কিছু গল্প থাকে সবার প্রায় একই রকম

রোজার মাস ফুরিয়ে আসে আর আমরা গুণতে থাকি ঈদের আগমনী ধ্বনি। স্কুলের ক্লাস ফুরিয়ে আসে। কয়েকদিনের মাঝে ছুটির ঘণ্টা বেজে উঠবে।

রাহাত আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 May 2020, 04:45 PM
Updated : 23 May 2020, 04:45 PM

স্কুলের ক্যান্টিনে ঈদকার্ড ঝুলছে। হরেক রকমের ঈদকার্ড। স্কুলে যাতায়াতে দুই এক টাকা সঞ্চয় করতে করতে ঈদকার্ড কেনার টাকাটা জমে যায়। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের ঈদের বিদায়ে ঈদকার্ড দিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে হবে। আমাদের ঈদের কাপড়ের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। কাপড় দেখেই লোকে বুঝে যেত এরা অমুকের ছেলে-মেয়ে। দুই ভাই আর আব্বার একই কাপড়ের শার্ট বা পাঞ্জাবি। বোনদের জন্যও একই কাপড়ের জামা। ফুফাতো, চাচাতো কিংবা আপন বলে কথা নেই, সব বোনের একই জামা।

বিশ রোজার পর একদিন ভ্যানে উঠিয়ে সবগুলো বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে আব্বা চলেন বাজার-সদাইয়ে। এক দোকানে ঢুকিয়ে বলেন, ‘পছন্দ করো’। আমাদের চেহারা দেখে আব্বা বুঝতে পারতো কতটা অপছন্দ হয়েছে। তবুও ঈদের নতুন জামার আনন্দে কবুল করে ফেলতাম। একগাদা বাচ্চাকাচ্চার জন্য এর চেয়ে ভালো পছন্দের সামর্থ্যও ছিল না অবশ্য। ঈদের কাপড় কিনে সোজা যেতাম অজিত দাদার ‘ভাই ভাই টেইলার্স’। সেখানে মাপ-টাপ দিয়ে সোজা বাড়িতে।

সেদিন থেকেই অপেক্ষা নতুন কাপড় গায়ে চড়ানোর। এক একটা করে দিন গুণতে থাকি আমরা। রোজার ছুটি উপভোগও শুরু হয়ে যায়। দিনভর ক্রিকেট খেলে ইফতারের ঠিক আগে বাড়ি ফিরি। মাঝে মাঝে অবশ্য দাদি আর চাচা লাঠি হাতে তাড়িয়ে নিয়ে আসে। তাতে খুব একটা লাভ হয় না। এক দরজা দিয়ে ঢুকে অন্য দরজা দিয়ে আবার মাঠে!

রোজায় ইফতার আর সেহরি সাধারণত মিস দিতাম না। ইফতার বেশি পছন্দের। বিশেষ করে বুন্দিয়া আর বেগুনি জিনিসটা। মাঝে মাঝে আমদানি ঘটে ‘রূহ আফজা’ নামক পানীয়ের, যেটা হাতের তালুতে নিয়ে চেটে খেতে হয়। ইফতার শেষে নামাজের নাম করে আমরা বের হতাম ঘুরতে। চাঁদনি রাতে একটু একটু শীতে অমুকের গাছের জলপাই ঝারতে!

এক রমজানে আমাদের বাজারে এলো ভিডিও গেমস। আগেও ভিডিও গেমস দেখেছি, কিন্তু খেলার সুযোগ পাইনি। এবার নিজেদের বাজারে দেখে মনে আশার আলো জ্বলে উঠলো। আম্মুর টাকা চুরি করে চললাম বাজারে। যে কোন একটা দোকানে খুচরো কয়েন করে নিয়ে সোজা ভিডিও গেমসের দোকান। তারাবি নামাজের সময়ে গভীর মনযোগ দিয়ে চললো মুদ্রার অপব্যবহার। যদিও খুব বেশিদিন সুযোগ হয়নি। কয়েকদিন পর সচেতন পিতাসমাজের শক্ত শাসনে ভিডিও গেমসের চ্যাপ্টার ক্লোজ হলো আমাদের।

রমজান মাস অন্যান্য সব মাসের চেয়ে বেশি আকাঙ্ক্ষিত। শৈশবে পাল্লা দিয়ে রোজা রাখার প্রতিযোগিতা চলতো। শিশুমহলে এই প্রতিযোগিতার গুরুত্ব অসীম। প্রয়োজনে গোপনে লুকিয়ে একবেলা খেয়ে হলেও রোজা রাখার চেষ্টা করতাম এবং শিশুদের আড্ডায় এই নিয়ে তর্কও চলতো। যার রোজার সংখ্যা বেশি তার দিকে সবার নজরও অন্যরকম। আর ঈদ কখন আসবে সেই অপেক্ষা তো রোমাঞ্চকর। একমাস ধরে অপেক্ষার শুরু হয়। তারপর একদিন চাঁদ উঠে। বিটিভিতে গান বাজে, ‘রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ...’।

সদ্য শৈশব পেরিয়ে বয়ঃসন্ধিতে দুটা ডানা গজিয়েছে সবে। একটু একটু পাকা হয়ে উঠছি। নিষিদ্ধ আনন্দ একটু একটু চেখে দেখতে শুরু করেছি। সন্ধ্যা পেরিয়ে একটু একটু অন্ধকারে মিশে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছি। এমন সময় রাতে বাড়ির বাইরে কাটানোর সুযোগ যেন চাঁদ না চাইতেই পূর্ণিমা। রমজান মাসটা সেই সুযোগ হাতে এনে দিয়েছিল তখন। তারাবি পড়তে রোজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে মসজিদে আসি। গ্যাং মেম্বাররা সব একসঙ্গে ওজু করে মসজিদের দোতলায় উঠে পড়ি।

দোতলায় বেশিরভাগ আমাদের বয়সীরাই নামাজ পড়তে ওঠে। আদতে নামাজের চেয়ে বেশি গল্প করতে আসে ওরা। বয়ঃসন্ধির গল্পের অনেকটা জুড়ে নতুন নতুন অভিজ্ঞতার গল্প। কিঞ্চিত গোঁফের রেখা, গলায় একটু ভারিক্কি, শরীরে শিশুকাল পেরিয়ে কৈশোরে প্রবেশের ছাপ, মনোজগতেও তখন তোলপাড় শুরু হয়েছে। স্কুলে ফুলপ্যান্টে প্রমোশন ঘটেছে বছর দুয়েক আগে। এখন জুনিয়রদের থেকে বেশ সম্মান সমীহ পাওয়াও শুরু হয়েছে।

তো সেই সিনিয়রিটির জোশে কী অকাজ করেছি, এইসব কিছুর গল্প চলে নামাজে বসে। তারাবির দীর্ঘ রাকাতে গল্প করে ঠিক রুকুর আগে হাত বেঁধে সোজা ঝুঁকে পড়ি আমরা। প্রতি দুই রাকাত শেষে গল্প চলে। তারাবির ফাঁকে ফাঁকে চলে আমাদের অ্যাডভেঞ্চার। চার রাকাত শেষ করে চুপটি করে নেমে সোজা চলে যাই ভিডিও গেমসের দোকানে। সেখানে মায়ের লুকিয়ে রাখা টাকার শ্রাদ্ধ শেষে ফিরে আসি বাকি নামাজটুকু শেষ করতে। তবে বেশিদিন এই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান চলেনি। অতি দ্রুতই ধরা পড়ে পুরস্কারপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে ভিডিও গেমস অধ্যায়ের সমাপ্তি।

ভিডিও গেমস আমাদের স্মৃতিতে খুব বেশি জায়গা জুড়ে নেই, যতটা জায়গা নিয়ে আছে গাছের ফল চুরি আর নৈশকালীন ভ্রমণ। দিনের বেলা রেকি করে দেখে নেওয়া হয় কোন কোন বাড়ির গাছে মিশন চালানো সুবিধাজনক হবে। তারপর রাতের বেলা চলে হামলা। তখনো ঈদ মোটামুটি শীতেই হয়। শীত বলতে হেমন্তের মাঝামাঝি। জলপাই গাছে কচি কচি জলপাই। এই জলপাই আমাদের রাডারে ধরা পড়ে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। হাত ভরে জলপাই চুরি করে তা পকেট এবং টুপির নিচে রেখে আবার মসজিদে যাই।

এবারও ধরা পরে যাই। একদিন জলপাই চুরি করে মসজিদে ঢুকে সোজা ওজু করতে যাই। হাত ধুয়ে, মুখ ধুয়ে মাথা মাসেহ্ করতে গিয়ে বাধে বিপত্তি। টুপি খোলামাত্র মাথা থেকে ঝুপঝাপ কয়েকটা জলপাই গড়িয়ে পড়ে। আর পাশে চেয়ে দেখি ওজু করতে থাকা লোকেরা আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। পরদিন মোটামুটি কিশোরমহলে এই নিয়ে বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। প্রতিদ্বন্দ্বী কিশোর-গ্রুপ আমাদের এই ঘটনায় রংচং মাখিয়ে আমাদের সুনাম নষ্টের অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়।

যাই হোক, রমজানের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রাত ‘শবে কদর’। অবশ্য আমাদের কাছে তা গুরুত্বপূর্ণ ছিল আরো অনেক কারণে। এই রাত ঈদের পর আমাদের জন্য আরেক উৎসবের উপলক্ষ্য। সন্ধ্যায় বাসায় বাসায় ইফতার নিয়ে যাওয়া দিয়ে এর শুরু। তারপর বাদ এশা মিলাদের শিন্নি খাওয়া থেকে শুরু হয় দ্বিতীয় পর্বের। ওই বয়সে এই একটি রাত আমাদের বাইরে কাটানোর অনুমতি মিলতো। সবার ইবাদতের রাতে আমরা ও আমাদের বয়সী কিশোরদের ইবাদতের পাশাপাশি দুরন্তপনা চলতো।

শৈশব-কৈশোরে খুব সামান্য কিছু থেকেও আমরা আনন্দ খুঁজে নিতে পারতাম। বড়দের মতো এতো আয়োজন, এতো হিসাব-নিকাশ সেই জীবনে ছিল না। রমজান ইবাদতের মাসই শুধু ছিল না, এই মাসটা আমাদের বয়সীদের জন্য নিয়ে আসতো অনাবিল আনন্দের উপলক্ষ্য। জটিলতা ছিল না। খুব সরল, অনাড়ম্বর কিন্তু নির্মল বাতাসের মাঝে সাচ্ছন্দ্যে বেঁচে ছিলাম আমরা। করোনাভাইরাস প্রকোপের কালে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি, কতটা দামি সময় হারিয়ে এসে পড়েছি এইকালে।

লেখক পরিচিতি: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি,সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!