করোনাকালের ডায়েরি: স্কুল বলতে পৃথিবীটাকেই বুঝি

২৬ মার্চ সকালবেলা। আগের দিন রাতে দেশে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের সব বড় বড় হাসপাতালগুলোকে তৈরি করা হচ্ছে করোনাভাইরাসের চিকিৎসা দেয়ার উপযোগী করতে।

রাদমান সিদ্দিকীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 June 2020, 06:44 AM
Updated : 13 June 2020, 02:54 PM

এবছর শবে বরাত ও নববর্ষ প্রতি বছরের থেকে অনেকটাই আলাদাভাবে প্রায় যেন চুপিসারে চলে গেল। রমজান মাসটাও অচেনা লাগছে। এসব নিয়ে আমি খুবই চিন্তিত। ভাবছি দেশের মানুষের কথা।

আমরা পরিবারের সবাই এক সপ্তাহ বাইরে যাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছি। আমাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি অনলাইনে অর্ডার করছি, বাইরে থেকে আসা সবকিছুরই প্যাকেট পুড়িয়ে দিচ্ছি যাতে করে প্যাকেটে কোন জীবাণু থাকলে তা যেন মারা যায়।

আমার পরিবাবের সবাই কাজ ভাগ করে করতে শুরু করল। আমি বাসায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বাড়িটা ভালোমতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য কাজ করছি, জীবাণুনাশক ছড়াচ্ছি। বাসার সব দরজার হাতলগুলো পরিষ্কার করছি। নিয়মিত হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে নিচ্ছি।

পরিবারের সবাই মিলে নিয়মিত বাসা পরিষ্কার করছে। আমি যে শুধু এই কাজগুলো করছি তা নয়, পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছি এবং সহপাঠমূলক কাজ করছি। চেষ্টা করছি বিভিন্ন গল্পের ও শিক্ষামূলক বই পড়ার। টিভিতে ক্লাস অনেক আগেই শুরু হয়েছে, এখন স্কুল থেকে অনলাইনে পড়া দেওয়া শুরু হয়েছে। সেসব পড়া পড়ে আমি স্যারদের দেয়া বাড়ির কাজ করছি। স্কুল ছুটির এ দিনগুলোতে বিভিন্ন যে জিনিস নিয়ে আমার আগ্রহ আছে তার সম্বন্ধে পড়ছি। দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকা পড়ছি। চেষ্টা করছি জ্ঞান বাড়ানোর, জীবনটাকে যতটুকু সম্ভব উপভোগ করার।

সহপাঠ্যক্রমিক কার্যক্রম ও শিক্ষামূলক বই থেকে শেখা নতুন নতুন জিনিসগুলো লেখার জন্য আমার একটি খাতা আছে। আমি মাঝে মাঝে সেখানে অন্যান্য বই বা অন্য জিনিস থেকে শেখা তথ্য এখানে লিখি। এই কোয়ারেন্টাইনের সময় খাতায় প্রচুর জিনিস লিখেছি। নতুন লেখা জিনিসের পরিমাণ অন্য সময় লেখা সবকিছু থেকে অর্ধেকেরও বেশি। বাসায় বসে শরীরটা ভালো রাখা দরকার। সেজন্য ঘরে বসেই হালকা যোগব্যায়াম করছি।  এ দিনগুলো সহনীয় করার জন্য পরিবারের সবার সঙ্গে রাতে একসঙ্গে বসে গল্প করি, নাটক সিনেমা দেখি।

প্রতি বছর মার্চ মাস থেকেই প্রচণ্ড গরম পড়া শুরু হয়, তবে এবছর কিছুটা যেন ব্যতিক্রম। এখন এপ্রিল গড়িয়ে মে, জুন এসেছে, তবু যেন গ্রীষ্মের সেই খরতাপ পুরোপুরি নেই। প্রতি বছর মানুষ এই গরমে অতিষ্ঠ হয়ে যায়; চায় গরম চলে যাক। কিন্তু তা আর কখনো হয় না; বরং গত কয়েক বছর ধরে গরম না কমে বেড়ে গিয়েছে। অথচ এবছর যখন কিছু গবেষকরা বলছেন উষ্ণ পরিবেশে করোনাভাইরাস সহজে বিস্তার লাভ করতে পারে না, এই ভাইরাসে গ্রীষ্মকালীন দেশগুলোর ক্ষতি কম হতে পারে তখন আমরা অনেকে কতই না আশার আলো দেখলাম। কিন্তু তখন কে আর জানতো এবছর গরম পড়তেও দেরি হবে, আর এই ভাইরাসের সঙ্গে তাপমাত্রার সম্পর্কটিও অজানা।

এখন পৃথিবীটা অনিশ্চয়তায় পূর্ণ। কারো জীবনের কোন নিশ্চয়তা নেই। আজ যে সুস্থ কালই সে অসুস্থ হতে পারে। আজ যে চিকিৎসাধীন, কালই তার মৃত্যু হতে পারে। আমার মতো কোটি কোটি মানুষের জীবন আজ বিপন্ন। সবাই নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। সবার মতো আমি এবং আমার পরিবারের অন্যরাও চিন্তিত। আমরাও চাচ্ছি যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাক, সবকিছু আবার আগের মতো হয়ে যাক। তবে তা কবে হবে, কখন হবে তা কেউ জানে না।

তবে আমি যে শুধু অসুস্থতা নিয়েই চিন্তিত তা নয়, ভাবছি এই ভাইরাসের কারণে যদি কোন দুর্ভিক্ষ হয়, তবে দেশের মানুষ‌ কীভাবে বেঁচে থাকবে। এই দুর্যোগের সময় মানুষের পাশে কীভাবে দাঁড়ানো যায় সেটা নিয়ে চিন্তা করছি। এই সময় কত মানুষের চাকরি চলে যাচ্ছে, কত মানুষ অসহায় হয়ে পড়ছে। সেই মানুষদের জন্য সামান্য কিছু করতে পারলেও কিছুটা সান্ত্বনা পাব। আমি একটি মাটির ব্যাংকে সামান্য কিছু টাকা জমিয়েছি। আমি ঠিক করেছি সেখানে জমানো সব টাকা আমি দান করবো।

এখন দেশে দেশে মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়েছে। সেই মিছিল আর থামছে না, থামার কোন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। তবে এত কিছুর পরেও একটি সত্য আমাদেরকে সাহস যোগাচ্ছে। এটাই এখন আমাদের একমাত্র আশার বাণী যে করোনাভাইরাস মানেই মৃত্যু নয়, আক্রান্ত মানুষের বেশিরভাগই সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরছেন। আমরা সবাই চিন্তিত এখন। কবে সব ঠিক হবে তা নিয়ে চিন্তা করছি। পুরো পৃথিবীটা এখন যেন কেমন অচেনা হয়ে গিয়েছে। বাসায় থেকে আমার স্কুলের কথা মনে পড়ছে। স্কুলের খেলার মাঠ, বন্ধু, স্যারদের কথা মনে পড়ছে। আমার আবার স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছে।

পরিস্থিতি ভালো হলে কী করব তা নিয়ে চিন্তা করছি। আর ভাবছি ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান সাবেক ফাস্ট বোলার ও ধারাভাষ্যকার মাইকেল হোল্ডিং যেমন বলেছেন, ‘আজকের এই সামাজিক দূরত্ব থেকেও অনেক বেশি দুঃসহ জীবন ২৭ বছর কাটিয়েছেন নেলসন ম্যান্ডেলা।’ বঙ্গবন্ধু তার জীবনের অনেক সোনালি সময় কারাগারে কাটিয়েছেন এ দেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রামে। এই মহান নেতাদের তুলনায় আমাদের বর্তমান কষ্ট কিছুই নয় এবং আশা করা যায় মেঘের আড়ালের সূর্য অচিরেই হেসে উঠবে। আর আশা নিয়েই তো আমাদের জীবন।

লেখক পরিচিতি: শিক্ষার্থী, ষষ্ঠ শ্রেণি, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি,সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!