ছোটগল্প: লকডাউন

খুব সাদামাটা জীবন যাপন করে মাহিন। কলেজের মেধাবী ছাত্র। মেসে থাকে, টিউশনি করিয়ে যা পায় তা দিয়ে তার কোনোভাবে চলে যায়।

শফিকুল ইসলামবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 May 2020, 06:48 AM
Updated : 14 May 2020, 06:48 AM

আর্থিক অনটনের মধ্যেই পড়াশোনা চলে তার। শেষ কখন সকালবেলা  খেয়েছে তা হয়তোবা মনে করাটাও বৃথা চেষ্টা হবে। কোনোভাবে দুপুর-রাত এই দুবেলা দুমুঠো পেটপুরে খেলেই চলে।

মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে মাহিন। খুব ছোট্ট একটা পরিবার, বাবা-মা আর আদরের ছোট বোন। বোন সুমি ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে। কিছুদিন পর পরীক্ষা দিবে। এইতো পরীক্ষা চলছে মাহিনের। আর মাত্র কয়েকটা পরীক্ষা বাকি।

মাহিন নিজেও ভাবে পরীক্ষা শেষ হলে একটা চাকরি-বাকরির জন্য প্রিপারেশন নিতে হবে। এই ভেবে টিউশনিও কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। এতসব খুনসুটির মধ্যে হানা দিলো এক অদ্ভুত অজানা রোগের, যার না আছে কোনো চিকিৎসা। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে-সন্তান, তাদের আকাঙ্ক্ষার কোনো কমতি নেই ছেলেকে নিয়ে।

মা তো প্রায়ই পাড়াপড়শিদের বলে, আমার পোলা অনেক বড় পাশ দিবো। অনেক বড় চাকরি লইবো, তোমরা দেইখ্যা লইও। এইতো আর কটা দিন, এরপরই ছেলে পাশ দিবো, চাকরি লইবো, আর আমাগো এই দিন থাকবোনাগো দেইখ্যো তোমরা।

মাহিনের বাপ দেখে ছেলেকে নিয়ে মায়ের বুকভরা আকাঙ্ক্ষার আর অন্ত নেই। এই ভেবে মাহিনের বাবা সেও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপন মনে হু বলে মাথা নেড়ে সায় দেয়।

কিছুক্ষণ পরই মোবাইল বাজতে লাগলো। মাহিনের ফোন। মা অস্থির হয়ে বললো, কেগো মাহিনের বাপ আমার আব্বাজান ফোন করছে মনে অয়? তুমি ফোনডা ধরো না ক্যান এ্যাহনো?

বাবা ফোন ধরে। মাহিন ওপাশ থেকে বলে, হ্যালো! আসসালামুয়ালাইকুম বাবা। কেমন আছেন? মা কেমন আছেন? সুমি কেমন আছে? আপনারা সবাই ভালো আছেন তো?

বাবা বলেন, সবাই ভালো আছে। তুই কেমন আছো?

আমি ভালো আছি।

এর মধ্যে মা ফোনটা বাবার কান থেকে নিয়ে হৃদয়স্পর্শী ভালোবাসার সুরে বলেন, আব্বাজান কেমন আছো তুমি? তোমার শরীরডা ভালো? তুমি খাইছো তো? তুমি একটা ফোনও দেওনা ভুইল্লা গ্যাছো আপন মায়রে?

মাহিন উত্তর দেওয়ার আগে মায়ের হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় সবসময়। তারপর একে একে সব প্রশ্নের জবাব দেওয়া লাগে মাহিনের। এরপর দশ সেকেন্ড চুপচাপ থাকার পর... মা আমার তো বাড়িতে আসা লাগবে!

বাড়ি আসবা আব্বাজান? আসবা! তোমার পরীক্ষা শ্যাস অইলেই আসবা!

মাহিন বলে, না মা। একটা রোগের জন্য সবকিছু পুরোপুরি বন্ধ কইরা দিছে। মেসেও কেউ থাকবে না, সবাই চলে যাবে।

মাহিনের মা ফোনের ওপাশ থেকে বলে, অ....। তয় আব্বাজান কি রোগ? যে হগল বন্ধ কইরা দিছে?

নাহিন উত্তর দেয়, মা এইটা একটা ভাইরাস। এর কোনো চিকিৎসা এহনও বের করতে পারে নাই কেউ।

মাহিনের মা ওপাশ থেকে বলে, অঅঅ...। আব্বাজান মোরা গরীব মানু মোগো আল্লাহ ওই রোগ দেবে না! তয় হ্যারপরও আব্বাজান তুমি তাড়াতাড়ি গেরামে আইয়া পরো। শহরে থাহোনের কাম নাই। কি কও মাহিনের বাপ?

বাবাও মায়ের সঙ্গে সায় দেয়, হ....হ। ওরে বাড়িতে আইতে কও।

কিছুক্ষণ পর ফোন কেটে যায়। পরদিন সকালে যথারীতি নিজের সবকিছুই গুছিয়ে মাহিন রওনা হয় গ্রামের বাড়ির পথে। বাড়ি যেতেই দেখে মা বাড়ির দরজার মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। সামনে আসতেই বুকের সঙ্গে জড়িয়ে কপালে একটা চুমু দিয়ে বলে, এত দেরি অইছে ক্যান আব্বাজান? তুমি এত হুগাইছো ক্যান? কিছু খাওনা আব্বাজান?

মায়ের কথা যেন ফুরায় না। আমি শুধু মুখ বুজে বলি, মা...বাবা কই?

তোর বাপে দোকানে গ্যাছে।

বাবার চায়ের দোকান। বাবা সকালে যায় রাতে আসে। বাবার সঙ্গে কত ধরনের কথা হলো রাতে। এরপর আমরা রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ করি। আমি আসবো বলে বাবা রুই মাছ আইনা রাখছে আমার জন্য। বাবা জানে ছেলের রুই মাছ অনেক পছন্দের। অনেকদিন পর মায়ের হাতের রুই মাছ রান্না বেশ মজা করে খেলাম । এরপর আমি ঘুমাতে গেলাম।

বাবা-মা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করল। বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, বোজলা মাহিনের মা, দোহান নাহি বিহাল পাঁচটার মধ্যে বন্ধ করা লাগবে। কি যানি ভাইরাস আইছে! তুমিই কওতো মাহিনের মা, বিহালে কি আর অইরহম চা বেচন যায়? কও? তার মধ্যে পোলাডা কতদিন পর বাড়িতে আইছে! অরে ভালো মন্দ খাওয়ামু।

মাহিন দরজার ওপাশ থেকে মা-বাবার কথা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গেল। পরদিন সকালে মেস থেকে ফোন আসলো গত মাসের কিছু বকেয়া ও এই মাসের খাবারের এক হাজার টাকা পাঠানোর জন্য। আমি আসার সময় বলে কয়ে আসিনি, তাই ফোন দিয়ে অন্যভাবে কথা বলা শুরু করলো। আমার পকেটে তিনশ টাকার মতো ছিল। পরদিন সকালেও ফোন দিয়ে টাকা পাঠানোর জন্য রীতিমতো বিষফোঁড়ার মতো আচরণ। আমি মন খারাপ করে বসে বসে চিন্তা করছি।

রাতে বাবা বাসায় আসলো। আমাকে ডাকলো, বাবা মাহিন? আমি সাড়া দিলাম। বাবা আসলো। দেখলো আমার মন খারাপ। কারণ জানতে চাইলো, কী আইছে বাপ?

আমিও বাবাকে সবকিছু খুলে বললাম। বাবাকে বলার পর বাবা বললেন, কাইল দেহা যাইবোনে এত চিন্তা হরিস নাহ। ল..বাপ বেটা মিল্লা কয়ডা ভাত খাই হ্যারপর দেহন যাইবো।

রাতে খাওয়া দাওয়ার পর ঘুমাতে চলে এলাম। বাবা মায়ের সঙ্গে বলছেন, দোহানের অবস্থাডাও ভালো না! কী যে হরমু মাহিনের মা। হেরপর পোলাডার মেসে খাওনের টাহা পাইবে! কাইল কি মজিদ মোড়লের দারে যামু?

হ্যার দারে যাইবেন? হ্যায় তো আবার সুদ ছাড়া টাহা পয়সা দ্যায় না। আবার সুদের উফর সুদ। হ্যার উফর বন্ধক রাহা লাগবে। সময়মতো ফেরত না দেতে পারলে বন্ধক লইয়া টান দেবে! আফনের ওই দোহান আর এই বাড়িডা ছাড়া কি আছে?

দোহানডারে বন্ধক দিয়াই টাহা আনি কি কও?

এই কথার পর পরই আমি ঘুমিয়ে পরেছি। সকালে আমি একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠলাম। এরপরই বাবা আসলো, আমাকে ডাকলো। আমি সাড়া দিলাম। বাবা এসে পাঁচশ টাকার দুটি নোট দিয়ে বললেন এই ল বাবা টাহা।

মুখে একটা অন্যরকম অনুভূতি ছিলো বাবার। আমি আমার মতো সময় কাটাই। মায়ের সঙ্গে কত কথা। বলতে বলতে সময় কেটে যায়।

দেখতে দেখতে এরই মাঝে এক মাস পার হয়ে গেল। রাতে বাবা মায়ের সঙ্গে বলছেন, মাহিনের মা কাইল মজিদ মোড়লের টাহা সুদ সমেদ ফেরত দেতে না পারলে দোহানডা আর মোগো থাকফেনা! এই বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বাবা।

পরদিন সকাল সকাল বাবা দোকানে চলে যান। টাকার চিন্তায় রাত অব্দি দোকান খোলা রাখেন। রাত নয়টার কিছুক্ষণ পরই একটা আর্মি জিপ আসে, সবাই তাড়াহুড়ো করে চলে যায়।

বাবাও তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে কেতলির গরম পানি তার পায়ের উপর পরলে সে চিৎকার দিয়ে উঠে। সেই চিৎকার যে কতদূর পর্যন্ত গিয়েছে কে জানে? রক্ত-শোষকদের হুঙ্কার মনে হয় বিধাতাও শুনতে পায়!

লেখক পরিচিতি: শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী সরকারি কলেজ

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি,সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা  kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!