কারাতে শিখেছি সুস্থ থাকতে ও ভয় ভাঙাতে

আমার আম্মু চাকরি করে। তাই আমার যাতে সময় কাটে এবং খেলার বন্ধু পাই তাই বাসার সামনেই মিরপুর সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়ামে ‘বাংলাদেশ কারাতে ফেডারেশন’ (বিকেএফ)-এ ভর্তি করিয়ে দেন।

মায়মুনা ইসলাম মেধাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 June 2020, 08:15 AM
Updated : 24 June 2020, 08:15 AM

২০১৫ সালের ১৪ নভেম্বর, আমার বয়স তখন সাড়ে চার বছর। কারাতে শেখার জন্য আম্মু আমাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন। ঢাকা শহরে বা যেসব শিশুরা বাসায় একা থাকে তারা সহজেই ভীতু প্রকৃতির হয়। কিন্তু কারাতে মনোবল বাড়ায়। এটাও একটা কারণ ছিল আম্মুর আমাকে কারাতে শিখতে ভর্তি করানোর।

এবার কীভাবে কারাতে শিখতে ভর্তি হই সে গল্পটা বলি। আমাদের বাসার কাছে একটা মুদি দোকানে গিয়েছিলাম আমি আর আম্মু। সেখান দিয়ে একটা বাচ্চা কারাতে ড্রেস পরে যাচ্ছিল। বাচ্চাটার বয়স ৯/১০ হবে। আম্মু বাচ্চাটার আব্বুর কাছে জিজ্ঞাসা করল কোথায় শেখে এবং কত বয়স থেকে শেখানো হয় ইত্যাদি বিস্তারিত।

আমার আম্মু স্কুল-কলেজে হ্যান্ডবল খেলোয়াড় ছিলেন। কারাতে তার পছন্দ ছিল, কিন্তু তখনও মেয়েদের শেখানো শুরু হয়নি। তাই আম্মু আমার বেলায় এ সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি। সাধারণত ৬ বছর বয়স থেকে কারাতে শিখানো হয় নিয়মানুযায়ী। কিন্তু আমিই ক্ষুদে কারাতে খেলোয়াড় ছিলাম সেখানে। কারাতে ফেডারেশনের প্রধান শাখা হলো বঙ্গবন্ধু ন্যাশনাল স্টেডিয়াম।

কারাতে শুরু হয় হোয়াইট বেল্ট থেকে ব্ল্যাক বেল্ট পর্যন্ত। যথাক্রমে হোয়াইট, ইয়েলো, অরেঞ্জ, গ্রিন, ব্লু, ব্রাউন, তারপর ব্ল্যাক। ব্লু বেল্ট আবার দুরকম, ব্লু ওয়ান ও ব্লু টু বেল্ট। ব্রাউন বেল্টে করতে হয় তিন রকম, ব্রাউন ওয়ান, ব্রাউন টু ও ব্রাউন থ্রি বেল্ট। তারপর আসে ব্ল্যাক বেল্ট।

সিলেবাস অনুযায়ী ব্ল্যাক বেল্টে করতে হবে ব্ল্যাক ওয়ান থেকে সেভেন পর্যন্ত। ব্ল্যাক বেল্ট ওয়ানকে বলা হয় ফার্স্ট ডেন, এভাবে যথাক্রমে সেকেন্ড ডেন থেকে সেভেন ডেন পর্যন্ত। প্রতি তিনমাস পরপর একটি করে বেল্টের জন্য পরীক্ষা দিতে হয়। পাশ করলে পরবর্তী বেল্ট।

আমার কারাতে শেখার সেরা মুহূর্ত ছিল যখন আমার প্রশিক্ষণের দ্বিতীয় কোচ সেনসি আমাকে ব্ল্যাক বেল্ট পরিয়ে দিচ্ছিলেন। কারণ ব্ল্যাক বেল্ট এক চান্সে পাওয়া অনেক কঠিন। কিন্তু আমি একবার পরীক্ষা দিয়েই অনেক ভালো পয়েন্ট নিয়ে পাশ করি। আন্তর্জাতিক কারাতে রেফারি বা জাজ এবং বাংলাদেশ আনসারের জাতীয় কোচ প্রয়াত শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন কবীর জুয়েল সেনসি পরীক্ষা নিয়েছেন। তিনিসহ দুইজন বিচারকই আমার পরীক্ষার অনেক প্রশংসা করেন। আমি ছিলাম আমার ব্যাচের সর্বকনিষ্ঠ মেয়ে যে ব্ল্যাক বেল্ট পেয়েছিলো। পরীক্ষায় অনেক ভালো পয়েন্ট পেয়েছিলাম। পরীক্ষা হয়েছিল ২০১৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর।

কারাতে শেখার সবচেয়ে কঠিনতম সময় ছিলো ব্ল্যাক বেল্ট পাওয়ার প্রস্তুতি। পরীক্ষার আগের তিনমাস টানা চর্চা করেছি। একটা অংশ ছিল এক পায়ে দাঁড়িয়ে আরেক পা সোজা সামনে সমান্তরালভাবে প্রতি পদক্ষেপ ৩০ সেকেন্ড ধরে রাখতে হবে। এককথায় ব্যালেন্স ধরে রাখা। এটা খুবই কর্ঠিন পার্ট ছিল আমার জন্য। আমাদের সবার জন্য। আমার দুই পায়ের আঙুলের নিচে ফোসকা পরে যায়। ঠিক পরীক্ষার আগেরদিন দুই বুড়ো আঙুলের ফোসকা দুটো ফেটে যায়। খুব কষ্ট হয়েছে পরীক্ষা দিতে। তবে ব্ল্যাক বেল্ট প্রস্তুতিতে আমি হঠাৎ ৪ ইঞ্চি লম্বা হয়ে গেছি!

কারাতে শেখার উপকারিতা অনেক। কারাতে হচ্ছে মূলত খালি হাতে আত্মরক্ষার কৌশল। কারাতে হলো ৫০% হাতের কাজ ও ৫০% পায়ের কাজ। এটাতে আত্মরক্ষা করা শেখায় বেশি। আমার ধারণা আমার মনোবল অনেক বেড়েছে এবং অন্যদের চেয়ে বেশি। সাহস বেড়েছে, আমাকে কেউ আক্রমণ করলে আমি সহজেই আত্মরক্ষা করতে পারি। প্রয়োজনে আক্রমণও করতে পারবো, যদিও এখনও তা করার প্রয়োজন পড়েনি।

আম্মু আমাকে কখনও মারতে এলে আমার অটোমেটিক ডিফেন্স চলে আসে। কিন্তু আমি সহজে অ্যাটাক করি না। আমার ফিটনেস বলব অনেক ভালো। আমি আল্লাহর রহমতে অসুস্থ খুব কম হই। কারাতে নিয়মিত চর্চার কারণে প্রচুর পরিশ্রম করতে পারি। ভালো খেতে পারি। শরীর মন ভালো থাকে। অনেক বন্ধু হয়েছে। এখন আমি ন্যাশনাল গেমস বা বাংলাদেশ গেমস খেলতে পারব, এবং সামনে অংশ নেব ইনশাল্লাহ।

তবে কারাতে শিখতে কী কী প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছি তাও জানানো দরকার। মেয়েদের কারাতে শিখতে গিয়ে সামাজিক কটুক্তির শিকার হওয়া এটা নতুন কিছু নয়। আমার বেলায়ও তাই হয়েছে বা হয়। আমার অতি নিকটাত্মীয় স্বজনরাও সরাসরি আমার আম্মুকে বলেছেন, মেয়েকে কারাতে শেখাচ্ছ, মেয়ের কিন্তু বিয়ে দেওয়া কঠিন হবে! কেউ বলেছে, টাকা দিয়ে মেয়েকে মারামারি শেখাচ্ছে! ঢং! কিন্তু আমার আব্বু-আম্মু মানুষের কথায় কান দেননি। তারা আমাকে শিখতে পাঠিয়েছেন কীভাবে খালি হাতে আত্মরক্ষা করা যায়, সাহস বাড়ে, শরীর মন ভালো থাকে।

সবার উদ্দেশ্যে বলব, ছেলে-মেয়ে সবারই কারাতে শেখা উচিত। কারাতে আত্মরক্ষা, শরীর ভালো রাখা, মন মেজাজ ভালো রাখা, সামাজিকতা রক্ষায় সহায়ক। প্রতিবন্ধীদের জন্য এটা একটা চিকিৎসা। আমাদের সঙ্গে প্রতিবন্ধী বন্ধুরাও আছে। মা-মেয়ে একসাথে শিখছে। মায়েদের পেশি রক্ত চলাচল সচল রাখতে শেখেন। এক একজনের শেখার কৌশল একেক রকম। কেউ বেশি পাওয়ার দেয়, কেউ কম।

অনেক দুষ্টু বাচ্চারা উল্টাপাল্টা মারামারি করে। তাদের কারাতে শেখানো উচিত। কারণ তখন তারা উল্টাপাল্টা মারামারি করবে না। নিয়ম মানবে। বরং আমি বলব মন শান্ত হবে। মারামারি সহজে করবে না। তবে মানুষের মানসিকতা দিনদিন পাল্টাচ্ছে। আমি ব্ল্যাক বেল্ট পাওয়ায় অনেকেই আগ্রহী হয়ে আম্মুকে ফোন করে বিস্তারিত জেনে নেন। কোথায়, কীভাবে শিখলাম। আম্মু অনেককেই কারাতে ভর্তি হতে পাঠিয়েছেন।

আমার কারাতে শেখার পেছনে অনেকের অবদান রয়েছে। বাবা-মায়ের পাশাপাশি যাদের অবদানের কথা না বললেই নয় তারা হলেন সাবেক জাতীয় কারাতে কোচ এহসানুর রহমান সেনসি, মশিউর রহমান সেনসি ও শাহরিয়ার শাহীন চৌধুরী সেনসি। সর্বোপরি কারাতে ফেডারেশন মিরপুর শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক সমীর চাচার উৎসাহ রয়েছে আমার আজ ব্ল্যাক বেল্ট পাওয়ার পেছনে।

ব্ল্যাক বেল্ট পাওয়ার পর আমাকে একটা স্কুলে অস্থায়ী সহকারী কারাতে কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। স্কুলের নাম ‘আদিবাসী গ্রিনহার্ট স্কুল, মিরপুর’। বেশিদিন ক্লাস নিতে পারিনি। মুজিববর্ষের নাচ প্র্যাকটিস করেছি, তারপরই সুন্দরবন চলে গেছি। এখন করোনাভাইরাস সংক্রমণ শঙ্কায় বাসায় বন্দি। দেশের অবস্থা স্বাভাবিক হলে আবার কারাতে চর্চা শুরু করব ইনশাল্লাহ।

লেখক পরিচিতি: বয়স ৯, চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী, মনিপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। পড়াশোনার পাশাপাশি অভিনয় ও নাচ শিখেন।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!