আদিবাসী লোককথা: রাজকন্যার ধমকই বজ্রপাত

এক দেশে ছিল এক রাজা। তার ছিল এক ছেলে আর এক মেয়ে।

সালেক খোকনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 June 2020, 05:51 AM
Updated : 27 June 2020, 05:51 AM

ছোটবেলা থেকেই রাজার মেয়েটা ছিল অপরূপা সুন্দরী। তার রূপের আলোকচ্ছটায় অন্ধকার ঘরেও কোনো আলোর প্রয়োজন পড়তো না। রাজকন্যার রূপের আলোয় আলোকিত হতো চারপাশ।

দিন গড়িয়ে চলল। রাজার ছেলেমেয়েও বড় হতে থাকল। যৌবনে এসে রাজার মেয়ের রূপ যায় আরও বেড়ে। সে রূপ আছড়ে পড়ে চারপাশে। খুব কাছ থেকেই তা উপভোগ করে রাজার ছেলে। ভাই হয়েও মনে মনে সে ভালোবাসতে থাকে নিজের বোনকেই।

রাজা তার সন্তানদের সব সময় ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতেন। কখনো চোখের আড়াল করতেন না। ভোর থেকে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কাছে কাছে রাখতেন। খুব বেশি আদর করতেন তাদের।

কিছুদিন যেতেই ভাই হয়েই রাজপুত্র রাজকন্যার প্রেমে মত্ত হয়ে ওঠে। ভাইয়ের আচরণে তা টের পেয়ে যায় রাজকন্যা। কিন্তু কী করবে সে! মুখ ফুটে সে কথা কাউকে বলতেও পারে না। এ যে বড়ই লজ্জার ব্যাপার! রাজকন্যা খুব সাবধানে নিজেকে সামলে রাখে।

এদিকে যতই দিন গড়াতে থাকে ততই বোনের রূপে রাজপুত্র পাগল হয়ে ওঠে। রাজকন্যাও ধীরে ধীরে ভাইয়ের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকে। একদিন ঘটল এক কাণ্ড। খাওয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে অথচ খাওয়ার ঘরে রাজপুত্র নেই। রাজা চিন্তিত হয়ে পড়েন। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন ছেলে নাওয়া-খাওয়া ভুলে নিজ ঘরে খিল এঁটে বসে আছে। তিনি গিয়ে অনুরোধ করার পরও রাজপুত্র দরজা খুলল না।

রাজা এপাশ থেকে জানতে চাইলেন, হাতি, ঘোড়া, টাকশালের টাকা তুমি কী চাও? যা চাইবে তাই-ই পাবে। উত্তরে রাজপুত্র নিজের রূপসী বোনকে বিয়ে করার প্রস্তাব করে। ছেলের প্রস্তাবে রাজার মাথায় যেন বাজ পড়ে। আদরের ছেলের একি উন্মাদনা! সে সময় ছেলেকে শান্ত করতে কৌশলে রাজা সে প্রস্তাবে রাজি হন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ছেলের জন্য তিনি অন্য পাত্রী ঠিক করে ফেলেন। অন্যত্র বিয়ে হলে হয়তো রাজপুত্রের উন্মাদনা আর থাকবে না। তেমনটাই ভেবেছিলেন রাজা।

রাজবাড়িতে তখন রাজপুত্রের বিয়ের ধুমধাম চলছে। এর মধ্যেই রাজপুত্র জেনে ফেলে তার জন্য তার রূপসী বোন নয়, অন্য পাত্রী ঠিক করা হয়েছে। আজ তার সঙ্গেই তার বিয়ে হবে। তখন রাজপুত্র ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। বিয়ের পোশাক ফেলে সে রূপসী বোনের খোঁজ করতে থাকে।

বোন তখন পুকুরঘাটে স্নান করছিল। তার ভাই, রাজপুত্র সেখানে গিয়েই বোনকে বিয়ের কথা বলে। শুনেই বোনের হৃদয় কেঁপে ওঠে। নিজের আপন বড় ভাইকে সে কী বলবে! রাজার মেয়ে তখন অশ্রুসজল চোখে মহাদেবকে স্মরণ করে। তাঁর কৃপা লাভের প্রার্থনা করে।

ঠিক তখনই আকাশ থেকে মহাদেবের আশীর্বাদ স্নিগ্ধ আলো হয়ে নিচে নেমে আসে। সে আশীর্বাদের শক্তিতে রাজকন্যা পুকুরের জল থেকে আকাশের দিকে উঠতে থাকে। এভাবে একসময় সে আকাশের মাঝে অদৃশ্য হয়ে যায়।

হাজং আদিবাসীরা বিশ্বাস করে, এখনো আকাশ থেকে মাঝে মাঝে স্নানের দৃশ্য মনে হলে জলকণার স্মৃতিতে রাজার মেয়ে রংধনু হয়ে ফুটে ওঠে। রংধনু নিয়ে এটিই তাদের আদি বিশ্বাস। রংধনু তৈরির আধুনিক বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সঙ্গে যার অনেকটাই মিল পাওয়া যায়।

রাজার মেয়ে যখন আকাশে উঠছিল, তখন পিছু ডাকছিল তার রাজপুত্র ভাইটি। রাগ হয়ে নিজের ভাইকে আকাশ থেকে রাজকন্যা তখন ধমক দেয়। রাজকন্যার সে ধমক আজও বজ্রের সঙ্গে মিশে আছে। তাই হাজংদের কাছে বজ্রপাত হলো রাজকন্যার ধমক।

রাজকন্যা যখন আকাশে উঠছিল, তখন তার চোখেমুখে ফুটে ছিল লম্পট ভাইয়ের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দ। তার সে আনন্দ আর মুখের হাসি ফুটে উঠেছিল বিদ্যুতের ঝলকানিতে। হাজংদের বিশ্বাস সেটিই বিদ্যুৎ চমকানো আলো।

এছাড়া হাজংরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে পৃথিবীটা বিরাট এক ষাঁড়ের মাথায় অবস্থান করছে। ওই ষাড় যখন পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারে, তখনই ঝাঁকুনি দেয়। সে সময় পৃথিবীও কেঁপে ওঠে। আমরা যাকে বলি ভূমিকম্প। এ আদিবাসীরা মনে করে, প্রকৃতিই প্রকৃতিকে রক্ষা করে। আর প্রকৃতিকে যত ধ্বংস করা হবে, প্রকৃতিও ততই তার বদলা নেবে। তখন ভূমিকম্পও বেশি হবে।

এই লেখকের আরও লেখা

লেখক পরিচিতি:  লেখক ও গবেষক। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। তার লেখা ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ বইটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মৌলিক গবেষণাগ্রন্থ হিসেবে ‘তরুণ কবি ও লেখক কালি ও কলম’ পুরস্কার পায়। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। প্রকাশিত বই ২২টি। আদিবাসীবিষয়ক বই ১২টি। উল্লেখযোগ্য বই: বিদ্রোহ-সংগ্রামে আদিবাসী, আদিবাসী বিয়েকথা, চন্দন পাহাড়ে, আদিবাসী পুরাণ, আদিবাসী উৎসব, আদিবাসী জীবনগাথা, কালপ্রবাহে আদিবাসী, আদিবাসী মিথ ও অন্যান্য।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!