তুলতুলিদের গ্রামে অদ্ভুত স্পেসশিপ

তুলতুলিদের গ্রামটা এখনও অজপাড়াগাঁ রয়ে গেছে। বিদ্যুৎ সংযোগ পাশের গ্রাম পর্যন্ত এসে থেমে গেছে। এ গ্রামে এখনও ঢোকেনি। মোবাইল বা ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রেও গ্রামটি পিছিয়ে আছে।

কল্যাণী সেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 August 2020, 04:11 AM
Updated : 17 August 2020, 04:11 AM

গ্রামের শেষ প্রান্তে নেটওয়ার্ক খানিকটা পাওয়া গেলেও গ্রামের ভেতরে একেবারেই থাকে না। এ গ্রামে ব্যাটারির সাহায্যে টিভি চলে হাতেগোনা কয়েকটি বাড়িতে। খেলা দেখতে হলে আশপাশের মানুষজন সেইসব বাড়িতে ভিড় করে। ছেলেরা ক্রিকেট খেলা দেখতে পছন্দ করলেও ফুটবলই বেশি খেলে। তবে শীতকালে যে ব্যাডমিন্টন খেলা হয় সেটা এই গ্রামের কেউ কেউ জানে।

তুলতুলিদের বাড়ির পিছনের দিকটা ঘন গাছগাছালিতে পূর্ণ। সেরকম একটা ঝোপের আড়ালে অনেকটা খোলা জায়গা জুড়ে একটা বড় ধানের গোলা কেউ বোধহয় নতুন বানিয়েছে। গোলাটা একটা মাচার ওপর বসানো। আগে চোখে পড়েনি। পুকুরপাড়ের দিকে যেতে যেতে আনমনে একবার তাকিয়ে দেখল তুলতুলি। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। তার বয়সী পাড়ার আরও আট দশজন ছেলে-মেয়ে মিলে চড়ুইভাতি করবে ভেবেছে।

সবাই বাড়ি থেকে দুই মুঠো চাল, একমুঠো ডাল, একটা ডিম, একটা আলু, দুইটা পেঁয়াজ, দুইটা কাঁচামরিচ, এক চামচ লবণ, এক চামচ মশলা আর আধা কাপ তেল আনবে। তারা শাড়ি দিয়ে পুকুরপাড়ের খোলা মাঠে চড়ুইভাতির ঘর বানাবে। নিজেরাই মাটির চুলা বানিয়ে রান্না করবে। খিচুড়ি আর ডিম ভুনা খাবে, গান গাইবে, হইচই করবে। অনেক মজা হবে।

সেই মতই তারা কাজ শুরু করেছিল। তুলতুলিদের থেকে দুই এক বছরের বড় হবে এমন কয়েকজন বখাটে ছেলে পাশে ব্যাডমিন্টন খেলছিল। শাড়ি দিয়ে তুলতুলিদের ঘর বানাতে  দেখে তারা এসে সেই ঘর ভেঙে দিল। ব্যাডমিন্টন দিয়ে ডিমগুলো সব ভেঙে ফেলল। এদের মধ্যে একজনের নাম বিল্টু। তার হাতের ব্যাডমিন্টনটা বেশ সুন্দর। অন্যদের র‍্যাকেটের মাঝের নেটটা নাইলনের দড়ি দিয়ে তৈরি। বিল্টুর নেটটা খুব নিখুঁত জালের মতো। বিল্টু তার র‍্যাকেটটা ডিমের কাছাকাছি আনতেই ডিমটা চুম্বকের মত র‍্যাকেটের দিকে ছুটে গেল এবং আটকে গেল। সে র‍্যাকেটটা ঝাড়া দিতেই ডিমটা টুপ করে পড়ে ভেঙে গেল।

কেউ র‍্যাকেটের কথা জিজ্ঞেস করলে বিল্টু উত্তর দেয় এটা তার মামা বিদেশ থেকে পাঠিয়েছে। সে র‍্যাকেটটা কাউকে ছুঁতেও দিচ্ছে না। চড়ুইভাতি পণ্ড হয়ে গেল।

সন্ধ্যে হয়ে গেছে। তুলতুলি বাড়ির পেছনের নতুন ধানের গোলার পাশ দিয়ে বাড়ি যাওয়ার সময় গোলাটাকে লক্ষ্য করলো। গোলাটার গায়ে একটা গর্তমতো জায়গা আছে। তুলতুলির মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে আছে। বাড়ি যেতেও ইচ্ছে করছে না। সে গোল গর্তমতো জায়গাটায় গিয়ে বসলো। আরো কিছুক্ষণ পর বাড়ি যাবে। তুলতুলি সেখানে বসতেই এক অদ্ভুত কাণ্ড হলো। গর্তটা ভেতরের দিকে ডেবে গেল এবং সে একটা চিকন সুরঙ্গের মতো রাস্তা দিয়ে গভীর গর্তের মধ্যে পড়ে যেতে লাগলো। সে টের পেল তার চোখের সামনের সবকিছু ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে এবং একসময় সে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।

তুলতুলির মনে হল সে যেন ঘুম থেকে জেগে উঠলো। এখন সকাল না বিকেল সে বুঝতে পারছে না। সে দেখতে পেলো তাকে ঘিরে বসে আছে কিছু অদ্ভুতদর্শন প্রাণী। এমন প্রাণী সে আগে কখনো দেখেনি। এদেরকে দেখে সে একটু ভয় পেয়ে গেল।

ধানের গোলার মতো দেখতে জিনিসটা আসলে একটা স্পেসশিপ। এতে করে বেশ কয়েকজন ভিনগ্রহের প্রাণী এখানে এসেছে। এরা উচ্চতায় তুলতুলি বা বিল্টুর সমানই হবে। শরীরের তুলনায় মাথাটা বেশ বড় এবং গোল। শরীরটা অনেকটা পেঙ্গুইনের মতো। ছোট ছোট পা আছে। প্রত্যেকের শরীরের পিছনে দুটি ডানা আছে যেগুলো দেখতে হুবহু ব্যাডমিন্টনের মতো এবং প্রাণীগুলো পাখির মতো ডানা ঝাপটাতে পারে। ডানার সাহায্যে ছোট ছোট লাফ দিয়ে অল্প দূরত্বে উড়ে যেতে পারে। তবে ধপ করে মাটিতে পড়ে না। ধীরে ধীরে শরীরটাকে নিচে নামাতে পারে।

এরা পানিতেও সাঁতার কাটতে পারে ডানার সাহায্যে। এরা গ্রামটিতে এসে নামে রাতের বেলা। পুকুরপাড়ে একটা প্রাণীকে মাছ খেতে দেখে এদের একজনের খুব মাছ খেতে ইচ্ছে করে। প্রাণীটি তাদের দেখে ভয়ে মাছ ফেলে পালিয়ে গেলে সে মাছটি তুলে খায় এবং খুব মজা পায়। তখন একে একে বেশ কয়েকজন পুকুরে নেমে তাদের ডানার সাহায্যে মাছ ধরে ওপরে ওঠে। এদের মধ্যে একজনের ডানা পানিতে পুঁতে রাখা একটা বাঁশের সঙ্গে আটকে যায়। এদিকে আকাশ ফর্সা হতে থাকে। গ্রামের লোকজনের জেগে ওঠার সময় হয়েছে দেখে তারা তাড়াতাড়ি স্পেসশিপের কাছে চলে আসে।

টানাটানি করার কারণে যার পাখাটা বাঁশের সঙ্গে আটকে গিয়েছিল সেটা খসে পড়ে যায়। ডানাটা তাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সেটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও আবার জোড়া লাগানো যায়। তবে এটি ছাড়া চলাফেরা করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এরা দিনের আলোয় দেখতে পায় না। রাতে আলো ছাড়াও দেখতে পায়।

তুলতুলিকে তারা অনুরোধ করে ডানাটা উদ্ধার করে এনে দেবার জন্য। তারা আগামীকাল রাতে এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে। এই গ্রামটিতে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই বলে সন্ধ্যার পরে গ্রামের লোকজন বেশি সময় জেগে থাকে না। তুলতুলি পড়ালেখায় খুবই ভালো। এত সীমিত সুযোগ সুবিধার মধ্যেও সে স্কুলে প্রথম হয়। গ্রামে একটাই প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। আর মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি গ্রামের একদম শেষ প্রান্তে।

গ্রামে কোন কলেজ নেই। কলেজে পড়তে হলে শহরে যেতে হয়। তুলতুলির স্বপ্ন সে প্রাথমিকে বৃত্তি পাবে। তাদের স্কুল থেকে আজ পর্যন্ত কেউ বৃত্তি পায়নি। কিন্তু তাকে চোখে হাই পাওয়ারের চশমা পরতে হয়। চশমা ছাড়া সে সবকিছু ঝাপসা দেখে। অপর্যাপ্ত আলোতে লেখাপড়া করতে হয় বলে তার মাথাব্যথা করে। বেশি সময় পড়তে পারে না।

কিন্তু তুলতুলি খুবই সাহসী ও বুদ্ধিমতী মেয়ে। সে পরদিন আবার দলবল নিয়ে পুকুরপাড়ে গেল চড়ুইভাতি করবে বলে। মাঠে সে বিল্টু ও তার দলবলকে দেখতে পেল। সে বুঝতে পারলো আজও তারা ঝামেলা করতে এদিকে আসবে। বিল্টু ওদের চেয়ে বয়সে কিছুটা বড়। তারা স্কুলে যায় না, লেখাপড়া  করে না। বখাটেপনা আর বাঁদরামি করে দিন কাটায়। বিল্টুকে কাছাকাছি আসতে দেখেই তুলতুলি বিল্টুকে শুনিয়ে শুনিয়ে পাপ্পুকে বলতে লাগল, জানিস পাপ্পু কাল পুলিশ চাচ্চু বাড়ি এসেছিলেন। বাবার সঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলাপ করছিলেন। আমি তাদের আলাপের কিছুটা অংশ শুনেছিলাম।

চাচ্চু বলছিলেন কাল নাকি কি একটা কাজে তাদের পুকুরপাড়ে আসতে হয়েছিল। সেখান থেকে তাদের সার্চ ইঞ্জিনটা চুরি হয়ে যায়। সেটা নাকি অনেকটা ব্যাডমিন্টনের মতো দেখতে। আমার হঠাৎ বিল্টুর ব্যাডমিন্টনের কথা মনে পড়ল। আমি গিয়ে সেকথা পুলিশ চাচ্চুকে জানাতেই চাচ্চু বললেন তারা আজ রাতে বিল্টুর বাড়ি যাবে। একথা শুনে বিল্টু একটু ভরকে গেল। সে খানিকটা রাগী রাগী গলায় বলল, কি বললে তুলতুলি? আমার বাড়ি যাবে কেন? আমি কি ইঞ্জিন চুরি করেছি? এটা আমার ব্যাডমিন্টন। আমার বড় মামা বিদেশ থেকে পাঠিয়েছে।

তুলতুলি বললো আমি তো তাই বলেছি। চাচ্চু বললেন তারা তোমার ব্যাডমিন্টনটাই দেখতে যাবে। আমাকে চাচ্চু সার্চ ইঞ্জিনের ছবিও দেখিয়েছে। তোমার ব্যাডমিন্টনের সঙ্গে ছবিটার অনেক মিল। আমাকে বলেছে আমি যদি সেটা কোথাও খুঁজে পাই তাহলে যেন তাকে খবর দেই। খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস তো। যাক গে, চড়ুইভাতি শেষ করে পুকুরপাড়ে আরেকবার খুঁজে দেখবো ভাবছি। বিল্টু এই নাও আজও এখানে ডিম রেখেছি। দেখি তো তোমার ব্যাডমিন্টন আজও চুম্বকের মতো করে ডিমগুলোকে তুলে নিতে পারে কিনা।

বিল্টু তার হাতটা পিছনে লুকিয়ে ফেললো। হঠাৎ মনে পড়লো এমন ভঙ্গিতে তার দলবলকে বলল আজ আর সময় নেই বুঝলি। বাবার সঙ্গে এক জায়গায় যেতে হবে। বাবা তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে বলেছে। ওরা চলে যেতেই তুলতুলি আর তার বন্ধুরা চুলা বানাতে শুরু করলো। আজ নিজেরা রান্না করবে। খিচুড়ি আর ডিমভুনা। তুলতুলি জানে খসে পড়া ডানাটা সে পুকুরপাড়েই খুঁজে পাবে।

সার্চ ইঞ্জিন নামটা শুনে বিল্টু ভয় পেয়ে গেছে। সার্চ ইঞ্জিন হলো ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব বা অন্তর্জালের দুনিয়াতে যে কোন তথ্য বা ছবি খুঁজে বের করার প্রযুক্তি মাধ্যম, যেমন গুগল। বিল্টুতো লেখাপড়া করে না, তাই এই নাম সে জীবনে শুনেনি। ভেবেছে কি না কি! পুলিশের নাম শুনে আরো ভয় পেয়ে গেছে। ওতো জানেই না তুলতুলি এসব গল্প বানিয়ে বলেছে।

রান্না চাপিয়ে দিয়ে তুলতুলি একা একা পুকুরের চারদিকটা ঘুরে দেখল। সে যা ভেবেছিল তাই। এক কোনায় কাদা মাটির ওপর ডানাটা পড়ে আছে। তুলতুলি সযত্নে সেটা লুকিয়ে রেখে ফিরে এলো। রান্না শেষ করে সবাই মিলে একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করলো। সবাইকে বিদায় দিয়ে ডানাটা নিয়ে তুলতুলি ফিরে এলো স্পেসশিপটার কাছে এবং ঠিক একইভাবে ভেতরে চলে গেল।

ভিনগ্রহের বন্ধুগুলো তুলতুলির কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে রইলো। তারা জিজ্ঞেস করল তুলতুলি তাদের কাছে কি চায়? সেতো আসলে কিছু চায় না। সে শুধুই সাহায্য করতে চেয়েছে। তখন ভিনগ্রহবাসীদের একজন বলল, তুমি চোখের ওপরে মোটা গোল জিনিসটা কেন দিয়েছো? তুলতুলি বলল এটাকে চশমা বলে। আমার চোখে সমস্যা আছে। খালি চোখে আমি কিছু দেখতে পাই না। এটার সাহায্যে আমি দেখি।

তখন সেই বন্ধুটি তুলতুলির হাত ধরে টেনে একটি চেয়ারে বসালো। তুলতুলির চোখ থেকে চশমাটা খুলে মাথায় হেলমেটের মতো গোল একটা জিনিস পরিয়ে দিলো আর সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হলো মাথাটা বুঝি লাটিমের মতো ঘুরছে। সে ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। তারপর যখন মাথাটা একদম স্থির হলো সে আস্তে আস্তে চোখ খুলে দেখলো একটা বড় সবুজ মাঠের মধ্যে ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর। আশপাশে আর কিচ্ছু নেই। ঘরটা প্রথমে অস্পষ্ট ছিল। তারপর আস্তে আস্তে সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠলো। ঠিক তখনই তুলতুলির মাথা থেকে হেলমেটের মতো যন্ত্রটা খুলে নেওয়া হলো। সে দেখল চশমা ছাড়াই তার সামনের সব দৃশ্য স্পষ্ট। সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে তুলতুলি সেখান থেকে বেরিয়ে এলো।

পরদিন সকালে তুলতুলি বাড়ির পিছন দিকে ঘন ঝোপের মতো জায়গাটায় এলো। সেখানে ধানের গোলার মতো দেখতে স্পেসশিপটা নেই। কুয়াশায় পুকুরপাড়ের অনেকটা অংশই ঢেকে আছে। সে ধীরে ধীরে পুকুরপাড়ের দিকে গেল। ঘাসের উপর শিশিরকণা টলটল করছে চোখের কোনে জমা হওয়া জলের মতো। টোকা দিলেই মাটিতে ঝরে পড়ে। খালি চোখে তুলতুলি প্রথম শিশির দেখতে পেল। তাদের গ্রামটাকে লোকে অজপাড়াগাঁ বলে। তবুও গ্রামটা যেন ছবির মতই সুন্দর।

লেখক পরিচিতি: শিক্ষক, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!