ফ্লেমিংগোর পিছিয়ে পড়া বাচ্চা

খুব বিরক্তমুখে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাবধানী হাতে দাঁতব্রাশ করছে দ্বীপ। নিচের পাটির একদম সামনের দিকের দাঁতটাও নড়া শুরু হয়েছে কেবল।

মারিয়া সালামমারিয়া সালাম
Published : 30 May 2020, 03:31 AM
Updated : 30 May 2020, 03:39 AM

ওপর পাটির মাড়িতে আজও বেশ ব্যথা। এদিক সেদিক হলেই ব্রাশের খোঁচায় ব্যথা পাচ্ছে দ্বীপ। দ্বীপের বয়স ছয় শেষ হয়ে সাতে পড়বে পড়বে করছে। এরই মধ্যে দাঁত পড়া শুরু হয়েছে ওর।

কয়েকদিন আগেই ওপরের পাটির সামনের দিকে পোকা খাওয়া দুটো দাঁত ফেলে এসেছে মায়ের সঙ্গে গিয়ে। সেই থেকে মুখ খুলে হাসি দিতে বেশ লজ্জা পাচ্ছে ছেলেটা। সেটা সমস্যা না, সমস্যা অন্য জায়গায়।

গতকাল দ্বীপের স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ছিল। ওর ইভেন্ট ছিল বিস্কুট দৌড়। দ্বীপের সামনে সুতোতে বাঁধা বিস্কুটগুলো ঝুলছে। তীব্র রোদ মাঠে, ও চোখ বন্ধ করে দৌড়ে গিয়ে ঠোঁট দিয়ে একটা বিস্কুট ধরে ফেলেছে ঠিকই, কিন্তু সুতো ছেঁড়ার সময় আর পেরে উঠছে না।

বাঁশি বেজেছে বেশ ক'বার, দ্বীপের সেদিকে খেয়াল নেই, ও যে কোনভাবে বিস্কুট না নিয়ে ফিরবে না। ওর বন্ধ চোখে কেটে যায় অনন্তকাল। ও চোখ খুলে দেখে রেস শেষ, সবাই ফিরে গেছে, কেউ বিস্কুট নিয়ে, কেউ না নিয়ে। কিন্তু দ্বীপ ঠিক করে ও বিস্কুট না নিয়ে ফিরবে না।

মা ওকে একবার একটা ফ্লেমিংগোর বাচ্চার ভিডিও দেখিয়েছিল। বড় পাখিগুলো তাদের বাচ্চাদের নিয়ে সারি বেঁধে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছিল। সব বাচ্চারা বড়দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হেঁটে চললেও একটা ছোট্ট বাচ্চা পিছিয়ে পড়েছিল।

সমুদ্রের লবণ শক্ত হয়ে জমে ওর পা দুটোকে অসাড় করে রেখেছিল। ও বারবার হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু থেমে যাচ্ছিল না। হেঁটেই চলছিল। মা বলেছিল, এই পাখির বাচ্চার কাছে শিখতে হবে, পড়ে গেলেও থেমে থাকা যাবে না।

দ্বীপ আবার চোখ বন্ধ করে চেষ্টা চালিয়ে যায়, আবার যেন কেটে যায় অনন্তকাল। ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে ওর দু'দিকে দাঁড়ানো শিক্ষকদের দেখে দ্বীপ। মনে হয় এই বুঝি দিবে ধমক। কিন্তু তারা অসীম ধৈর্য নিয়ে এই কড়া রৌদ্রে দাঁড়িয়ে থাকেন, চোখে পরম আশ্বাস নিয়ে।

চোখ বন্ধ করে ও আবার চেষ্টা চালিয়ে যায়, মাড়িতে তীক্ষ্ণ ব্যথা টের পায় ছেলেটা, জিবে পায় রক্তের নোনতা স্বাদ। দাঁত ক্ষয়ে গেছে বলে সুতোটা মাড়িতে আটকেই টান দেয়। সেটা ছিঁড়ে আসে বিস্কুটসহ, তবে মাড়িতে বড় ক্ষত হয়ে যায়।

দ্বীপের তাতে হুশ নেই, কোন ব্যথাও নেই। ও বিস্কুট নিয়ে এক দৌড়ে মায়ের কাছে এসে দাঁড়ায়। দ্বীপ আরও একবার আয়নায় নিজের দাঁতগুলো দেখে, মনটা বেশ খারাপ করে বাথরুম থেকে বের হয়। দাঁতের ব্যথার কথা আজ মাকে কিছুতেই বলা যাবে না।

আজ মা ওকে তাস্কিম স্কোয়ারে বেড়াতে নিয়ে যাবে। আজ ওর জন্মদিন। সন্ধ্যার পরে তাস্কিম স্কোয়ারে সিরিয়ান শিশুরা এটা-সেটা ফেরি করতে আসে। মা বলেছে, এবছর ওদের খাবার দিয়ে জন্মদিন পালন করতে হবে।

ওরা যখন তাস্কিম স্কোয়ারে পৌঁছায়, তখন সন্ধ্যা প্রায়। বছরের এই সময়টা সন্ধ্যার পর একটু বেশি শীত শীত লাগে। দ্বীপ মায়ের শরীরের সঙ্গে লেপ্টে হাঁটতে থাকে। চারদিকে ফুলের গাছের সারি আর মাঝে মাঝে বসার জায়গা। কত রকমের লোক সেখানে বসা!

জায়গায় জায়গায় চাদর বিছিয়ে সিরিয়ান শিশুরা তসবি, আতর আর ফুলের মুকুট বিক্রি করছে। বয়স আর কত ওদের, বড়জোর সাত-আট বা দশ। দ্বীপ মায়ের হাতের ব্যাগ থেকে খাবারের প্যাকেটগুলো বের করে শিশুদের হাতে হাতে দিতে থাকে।

ফেরার পথে ও একটা লাল-সবুজে মিলিয়ে ফুলেল মুকুট কিনে ফেলে এক সিরিয়ান শিশুর কাছ থেকে। ঠিক এর পরপরই ওখানে পুলিশের ভ্যান এসে হাজির হয়। কয়েকজন পুলিশ নেমে তাড়া করতে থাকে ফেরিওয়ালা শিশুদের।

সবাই ছুটে পালালেও ধরা পড়ে মুকুট বিক্রেতা ছেলেটি। শিশুটিকে পুলিশ এসে ভ্যানে তুলে নেয়। দ্বীপ মায়ের হাত ছেড়ে পাগলের মতো ভ্যানের পিছে দৌড়াতে থাকে। দৌড়াতে দৌড়াতে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় শক্ত কনক্রিটের উপরে, নড়বড়ে দাঁতটা খুলে সেখান থেকে রক্ত গড়াতে থাকে। দ্বীপের সেদিকে খেয়াল নাই, ও হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। মুখে রক্ত দেখে এক পুলিশ দৌড়ে এসে দ্বীপকে রাস্তা থেকে টেনে তুলে। বলে, ‘ডোন্ট ক্রাই, হি উইল বি ওকে’।

বাড়ি ফেরার পথে পুরো রাস্তা দ্বীপ কান্না থামাতে পারে না। মায়ের বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে দ্বীপ। মা ওর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয়, কানের কাছে মুখ এনে বলে, ফ্লেমিংগোর পিছিয়ে পড়া বাচ্চাটাও শেষ পর্যন্ত একা চলা শিখে গিয়েছিল দ্বীপ।

এই লেখকের আরও লেখা

লেখক পরিচিতি: ইংরেজি সাহিত্যে পড়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পেশা সাংবাদিকতা, বর্তমানে ‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকায় কাজ করেন। সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা থেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন অনলাইন সাহিত্য সাময়িকী ‘ছাড়পত্র’। প্রকাশিত ছোটগল্পের দুটি বই ‘নীলকণ্ঠী’ ও ‘সময়ের কাছে’।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি,সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!