দুঃসাহসী হাঁসের ছানা

হাঁসের ছানাটি বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা সড়কে গিয়ে উঠল। জোরে হেঁটে চলেছে সে। পা দুটো দেখাই যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে একটি ক্রিকেট বল গড়িয়ে যাচ্ছে।

বিএম বরকতউল্লাহ্বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 May 2020, 03:45 AM
Updated : 16 May 2020, 03:45 AM

একটি শেয়াল ছানাটিকে দেখতে পেল। সে মনের আনন্দে বলে উঠল, বাহ্ আজকের সকালটা দারুণ। খিদের পেটে হাঁসের ছানার দেখা পেয়ে গেলাম। ছানাটি ধেই ধেই করে যাচ্ছে কোথায়?

শেয়ালের কথাগুলো হাঁসের ছানার কানেও এসেছে। ছানাটি বলে উঠল, আমার যাত্রাটাও শুভ। কারণ আমি এখন আর একা নই। আমাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য একটি শেয়াল সড়কের আড়ালে হাঁটছে।

শেয়াল বলল, আমি শিকারের সঙ্গে বেশি কথা বলি না। খপ্ করে ধরে ফেলি। তবে তোমার ভাগ্য ভাল আমি তোমার সঙ্গে এখনও বক বক করে যাচ্ছি। তুমি একা কোথায় যাচ্ছ শুনি।

সাগরে। বলে ছানাটি আরও জোরে হাঁটতে লাগল।

কলপাড়ের গর্ত আর ডোবা থাকতে সাগরে কেন? বলল শেয়াল।

হাঁসের ছানা বলল, কলপাড়ের গর্তের সামান্য পানি এবং ডোবা-নালা সবার জন্য নয়। আমি কেন এত ছোট গর্তের মধ্যে পড়ে থাকব? আমি সাগরের বিশাল ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে বড় হব।

সাহস তো কম না তোমার, বলল শেয়াল। দাঁড়াও, আমার একটি কথা শোনো।

দাঁড়াবার সময় নেই আমার। চলো হাঁটতে হাঁটতে কথা বলা যাক।

শেয়াল অবাক হয়ে দেখল, ছানাটির মধ্যে ভয় বলতে কিছু নেই। ছানাটি দেখতে যেমন চমৎকার তেমনি চটপটে আর বুদ্ধিমান। আর ওর কথাগুলো খুব মজার।

ছানার কথা শুনে শেয়াল খুব মজা পেল। সে ছানাটির সঙ্গে হাঁটতে লাগল।

শেয়াল বলল, চলো এই বনের ভেতরের সরু রাস্তা ধরে হাঁটি। এতে তোমার সাগরে যাওয়া খুব সহজ হবে।

চলো, বলল ছানা। ওরা বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ছানাটির মনে সাগরে যাওয়ার আনন্দ।

কিছু দূর যাওয়ার পর শেয়াল হঠাৎ পেছনের দিকে দৌড়তে লাগল।

কে রে তুই, দাঁড়া, গর্জন করে বলল এক সিংহ।

ছানাটি দাঁড়াল এবং বলল, উফ্ কি মুশকিল, কেউ বুঝতে চায় না সাগরে যাওয়ার পথ কতটা দূরের। তুমি আবার কে?

আমি সিংহ। আমাকে দেখে সবাই ভয় পায় আর সমীহ করে পথ ছেড়ে দেয়। তুমি যে সালাম তোয়াজ না করে চলে যাচ্ছ? তোমাকে এখনই গিলে খাব আমি।

তোমাকে সালাম তোয়াজ করতে যাব কেন আমি? বলল ছানাটি।

কারণ আমি হলাম পশু রাজা, বলল সিংহ।

পশু রাজা! আপনমনে বলল ছানাটি। তারপর সে দাঁড়াল এবং রাজাকে সালাম করল। আর বলল, ভ্রমণে বের না হলে অনেক কিছুই আমার দেখা জানা হতো না। বাহ্ এখন রাজার দেখাও পেয়ে গেলাম। সত্যি আমার ভাগ্যটা খুবই ভাল। আমি বনের রাজাকে নিয়ে কত গল্প শুনেছি মা’র কাছে। আজ রাজা দেখে মন ভরল কিন্তু প্রাণ কেঁপে উঠল আমার।

কেন তোমার প্রাণ কেঁপে উঠল? জানতে চাইল রাজা।

আমার মা শুধু রাজার শক্তি আর সাহসের গল্প শুনিয়েছেন আমাকে। কিন্তু রাজা মশাই যে আমার মতো ছোট হাঁসের ছানাও খেয়ে ফেলেন তা তো বলেননি।

সিংহ বলল, আমি কখনও তোমার মতো ছোট প্রাণি ধরে খাই না। তোমাকে ভয় দেখিয়েছি শুধু। তবে তুমি বেশ চটপটে আর সাহসী। দারুণ কথা বলতে পার তুমি। পশু রাজা সম্পর্কে কী গল্প করেছে তোমার মা তা আমাকে শোনাও তো দেখি।

দুই.

হাঁসের ছানা বলল, সাগরে যেতে হবে আমার। চলুন রাজামশাই হাঁটতে হাঁটতে গল্প শোনাই।

ছানা আর রাজা পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে আর গল্প করছে। চারপাশে নানা জাতের পশুপাখি দেখে ছানাটি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে। তার কৌতূহলের সীমা নেই।

রাজা ছানার মুখে গল্প শুনে খুব খুশি হয়ে গেল। গল্প বলতে বলতে ওরা চলে গেল একটি খালের পাড়ে। খালটি পার হয়ে একটু সামনে গেলেই সাগরের দেখা মিলবে। খালের পাড়ে গিয়ে সিংহটি থেমে গেল। ছানাটি অবাক হয়ে বলল, খালের পানিতে খেজুর গাছের মতো এগুলো কী ভাসছে?

এগুলো ভয়ংকর কুমির। পানিতে নামলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে ওরা। চলো ফিরে যাই আমরা।

ছানাটি বলল, যে সাগরে যাবে তাকে কুমিরের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। আপনি চলে যান।

রাজা বলল, তোমাকে বিপদের মুখে ফেলে আমি চলে যাব না। আমি এখানে আছি। দেখি তুমি কীভাবে এই খাল পার হও।

আমিও সাঁতার জানি, বলেই ছানাটি এক লাফে নেমে পড়ল খালের পানিতে। দুই দিক থেকে হাঁ করে ছুটে আসছে কুমির। কাছে আসতেই ছানাটি টুপ করে ডুব দিল। কুমিরেরা ছানাটিকে খুঁজতে লাগল। কুমিরের ধাপাধাপিতে পানিতে তুফান ছুটেছে।

অনেকটা দূরে ছানাটি ভেসে উঠে ডানে বামে তাকাচ্ছে। কুমিরেরা ছুটল ছানার দিকে। আবারও কাছে যেতে ছানাটি ডুব দিল। কুমিরেরা ছোটাছুটি করে খুঁজতে লাগল। খালের পানি ঘোলা হয়ে গেল। ওরা ছানার দেখা পায় না। এই দেখে সিংহ রাজা হাততালি দিয়ে আনন্দ করতে লাগল।

হঠাৎ হাঁসের ছানাটি ভেসে উঠল একটু দূরে। কুমিরেরা তাকে ধরার আগে সে এক লাফে খালের পাড়ে উঠে পড়ল। ছানাটি বলল, কুমির বন্ধুরা, শোনো আজ আমার সময় নেই। তাই তোমাদের সঙ্গে হাবুডুবু খেলাটা শেষ করতে পারিনি। সময় পেলে আবার খেলতে আসব। চমৎকার ছুটতে পার তোমরা। কুমিরেরা রাগে কাঁপতে কাঁপতে লেজের বাড়িতে পানি ছিটিয়ে দিল হাঁসের ছানার দিকে। ছানাটি হাঁ করে উপর থেকে ছুটে আসা পানির ফোঁটা মুখে নিয়ে বলল, এ খেলাটাও মন্দ না। ভাল থেক তোমরা।

এসব বলে ছানাটি সাগরের দিকে ছুটে চলেছে। তারপর সাগরের গর্জন শুনে ছানাটি আনন্দে লাফিয়ে উঠল। সে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল সাগর পাড়ে। সিংহ রাজা দুঃসাহসী ছানার কাণ্ড দেখে ধন্যবাদ জানিয়ে বনে চলে গেল।

তিন.

বিশাল সাগর। বড় বড় ঢেউ ছুটে আসছে শব্দ করে। চারদিকে বাতাস হু হু করছে। উপরে খোলা নীল আকাশ। সাদা কালো মেঘেরা ছোটাছুটি করছে। ছানাটি লাফিয়ে সাগরের পানিতে নেমে পড়ল। ওমনি সে ঢেউয়ের কোলে হারিয়ে গেল।

খানিক পরে ভেসে উঠল সে। তারপর আরেকটা ঢেউ এসে সাগর পাড়ের বালিতে নিয়ে এল তাকে। সে দৌড়ে ছুটল ঢেউয়ের পেছনে। সে নিজেকে সামলে নিয়ে আবারও ঝাপিয়ে পড়ল সাগরের জলে। শুকনো পাতার মতো সে ভেসে বেড়ায় ঢেউয়ের বুকে। কখনো হারিয়ে যায় ঢেউয়ের পাকে। আনন্দই আনন্দ।

ছানাটি সাগর পাড়ের বালিতে লাল কাঁকড়া দেখে ওদের পেছনে ছোটাছুটি করতে লাগল। কাঁকড়াদের ধরতে পারে না সে। কাঁকড়াগুলো দৌড়ে গর্তের ভেতরে চলে যায়। ছানাটি বলল, তোমরা পালিও না। আমাকে বন্ধু মানতে পার। শেষে কাঁকড়ার সঙ্গে ছানার খুব খাতির হয়ে গেল। কাঁকড়ারা বলল তুমি বিপদে পালাবে কোথায়? গর্ত করতে পার?

ছানা বলল, এখানে আবার কীসের বিপদ?

এখানে দিনের বেলা আসে শিকারি পাখি আর রাতে আসে শেয়াল।

তাতে কী? আমি ভয় পাই না কাউকে। কামড়ে দেব, হু।

কিন্তু একদিন একটি অঘটন ঘটে গেল। একটা ঈগল এসে ছানাটিকে ছোঁ মেরে নিয়ে উড়ে গেল। ছানাটি ভয় না পেয়ে আকাশে ওড়ার আনন্দে গান ধরল,

আকাশে ওড়ার স্বপ্ন আমার পূরণ হলো রে...

ঐ দূর আকাশে নীলের কাছে নিয়ে চলো রে।

ঈগল গান শুনে ছানাটির দিকে একবার তাকাল। আর ছানাটি তার গানের সুর আরো চড়া করে গাইতে লাগল। ঈগল বলল, আমাদের ছানাদের পেটে গিয়ে তুমি দারুণ গান শোনাতে পারবে বাছা। ঈগলটি উঁচু পাহাড়ের মাথায় তার বাসায় গিয়ে বসল যেখানে দুটি ছানা হাঁ করে বসে আছে খাবারের অপেক্ষায়।

শিকারটি বেশ ছোট, কিন্তু দেখতে চমৎকার। গানও গায়, বলে আরেকটা শিকার ধরার জন্য মা ঈগল চলে গেল।

ঈগলছানারা হাঁসের ছানার গায়ে ঠোকর দিতেই হাঁসের ছানাটি খলখলিয়ে হাসতে থাকে। আরে তোমরা আমাকে ঠোকর দিচ্ছ কেন? আমার পেটভর্তি গল্প আর গল্প। তোমরা ঠোকর দিলেই মজার মজার গল্পগুলো হাসি হয়ে বেরিয়ে যায়। আর আমার গল্পগুলো শুনলে পরে তোমাদের আর খিদেই থাকবে না। তোমরা তখন আনন্দে ভাসতে থাকবে। এখন তোমরাই বলো গল্প শুনবে নাকি গল্পসুদ্ধ আমাকে খেয়ে ফেলবে।

ঈগল ছানারা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে বলল, মা যখন খাবার আনতে যায় তখন আমরা খুব একা থাকি। তখন আমাদের মন খুব খারাপ হয়ে থাকে। তুমি গল্প শোনালে আমাদের কোনো দুঃখই থাকবে না।

হাঁসের ছানার মুখে গল্প শুনে ঈসলছানারা আনন্দে লাফিয়ে উঠল। আর বলল, আমরা তোমাকে মোটেও খেয়ে ফেলব না। তবে তোমাকে লুকিয়ে থাকতে হবে; মার সামনে পড়তে পারবে না।

ওরা হাঁসের ছানার গল্প শুনে খুশিতে আটখানা। ওরা গল্প শোনে, ওর সঙ্গে খেলে। খাবার ভাগ করে খায়।

হাঁসের ছানার গল্প শুনে ঈগলের ছানারা এত মজা পেল যে তারা পেটের ক্ষুধা ভুলে গেল। তারা বলল, তুমি থাকবে আমাদের একজন হয়ে।

দিনে দিনে হাঁসের ছানা হয়ে উঠল ওদের প্রিয় বন্ধু।

ঈগলের ছানারা পাখা ঝাপটিয়ে উড়ো উড়ো ভাব দেখায়। ওদের আকাশে ওড়ার সময় হচ্ছে। ওদের সঙ্গে হাঁসের ছানাটিও আকাশে ওড়ার স্বপ্ন দেখে। সেও পাখা ঝাপটায়।

একদিন ঈগলের ছানারা পাখা মেলল আকাশে। নিচে সীমাহীন সাগর। উপরে নীল আকাশ। হাঁসের ছানাটিও মেলল পাখা। ওরা আকাশের ওড়ার আনন্দে ছটফট করতে লাগল।

হাঁসের ছানাটি উড়তে উড়তে পাহাড়, সাগর, নদী বন পেরিয়ে অনেক দূরে চলে গেল। তারপর সে মেঘেদের সঙ্গে খেলা করতে করতে চলে গেল বাড়ির উপরে। সে আকাশ থেকে সোজা নেমে এলো মাটিতে। ডোবার সব হাঁস ঘিরে ধরল তাকে।

ছানাটি কীভাবে পথের বাধা সরিয়ে সাগরে গেল এবং কীভাবে ভয়ংকর ঈগলের বাসায় থেকে বড় হয়েছে সব কথা খুলে বলল। ওর কথা শুনে একটি রাজহাঁস বলল, তোমাকে একজন বীর ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছি না। তবে দুঃসাহস অনেক সময় ভয়ংকর বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ছানাটি বলল, দুঃসাহসই এনে দিতে পারে বীরের মর্যাদা। হাঁসেরা এই দুঃসাহসী হাঁসের ছানাকে নিয়ে আনন্দে মেতে উঠল।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি,সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা  kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!