আনন্দমুখ ঈদের বেদনামাখা স্মৃতি 

ঈদ মানেই আমার কাছে ছেলেবেলার স্মৃতি। আমার ঈদের দিন মানেই ছিল অকারণে ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে গোসল করা আর নতুন জামা গায়ে দিয়ে জানালার পাশে বসে রাস্তা দেখা।

মারিয়া সালামমারিয়া সালাম
Published : 25 May 2020, 07:35 PM
Updated : 25 May 2020, 08:04 PM

আমাদের মহল্লার রাস্তায় সেদিন পোলার আইসক্রিমওয়ালাদের দেখা মিলিত। ওই একদিন আট আনা দামের নারকেলি বরফ বা শক্ত কোন আইসক্রিম না হয় আমরা পোলারের চকোবার পেতাম।

বেলুনওয়ালারা রং-বেরং এর বেলুন সাজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। ছেলে-মেয়েরা ভিড় করে তাদের কাছ থেকে এক টাকা দামের বাঁশি আর রঙিন চশমা কিনত। আরও পাওয়া যেত এক টাকায় প্লাস্টিকের হাতঘড়ি। ছেলে-মেয়েরা নতুন জামার সঙ্গে রঙিন চশমা আর হাতঘড়ি পরে বাঁশি ফুঁকে ফুঁকে রাস্তার এমাথা থেকে ওমাথা চক্কর দিত।

চারদিকে পোঁ পোঁ বাঁশির আওয়াজে আমার মাথা ব্যথা হত। কিন্তু বিকেল গড়াতে গড়াতে যখন বাঁশির আওয়াজ থেমে যেত, মনটা উদাস হয়ে যেত, ঈদ শেষ!

ঈদের দিন মনের কষ্ট মনে চেপে সকালে কোনরকমে নাস্তা করে, রুমে গিয়ে চোখের পানি ফেলা ছিল প্রথম কাজ। আমার মা আমাদের আর বাসার সাহায্যকারী মেয়েদের একইরকম জামা কিনে দিত, একদম একই। আমি খুব অপমানিত বোধ করতাম, অপমানে সকালে কিছুক্ষণ কেঁদে নিতাম। তবে সেই কান্না কাউকে দেখাতে চাইতাম না।

মহল্লায় সব মেয়েরা দলবেঁধে বেড়াতে বের হতো, ওদের দামি জামাগুলো দেখে আমার কষ্ট আরো একটু বেড়ে যেত। মা আমাদের কোনদিনই দামি কাপড় দিতেন না। বলতেন, যে কাপড় বছর ঘুরতেই পুরাতন হয়ে যায়, তার পিছে অযথা টাকা খরচ করার মানে হয় না।

অন্য মেয়েদের সামনে আমি বেশ লজ্জা পেতাম কম দামি জামা পরে বের হতে। কিন্তু খুব স্মার্টলি ওদের বুঝাতে পারতাম, এই জামা আমি নিজেই পছন্দ করে নিয়েছি এবং খুবই আনন্দিত। এই শুনে সবাই আমার রুচির প্রশংসায় মেতে উঠত। সেই ছেলেবেলায় বুঝে গিয়েছিলাম, ঘটনা যাই হোক মানুষের প্রতিক্রিয়া নির্ভর করে উপস্থাপনার উপর।

এরপর শুরু হতো ছোট একটা হাতব্যাগ নিয়ে মহল্লার বাড়ি বাড়ি ঘুরতে যাওয়া। প্রতি বাড়িতেই দোয়েল পাখির ছবি আঁকা চকচকে দুই টাকার নোটের বান্ডিল এনে রাখা হতো। পাঁচ, দশ আর পঞ্চাশ টাকার নোটও রাখা হতো। বয়স আর সম্পর্ক বুঝে দুই থেকে পঞ্চাশ টাকা পর্যন্ত সেলামি দেওয়া হতো। বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ানো শিশুদের হাতব্যাগ ভর্তি হয়ে যেত দুই টাকার চকচকে নোটে।

আমাদের অবশ্য বাড়ি বাড়ি ঘুরে সেলামি তোলার সুযোগ ছিল না। মা পছন্দ করতো না। বলতেন, কার মনে কী আছে বোঝা মুশকিল। এই একা ঘুরতে গিয়ে কি বিপদ হয় কে জানে? তাছাড়া, যারা সেলামি দেওয়ার অবস্থায় নাই, তাদের বাড়ি গিয়ে তাদের বিব্রত করার মানে হয় না। তার চেয়ে জানালায় বসে মানুষ দেখ। বাড়িতে কেউ কেউ এসে সেলামি দিয়ে যেত আমাদের।

সেই টাকা নিয়ে আমরা মোড়ের মাথার মনোহারী দোকানে চলে যেতাম। বছরে ওই একদিনই আমরা কোলা বা স্প্রাইট কিনতাম। কাচের বোতলের কোলা, সে বোতল বাড়ি আনা যেত না। আমরা দোকানে বসে বসে স্ট্র দিয়ে কোলা টানতাম। সে কি ঝাঁজ! একা একটা ছোট বোতল কোলা টানা অসম্ভব হয়ে যেত। মন খারাপ করে তলানিতে অনেকটা কোলা ফেলে রেখেই বাড়ি ফিরতাম।

ঈদের স্মৃতি বলতে আমার এটুকুই। বড়বেলায় ঈদ আর আলাদা কোন আবেদন তৈরি করতে পারেনি। আমার কাছে ঈদের দিন মানে চারদিকে বাঁশির পোঁ পোঁ শব্দ। বাঁশির শব্দ যত কমে এসেছে, আমার কাছে ঈদের আবেদনও তত কমে এসেছে।

এবারের ঈদের তেমন কোন আবেদন নেই আমার কাছে। ঈদের দুই আনন্দ, ভালো খাবার আর নতুন কাপড়। এবার হাজার হাজার মানুষ দুইবেলার ভাত জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে। রাস্তায় নামলেই অনাহারী মানুষের আর শিশুদের ভিক্ষার জন্য পাতা হাত দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত।

মাঝে মাঝে এত ক্লান্ত লাগে, মনে হয় একটা লম্বা ঘুম দিই। বহুদিন বাদে ঘুম ভাঙবে, উঠে দেখব প্রতিটি শিশু ভরপেটে ঘুমাতে যাচ্ছে ঘুম থেকে উঠে আবার খাবার পাবে এই নিশ্চয়তা নিয়ে।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি,সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!