার জন্য প্রস্তুত তোমার হাতে বানানো বিদ্যুৎ উৎপাদন মেশিন বা টারবাইন। কিন্তু ঘরে তো আর জলপ্রপাত বা নদী নেই। তাই এই খেলায় তোমার হাতে বানানো বিদ্যুৎ কেন্দ্র বা টারবাইনটা ঘুরাতে জলপ্রপাতের কাজ করবে ঘরের পানির টেপ। এখন তোমার টারবাইনকে কলের পানির ধারার নিচে স্থাপন করতে হবে। পরখ করে দেখতে হবে, কী অবস্থা হয়।
ভালো করে খেয়াল করে দেখো। কলের পানি তোমার হাতে বানানো টারবাইনের প্লাস্টিকের পাখার উপর পতিত হবার সঙ্গে সঙ্গে টারবাইনটা ঘুরতে থাকবে। সঙ্গে টারবাইনের দণ্ডের সঙ্গে থাকা সুতোটাও ঘুরে ঘুরে দ্রুত প্যাঁচিয়ে সিডিকে প্রচণ্ড শক্তিতে কাছে টেনে নেবে। ঘূর্ণনের এই গতিটা কম বেশি নির্ভর করবে পানির স্রোতধারা কতটা বেশি কিংবা কতটা কম তার উপর। তাই সিডির সঙ্গে বাঁধা সুতোটা একটু লম্বা হলে ভালো হয়। না হলে নাটাইয়ের মত টারবাইনে সুতো প্যাঁচিয়ে সিডিটা দ্রুত কাছে চলে আসবে।
এমন কেন হয়?
তাই তো? কেমন করে এমন হয়ে থাকে? একবার কি তোমরা ভেবে দেখেছো? এখানে শক্ত প্লাস্টিক স্ট্র কাটা বা ওলের কাঠিটা বিদ্যুতের কেন্দ্রীয় আবর্তনশীল চালক দণ্ড হিসেবে কাজ করেছে। এই কাঠিটাই ছিপি বা কর্কটাকে ঘুরাতে সহায়তা করেছে। ছিপিটার উপর গেঁথে টেইপে শক্ত করে আটকে রাখা প্লাস্টিকের পাতলা পাখাগুলোর মধ্যে যখনই পানি পড়ছে তখন পানির প্রবল চাপে এই পাতলা পাখা নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। যার ফলে ছিপিটা ঘুরছে এবং পরের প্লাস্টিকের পাখাটা ঘুরার জন্য পানির স্রোতধারার কাছে চলে আসছে।
এভাবেই একের পর এক চলমান প্রক্রিয়ায় পাখাগুলো পানির স্রোতধারায় আসছে এবং সঙ্গে সঙ্গে অনবরত ঘুরে চলেছে। এ শক্তি পানির চাপ শক্তি। এভাবেই পানির চাপ শক্তির সাহায্যে তৈরি হচ্ছে জলবিদ্যুৎ। বাস্তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে পানির এই চাপ শক্তিকে এভাবে কাজে লাগানো হয়। ঠিক যেমন ভাবে চলছে তোমার হাতে বানানো টারবাইন।
আধুনিক পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র বা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টগুলোতে নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের তাপ ব্যবহার করা হয় যা স্টিম টারবাইন জেনারেটরকে চালায়। যুক্তরাষ্ট্রে শতকরা ২০ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট ব্যবহার করে। বিদ্যুতের জন্য বাংলাদেশেও গড়ে তোলা হচ্ছে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট। বড় হয়ে তোমরা বিদ্যুৎ নিয়ে আরও অনেক কিছু জানার সুযোগ পাবে।
লেখক পরিচিতি: শিশু সাহিত্য ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নিয়ে লেখালেখি করছেন প্রায় দুই যুগ ধরে। শিশু অ্যাকাডেমি সাহিত্য পুরস্কারজয়ী এ লেখকের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৬৪।
কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না! |