নজরুলের ছোটদের কবিতার ভুবন

কাজী নজরুল ইসলাম সৃষ্টিশীল থাকতে পেরেছিলেন মাত্র বাইশ বছর। কিন্তু এই অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বাংলা সাহিত্যকে যে প্রাচুর্য এবং সমৃদ্ধি দিয়েছেন তা আমাদের অবাক করে।

আহমাদ মাযহারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 June 2020, 03:43 AM
Updated : 3 June 2020, 03:52 AM

চেতনা হারিয়ে ফেলার আগে তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা কম নয়, প্রায় চল্লিশটি। সংখ্যায় বই বেশি না থাকলেও ছোটদের উপযোগী কবিতার পরিমাণ কিন্তু সব মিলিয়ে উল্লেখ করার মতো।

লেখার আলাদা ধরনে, শিশুর জগৎ সৃষ্টির ক্ষমতায় তাঁর ছোটদের কবিতাগুলো কত না উজ্জ্বল! সবার জানা আছে যে, তাঁর সমস্ত সৃষ্টির মধ্যেই আছে এক ধরনের প্রাণোচ্ছলতার দীপ্তি। ছোটদের জন্য লেখা তাঁর সৃষ্টিকর্মও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রাণের উচ্ছ্বাস ছোটদের মনোজগতের এক প্রধান ও মৌলিক অনুষঙ্গ বলেই নজরুলের সৃষ্টি ছোটদের কাছে প্রিয় হতে পেরেছে।

পাঠ্যপুস্তক কিংবা অন্যান্য মাধ্যমে নজরুলের গুটিকয় ছোটদের কবিতা সাধারণ পাঠকের কাছে জনপ্রিয় অনেক বছর ধরেই। কিন্তু তাঁর এমন অনেক কবিতা রয়েছে যা কোনো অংশেই তাঁর অধিক প্রচারিত লেখাগুলোর চেয়ে উৎকর্ষের দিক থেকে কম নয়। অনেক দিন সেসব কবিতা ছোটদের সামনে হাজির করা যায়নি।

কাজী নজরুল ইসলামের ব্যক্তি জীবন ছিল এলোমেলো। নানা পরিস্থিতিতে দেখে কেউ তাঁকে নিন্দা করেছেন, কেউ ব্যবহার করতে চেয়েছেন পণ্য হিসেবে; অনেক ক্ষেত্রেই যথাযোগ্য মর্যাদা পায়নি তাঁর সৃষ্টিকর্ম। পরিণামে আমরা দেখি তাঁর অনেক বিখ্যাত রচনার মূল পাঠ, এমনকি তাঁর অনেক উৎকৃষ্ট রচনাও অনেক দিন সাধারণ পাঠকের চোখের আড়ালে থেকে গেছে।

বিষয়বস্তুর গভীরতা এবং সৃষ্টিশীলতায় বৈচিত্র্য না থাকলে একজন লেখক কিংবা শিল্পী বেশিদিন জনপ্রিয় থাকতে পারেন না। নজরুল ইসলামের জনপ্রিয়তাকে তাই খাটো করে দেখা যায় না; তাঁর সৃষ্টিতে এমন কিছু নিশ্চয়ই রয়েছে যা আজও পাঠকের হৃদয়ে সাড়া জাগাতে পারছে।

নজরুল ইসলামের ছোটদের উপযোগী লেখাগুলোও বড়দের লেখার মতোই বিচিত্র; এতেও রয়েছে বিশিষ্ট ও অনিন্দ্য জগৎ। তিনি কেবল সুন্দরের স্তবগান করেন; জানেন সুন্দরকে স্বীকার করতে হয় সুন্দর দিয়েই। তাঁর ছোটদের লেখায় স্পষ্টভাবে রয়েছে দেশপ্রেম, ধর্মচেতনা, শ্রেয়োচেতনা এবং ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমানের একাত্ম হওয়ার স্বপ্ন।

এছাড়া তাঁর সৃষ্টিতে রয়েছে কল্পনার, স্বপ্নের এবং উজ্জীবনের উদ্ভাস; আর রয়েছে লোকঐতিহ্য-চেতনা এবং নির্মল হাস্যরসের বিচিত্র ভুবন। তিনি শুধু এই দেশের আর এই সমাজের কবি নন, সকল দেশের সকল মানুষের। তাঁর কবি-অন্তরটি বেশি করে ব্যথিত হয় ‘পায়ে-পেষা ফুলে’র জন্য, অর্থাৎ মানুষের মধ্যে যারা নিপীড়িত তাদের জন্যে তাঁর বেশি মায়া!

নজরুল ইসলামের লেখা পড়লে বোঝা যায় দেশপ্রেম রয়েছে তাঁর হৃদয়জুড়ে। শুধু সৃষ্টির জগতেই নয়, তাঁর ব্যক্তিজীবনেও দেখতে পাই দেশপ্রেমের প্রজ্বলিত শিখা। ছোটদের জন্য লিখতে গিয়েও নজরুল থেকেছেন সেই চেতনাবিন্দুতেই। হৃদয়ের গভীর তলভূমে অবিরাম বেজে চলেছে যে বীণার সুর একজন সত্যিকারের কবি তার থেকে দূরে যাবেন কী করে! নজরুলও পারেননি। তিনি বলেন,

নমঃ নমঃ নমো বাঙলা দেশ মম

চির-মনোরম চির-মধুর।

বুকে নিরবধি বহে শত নদী

চরণে জলধির বাজে নূপুর॥

ধর্মচেতনা নজরুলের প্রধান বেশকিছু কবিতার মূল অনুষঙ্গ। এর ব্যতিক্রম নেই ছোটদের কবিতায়ও। এমন কবিতা সৃষ্টির জন্য কবির হৃদয়কে হতে হয় পবিত্র; শুভ্র রাখতে হয় তার অন্তর; নিজেকে করে তুলতে হয় বিনীত মহত্ত্বের আলোময়তায় হিল্লোলিত। এই যে শ্রেয়োবোধ তা প্রধানত ধর্মচেতনা থেকেই এসেছে নজরুলের কবিতায়।

নজরুল মনে করেছিলেন শিশুকাল থেকেই মানুষের মধ্যে শ্রেয়োবোধ জাগিয়ে দেয়া উচিত। তাঁর ধর্মীয় চেতনাসমৃদ্ধ ছোটদের কবিতা ছাড়া অন্য ধরনের কবিতায়ও রয়েছে এই শ্রেয়োবোধ। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, অসাম্য দূর করতেই যেন বাংলার বুকে জন্মেছিলেন নজরুল! কবিতায়, গানে, কর্মজীবনে অভেদ-সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠা করতেই যেন বাংলার বুকে জন্মেছিলেন নজরুল! ‘মাঙ্গলিক’, ‘মুকুলের উদ্বোধন’, ‘গরিবের ব্যথা’ প্রভৃতি কবিতার কথা এ প্রসঙ্গে আমরা মনে করতে পারি। ‘নির্ঝর’ কবিতা-সংকলনের ‘গরিবের ব্যথা’ কবিতায় তিনি লিখেছিলেন-

এই যে মায়ের অনাদরক্লিষ্ট শিশুগুলি

পরনে নেই ছেঁড়া কানি, সারা গায়ে ধুলি

এদের ফেলে ওগো ধনী, ওগো দেশের রাজা

কেমন করে রোচে মুখে মণ্ডা-মিঠাই-খাজা?

ভারতবর্ষ জুড়ে হিন্দু ও মুসলিম এই দুটি সম্প্রদায়ের বাস। বিভিন্ন সময় নানা কারণে সম্প্রদায় দুটির মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে শত্রু শত্রু ভাব। কিন্তু নজরুল সবসময় এই দুই সম্প্রদায়ের একতার স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর একান্ত স্বপ্নের জগত এটি। দুটি সম্প্রদায়কে তিনি দেখেছেন, ‘একই বৃন্তে দুটি কুসুম’ বা ‘দুই নয়ন তারা’ রূপে।

এই বোধ তিনি ছোটদের মধ্যেও জাগিয়ে দিতে চেয়েছেন। স্বভাবতই কল্পনাপ্রবণ শিশুরা ভালোবাসে স্বপ্ন দেখতে, তাদের চোখে থাকে অদেখাকে দেখার, অজানাকে জানার অসীম আকাঙ্ক্ষা। নজরুলের ছোটদের কবিতায় এমন অনেক আকাঙ্ক্ষা জাগানিয়া বিষয়বস্তু প্রাণ পেয়েছে। এই সূত্রে বিখ্যাত কবিতা ‘সংকল্প’-র কথাই মনে পড়ে আমাদের। এ কবিতার কয়েকটি লাইন এমন-

রইব না কো বদ্ধ খাঁচায়, দেখব এ-সব ভুবন ঘুরে

আকাশ বাতাস চন্দ্র-তারায় সাগর-জলে পাহাড়-চূড়ে।

আমার সীমার বাঁধন টুটে

দশ দিকেতে পড়ব লুটে

পাতাল ফেড়ে নামব নীচে, ওঠব আবার আকাশ ফুঁড়ে

বিশ্ব-জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।

সাহিত্যে শিশুরা নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখতে ভালোবাসে। নিজেদের মৌলিক প্রবণতাগুলো অন্য আরেকটি শিশুর মধ্যে দেখলে তার সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করে নিজেও। তার আনন্দের খোরাক হয় সেটা। শিশু মনোজগতের এ-ধরনের বিষয় নিয়ে নজরুল কবিতা লিখেছেন সবচেয়ে বেশি। আর এই ধরনের কবিতারই সমাদর করেছেন গুণীজনেরাও।

কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬), শিল্পী: অধ্যাপক শাহজাহান আহমেদ বিকাশ

বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এ-ধারার রচনাকে আমরা কেবল সুকুমার রায়ের লেখার সঙ্গে তুলনা করতে পারি, যদিও নজরুলের প্রকাশ-ভঙ্গির চেয়ে সুকুমার রায়ের প্রকাশ-ভঙ্গি আলাদা। এই ধারার অতি পরিচিত কয়েকটি রচনার নাম এ প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়ে। যেমন: ‘খুকি ও কাঠবেরালি’, ‘লিচু-চোর’, ‘মটকু মাইতি বাঁটকুল রায়’ প্রভৃতি কবিতা। এ রকম আরও বেশকিছু কবিতার কথা বলা যায়; যেমন: ‘খোকার খুশি’, ‘নবার নামতা পড়া’, ‘আমি যদি বাবা হতাম’, ‘তালগাছ’ ইত্যাদি। ‘আমি যদি বাবা হতাম’ কবিতাটি এমন-

আমি যদি বাবা হতুম, বাবা হত খোকা,

না হলে তার নামতা,

মারতাম মাথায় টোকা।

রোজ যদি হত রবিবার !

কি মজাটাই হত যে আমার!

কেবল ছুটি! থাকত নাক নামতা লেখা জোকা!

থাকত না কো যুক্ত অক্ষর, অংকে ধরত পোকা।

কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের মানুষের জীবন যাপনের শিল্প-ঐতিহ্য অত্যন্ত ধনী। আমাদের গর্বের বিষয় আমাদের সংস্কৃতি। সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের বিচিত্র উপকরণ থেকে সৃষ্টি হওয়া শিল্পে থাকে না কোনো বানিয়ে তোলা ব্যাপার। মানুষের মনে থাকে এসবের গভীর প্রভাব। এর স্রষ্টা জানেনও না কী অপরূপ ভুবন তিনি সৃষ্টি করে গেলেন। আধুনিক লেখকেরা অনুপ্রাণিত হন এসব অনুষঙ্গ থেকে। নজরুলও গ্রামীণঐতিহ্যের সঙ্গে নিজের আধুনিক কল্পনা মিশিয়ে সৃষ্টি করেছেন অসাধারণ ব্যঞ্জনাময় আবেদন। গ্রামীণ ঐতিহ্যের আধুনিক উপস্থাপনার অন্যতম পথিকৃৎ নজরুল। যেমন তিনি লিখেছেন-

ঘঘং ঘঘং ঘ্যাং

আমি পদ্মদীঘির ব্যাঙ

আনন্দে আজ নাচ জুড়েছি

ড্যাং ডাডা ড্যাং ড্যাং॥

কিংবা,

ঘুম পাড়ানী মাসিপিসি ঘুম দিয়ে যেয়ো

বাটা ভরা পান দেব গাল ভরে খেয়ো

ঘুম আয় রে ঘুম আয় রে ঘুম।

হাস্যরস সৃষ্টি নজরুলের সহজাত ক্ষমতাগুলোর একটি। হাসির মজা ছোটদের কাছে খুব আদরের ব্যাপার। শিশুর অনাবিল হাসির সমুদ্রকে চঞ্চল উচ্ছ্বাসে পরিণত করার হাতিয়ার নজরুলের কাছে ছিল। 'ঠ্যাং চ্যাগাইয়া প্যাঁচা যায়', 'নতুন খাবার' প্রভৃতি কবিতা দিয়ে ছোটদের তিনি হাসিয়ে তুলেছেন।

মনে রাখতে হবে কাজী নজরুল ইসলাম যখন এই রকম কবিতা লিখছেন তখনো বাংলা ভাষায় ছোটদের কবিতা খুব বেশি লেখা হয়নি; এতটা বিচিত্র ও কল্পনারঙিন হয়ে ওঠেনি বাংলা ভাষার ছোটদের কবিতা! বাংলা ছোটদের কবিতার জগতে তাই নজরুলকে অন্যতম পথপ্রদর্শক মনে করা হয়!

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি,সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!