আদিবাসী লোককথা: ভাগ্য দেবতার খোঁজে

কার্মু আর ধার্মু। যমজ দুই ভাই। কার্মু বড়। ধার্মু ছোট।

সালেক খোকনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 May 2020, 05:05 AM
Updated : 4 May 2020, 05:05 AM

পরিবারে বাবা-ই তাদের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি। কিন্তু তিনি মারা যান যখন তাদের বয়স মাত্র দশ। ফলে উপার্জন থাকে বন্ধ। দিনে দিনে পরিবারে নেমে আসে চরম দারিদ্র। তখন পথে নামে কার্মু ও ধার্মু। পথে পথে ভিক্ষা করে যা পায়, তাই দিয়ে চলে তাদের সংসার।

একবার তারা ভিক্ষা করতে যায় চাম্পাগড় ও চায়নগরে। সেদিন ছিল প্রখর রোদ। হেঁটে হেঁটে দুই ভাই বেশ ক্লান্ত। চাম্পাগড়ের খুব কাছেই ছিল একটি নদী। নদীর ধারে একটি কদমগাছ। ক্লান্ত ধার্মু গা এলিয়ে দেয় ওই গাছের ছায়াতলে।

ঘুমের মধ্যে তাকে দেখা দেন ভাগ্যের দেবতা ‘কারাম গোঁসাই’। বলেন, ‘ওহে ধার্মু, কতদিন আর ভিক্ষা করবি? আমার কথা মতো চললে তোদের ভাগ্য যাবে বদলে!’

ধার্মু অবাক হয়। জানতে চায় কীভাবে তা সম্ভব।

তিনি বলেন, ‘কারাম গাছের ডাল পুঁতে কারামপাতার মাদল তৈরি করো, তাকে তিনবার প্রণাম করে ডালের চারদিকে ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকো।’

ধার্মুকে উদ্দেশ্য করে দেবতা আরও বললেন, ‘কদম গাছের নিকট আছে একটি নীল গাভী। পাথরের চাতালে বেনাঘাসের মাঠে আছে মাথায় বাঁধার একখানা কাপড়। আর নদীর ধারের ডুংরীতে বাঁশের ঝাড়ে রাখা আছে একটি বাঁশি। সেগুলো তুই নিয়ে যা। প্রতিদিন নদীর ধারে এসে কারামডাল পুঁতে আমাকে পুজো দিস। তাহলে আমিও তোদের বেশি বেশি ধন দেবো।’

ঘুম ভাঙ্গতেই ধার্মু দেখল নদীর ধারে সত্যিই একটি কারাম গাছ। স্বপ্নে ভাগ্যের দেবতার নির্দেশ মতোই সে ওই গাছের ডাল ভেঙ্গে, মাটিতে পুঁতে, তিনবার প্রণাম করে। তারপর ডালটির চারদিকে ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকে। এমন সময় একটি নীল গাই গরু চলে আসে তার কাছে। গাইটিকে সঙ্গে নিয়ে, ডুংরীর বাঁশের ঝাড় থেকে বাঁশি নামিয়ে, বেনাঘাসের ওপর থেকে পাওয়া কাপড়ে মাথায় পাগড়ি বেঁধে, ধার্মু ফিরে বাড়িতে।

এভাবে প্রতিদিনই সে ভাগ্যের দেবতাকে স্মরণ করতে থাকে। দিনে দিনে ধার্মুদের গরু বাছুরের সংখ্যা যায় বেড়ে। ফলে অল্প সময়েই তারা ধনী বনে যায়।

বড় ভাই কার্মু এসবের কিছুই জানত না। ছোট ভাইয়ের রাখালি দেখতে একদিন সে গেল মাঠে। ধার্মু তখন নদীর ধারে কারামডাল পুঁতে, কারামপাতার মাদল মাথায় নিয়ে ঘুরে ঘুরে নাচছে। তার দিকে তখন তাকিয়ে আছে নীল গাই গরুটি। সবকিছু দেখে কার্মু ভীষণ ক্ষেপে যায়। সে ভাবে ধার্মু কাজ ফেলে খেলা করছে। অযথাই সময় নষ্ট করছে! ধার্মুর কাছে গিয়েই বাঁ হাতে সে কারামডালটি উপড়ে ফেলে। তারপর তা নিক্ষেপ করে নদীতে ।

এ ঘটনার পর থেকে দুই ভাইয়ের সংসারে আবারও নেমে আসে সীমাহীন দারিদ্র্য। জমিতে ধান হলো না। গরু-বাছুরগুলোও গেল মরে। ফলে ধীরে ধীরে দুই ভাইকে আবারও পথে নামতে হলো।

সে সময় ধান রোপনের কাজ হবে এক ধনীর বাড়িতে। এ খবর পেয়ে কাজের আশায় সবার সঙ্গে কার্মু-ধার্মু গেল সেখানে। শুরু করলো ধান রোপনের কাজ। কাজের ফাঁকে সবাইকে খেতে দেওয়া হল মুড়ি। কিন্তু অন্যদের দিতে দিতেই তা শেষ হয়ে গেল। ফলে মুড়ি খেতে পারল না দুই ভাই। তাদের মন ভীষণ খারাপ।

নাওয়া-খাওয়া ছাড়াই কার্মু ও ধার্মু দিনভর ধান রোপন করল। দিনশেষে গেল মজুরি আনতে। কিন্তু এবারও ঘটল একই ঘটনা। অন্যদের দিতে দিতেই টাকা গেল ফুরিয়ে। তারা বড়ই কষ্ট পেল। মজুরি নাই। তাই লাগানো চারা সব তুলে নিতে হবে। এমন চিন্তা করেই কার্মু-ধার্মু ছুটল মাঠের দিকে।

এমন সময় স্বর্গ থেকে নেমে এলো এক বৃদ্ধ। চুল দাড়ি সব তার ধবধবে সাদা। মুখের চামড়া ভাঁজখাওয়া। ওই বৃদ্ধ দুই ভাইকে থামালেন। মনোযোগ দিয়ে শুনলেন তাদের সবকথা।

তারপর বৃদ্ধ বললেন, ‘ভাগ্য দেবতারূপী কারামডালটি বাঁ হাতে তুলে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্যই তোমাদের এত কষ্ট।’

দুই ভাই-ই এ থেকে মুক্তির উপায় জানতে চায়।

বৃদ্ধ বলেন, ‘জালাপুরী দ্বীপের চন্দন পাহাড়ের জঙ্গলে পাবে ভাগ্য দেবতাকে। তাকে খুঁজে আনো। নইলে সপরিবারে অনাহারে মরবে।’ কথাগুলো বলেই সে অদৃশ্য হয়ে গেল।

বৃদ্ধর কথায় দুই ভাই ভয় পেল। নিজেদের অপরাধ ও তার পরিণতির কথা ভেবে তারা কাঁদতে থাকল। পেটে প্রচণ্ড ক্ষিদে। তবুও তারা বেরিয়ে পড়ে ভাগ্য দেবতাকে খুঁজে আনতে। যেতে যেতে তারা পৌঁছে এক গ্রামে। গ্রামের নাম উজারডি। সেখানে এক কাঁঠাল গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছিল কার্মু ও ধার্মু। হঠাৎ কথা বলে ওঠে গাছটি। প্রশ্ন করে, ‘তোমরা কোথায় যাচ্ছ হে?’

জবাবে ধার্মু বলে, ‘আমরা ভাগ্য দেবতাকে খুঁজতে যাচ্ছি।’

শুনে কাঁঠাল গাছ মিনতি করে বলল, ‘এ গাছের নিচে বহুদিন ধরে যে টাকা পোঁতা আছে, আমি আর সেই টাকা দেখাশোনা করতে পারছি না। ভাগ্য দেবতার দেখা পেলে আমার এ কথাটাও তাকে একটু বলো।’

সেখান থেকে দুই ভাই এলো ঝলদা গ্রামে। সে গ্রামে ছিল এক ধনী ব্যক্তি। কার্মু ও ধার্মুকে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমরা কোথায় যাও ভাই?’

দুই ভাই একই উত্তর দেয়।

শুনে লোকটি অনুরোধ করে বলে, ‘আমি আর ধন জমিয়ে রাখতে পারছি না। তোমরা আমার কথাটিও তাকে বলে দিও।’

দুই ভাইয়ের পেটে ক্ষিদে। অথচ ওই গ্রামেও তারা পেল না কোনো খাবার। ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদতে কাঁদতে তারা এলো অযোদিয়া গ্রামে। এ গ্রামে ছিল এক ধনী গোয়াল।

তার সঙ্গে দেখা হতেই তিনি প্রশ্ন করেন, ‘তোমরা কোথায় যাচ্ছ হে?’

কার্মু ও ধার্মুর জবাব শুনে তিনিও অনুরোধ করে বলেন, ‘ভাগ্য দেবতাকে বলো, আমি আর বেশি গরু গোয়ালে রাখতে পারছি না। তাদের গোবর ফেলতে ফেলতে আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠছি।’

কিছুদূর যেতেই পথে পড়ে খরস্রোতা গাংনদী। সে নদীতে ছিল একটি রাঘব বোয়াল।

বোয়াল মাছটি দুই ভাইকে দেখে জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায় যাওয়া হচ্ছে ভাই।’

তাদের উত্তর শুনে বোয়াল মাছ দুঃখ করে বলে, ‘এ জন্মে আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি। আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। তাড়াতাড়ি যেন আমার মরণ হয়। ভাগ্য দেবতার দেখা পেলে এ কথাটি বলো।’

দুই ভাই এরপর এলো জালাপুরী সাগরের ধারে। বিশাল ও উত্তাল সে সাগর। কীভাবে তারা এ সাগর পাড়ি দিবে? চিন্তা আর কষ্টে কার্মু ও ধার্মু সাগর পাড়ে বসে কাঁদতে কাঁদতে থাকে। তাদের কান্নার শব্দ শুনে সাগরপাড়ে আসে এক কুমির। দুই ভাই কুমিরকে সব কথা খুলে বলে।

সব শুনে কুমির তাদের জালাপুরী পাড় করিয়ে দিতে রাজি হয়। কার্মু ও ধার্মু তখনই কুমিরের পিঠে চড়ে বসে। যেতে যেতে কুমিরও তার দুঃখের কথাটি জানায়। বলে, ‘আমি কোন কিছু ধরতে গেলেই তা পালিয়ে যায়। ভাগ্য দেবতাকে একটু বলো, আমার শিকার যেন আর মুখ থেকে ফসকে যেতে না পারে।’

জালাপুরী পাড় হয়ে কার্মু ও ধার্মু পৌঁছে যায় চন্দন পাহাড়ের জঙ্গলে। সেখানে সোনার সিংহাসনে বসে ছিলেন ভাগ্যের দেবতা ‘কারাম গোসাঁই’। ক্ষুধার্ত দুই ভাইকে দেখে তার দয়া হলো। ক্ষুধা মেটাতে প্রথমেই তিনি তাদের সুমিষ্ট ফল খেতে দিলেন। তারপর দুই ভাইয়ের মিনতিতে তিনি আবারও ফিরে যাবেন তাদের কাছে এমন প্রতিশ্রুতি দিলেন।

কার্মু ও ধার্মু তখন অনেক খুশি। ভাগ্য দেবতার উদ্দেশ্যে তারা একে একে বলতে থাকেন কাঁঠাল গাছ, গোয়াল, ধনী লোক, রাঘব বোয়াল ও কুমিরের মিনতিগুলো।

সব শুনে ভাগ্য দেবতা মুচকি হাসলেন। তারপর কাঁঠাল গাছের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পুঁতে রাখা ওই টাকাগুলো তোমাদের। তোমরা সঙ্গে করে নিয়ে যেও।’ গোয়ালার কথা উঠতেই বলেন, ‘তাকে বলে দিও, আর একবার গরুর গোয়ালে ঝাঁটা দিয়ে পরিষ্কার করে সে যেন চলে যায়। ফেরার পথে ওই গরুগুলোও তোমরাই নিয়ে যেও।’ ধনী ব্যক্তির আকুতির উত্তরে ভাগ্য দেবতা বলেন, ‘তার সব ধনও তোমাদের দিলাম।’

রাঘব বোয়ালের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তোমরা তাকে বলে দিও, সে শিঘ্রই মাঝনদীতে মারা যাবে। তার আর কোনো দুঃখ-কষ্ট থাকবে না।’

সবশেষে দুই ভাই জানালেন জালাপুরীর কুমিরের দুঃখের কথা। শুনে ভাগ্য দেবতা কার্মু ও ধার্মুকে বলেন, ‘তাকে বলে দিও, আজ থেকে কোনকিছু সে ধরতে গেলে তা আর পালাতে পারবে না। সে হবে জালাপুরীর রাজা।’

ভাগ্য দেবতারা নির্দেশগুলো পথে পথে সবাইকে জানিয়ে দিয়ে দুই ভাই ফিরে বাড়িতে। সঙ্গে আনে টাকা-পয়সা, ধনসম্পদ আর গরু-বাছুরগুলো। ফলে কার্মু ও ধার্মুর অভাব যায় কেটে। তারা আবার সম্পদশালী হয়ে ওঠে। কার্মু ও ধার্মু শুধু নিজেদের ভাগ্যই ফিরিয়ে আনেনি, বরং ভাগ্য দেবতার কাছ থেকে অনেকের কষ্ট ও দুঃখ থেকে মুক্তিলাভের উপায় জেনে এসেছিল। তাই ভাগ্য দেবতার আর্শিবাদে এরপর থেকে দুই ভাই সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকে।

সাঁওতালরা বিশ্বাস করে এ ঘটনার পর থেকেই তাদের সমাজে কারাম উৎসবের প্রচলন ঘটেছে। ফলে প্রতি ভাদ্রের চাঁদের পূর্ণিমায় এরা কারামডাল পুঁতে বিশেষ আচারের মাধ্যমে ভাগ্য দেবতার পুজো করে আসছে।

এই লেখকের আরও লেখা

লেখক পরিচিতি: লেখক ও গবেষক। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। তার লেখা ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ বইটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মৌলিক গবেষণাগ্রন্থ হিসেবে ‘তরুণ কবি ও লেখক কালি ও কলম’ পুরস্কার পায়। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। প্রকাশিত বই ২২টি। আদিবাসীবিষয়ক বই ১২টি। উল্লেখযোগ্য বই: বিদ্রোহ-সংগ্রামে আদিবাসী, আদিবাসী বিয়েকথা, চন্দন পাহাড়ে, আদিবাসী পুরাণ, আদিবাসী উৎসব, আদিবাসী জীবনগাথা, কালপ্রবাহে আদিবাসী, আদিবাসী মিথ ও অন্যান্য।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি,সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা  kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!