কোভিড-১৯: বন্দিজীবন নয় এটা শেখার সময়

এরই মধ্যে আমার বাসায় থাকার এক মাস পেরিয়ে গেল। এই এক মাসে বাসা থেকে নিচে নামা তো দূরের কথা দরজার চৌকাঠও পেরুইনি।

আদনান কাদিরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 May 2020, 02:02 PM
Updated : 2 May 2020, 02:02 PM

প্রিয় স্কুল, শিক্ষক, বন্ধুদের মুখ কতদিন দেখি না! জানি না আবার কবে দেখা হবে সবার সঙ্গে। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯ এর কারণে সেই ১৭ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে আমার হোম কোয়ারেন্টাইন। মানে বন্দিজীবন!

শুরুর দিকে টিভিতে দেখতাম বাংলাদেশে অল্প কয়েকজন মানুষ কোনদিন ৩ জন, কোনদিন ৫ জন, আবার কোনদিন কেউ আক্রান্ত হননি। ধীরে ধীরে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। করোনাভাইরাসের এ দিনগুলোতে আমি নানাভাবে সময় কাটাচ্ছি। সকালে উঠে প্রথমেই বাবার সঙ্গে শরীরচর্চা করি। তারপর গোসল সেরে নাস্তা করার পর পড়তে বসি।

করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য আমি শ্রেণিশিক্ষকের দেওয়া উপদেশ সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, গরম পানি পান ইত্যাদি সব নিয়মই মেনে চলছি। প্রতিদিন সকালের পড়ালেখা শেষ হলে বাবার সঙ্গে দাবা খেলি। তারপর ছবি আঁকতে বসি। সব কাজ শেষে দুপুরে খেয়ে দেয়ে একটু জিরিয়ে নিই।

তারপর আবার সন্ধ্যায় পড়তে বসি। আর পড়ালেখা শেষে ইউটিউবে আমার প্রিয় কার্টুন সিরিজ ‘গোপাল ভাঁড়’ দেখি। এখানে বলা প্রয়োজন, প্রতিদিন সকালে আমি সংসদ টেলিভিশনে ক্লাসও করছি কিন্তু। আবার আমার বন্ধুর মতো মা-বাবার সঙ্গে হাসি ঠাট্টা করেও দিনের অনেকটা সময় কাটে। এভাবেই মোটামুটি বলতে গেলে ভালোই কাটছে দিনগুলো।

কিন্তু এর মধ্যেও আমার একটা ক্ষোভ আছে। একমাস বাসায় থেকে জীবনটাকে কখনও কখনও বালতির মাছ মনে হচ্ছে। প্রতিদিন বিশ্বব্যাপী আক্রান্ত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ, মারাও পড়ছে। মাঝে মাঝে করোনাভাইরাসের কথা ভাবলে মনে হয়, এই ভাইরাস একটা যমদূত। এর আর একটা নামও দিয়েছি আমি ‘অদৃশ্য বিশ্বযুদ্ধ’। কারণ আমরা কেউ এই ভাইরাসকে দেখতে পারছি না খালি চোখে। অথচ সারা বিশ্ব এর বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করছে। এই যুদ্ধের মধ্যে ভালো খবরও শুনতে পাচ্ছি।

করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে মানুষ যখন নাজেহাল তখন সবচেয়ে উপকৃত হয়েছে প্রকৃতি। আমাদের কক্সবাবজার সমুদ্র সৈকত ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে শিল্পায়নপূর্ব যুগের প্রাকৃতিক দৃশ্য। দূষিত পানির নদী এখন স্বর্গীয় জলাধার। বহুদিন পর বিশ্ব আবার দেখল স্বচ্ছ নীলাকাশ; শুনল পাখির কলকাকলি।

তবে একটা প্রশ্ন জাগে মনে, পরিস্থিতি স্বভাবিক হলে পৃথিবী কী আবার আগের মতো জঞ্জালপূর্ণ হয়ে যাবে? এটা নির্ভর করবে মানুষের আচরণের উপর; তাদের সচেতনতার উপর। করোনাভাইরাস আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আগামীর পৃথিবীর মানুষের উপর নির্ভর করবে শিক্ষাটা কীভাবে কাজে লাগবে।

এখন আমার ভয় করছে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের মানুষ বিশালাকারে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। প্রতিদিন দুই-তিন-চারশ বা তারও বেশি। এরপরও মানুষ সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে প্রতিনিয়ত ঘরের বাইরে যাচ্ছে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির পর মানুষ কী করবে তা এই মুহূর্তে এক অষ্টম আশ্চর্যের বিষয়। সচেতন হলে ভালো, না হলে আর কী, দূষনেই বসবাস।

সচেতন হওয়া আমাদের নিজেদের দায়িত্ব। নিজে সচেতন না হলে সুস্থভাবে বেঁচে থাকা ভার। আমার শুধু একটাই কামনা পৃথিবী যেন সুস্থভাবে চলে। আবার যেন সব স্বাভাবিক হয়। পৃথিবী যেন দ্রুত আরোগ্য লাভ করে। সামনেই ঈদ। এবার হয়ত ঈদ বা দুর্গোৎসব এমনকি কোন উৎসবই পালন করা যাবে না। যেমন করে পহেলা বৈশাখ আমরা পালন করতে পারলাম না।

আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে স্কুলে যেতে। ক্লাসের ফাঁকে বন্ধুদের সঙ্গে আমাদের বিশাল খেলার মাঠে ফুটবল, ক্রিকেট খেলতে। ইচ্ছে করছে মাঠে ছোটাছুটি করতে। আশা করি দুই এক মাসের মধ্যে তাও সম্ভব হবে। এই মুহূর্তে খুব মনে পড়ছে স্কুলের শেষ দিনটার কথা।

১৬ মার্চ ২০২০। তখন পূর্ণ দমে আমাদের ক্লাস চলছে। ক্লাসের বেশির ভাগ সময়ই আলোচনা হচ্ছিল সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস নিয়ে। আমাদের শ্রেণিশিক্ষক প্রতিদিনই ক্লাসের শুরুতে করোনাভাইরাস নিয়ে সচেতনতামূলক আলোচনা করছিলেন। ক্লাস শুরুর আগে বন্ধুদের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে উঠে আসল, আচ্ছা এই করোনাভাইরাস নামটা কীভাবে হলো?

এক বন্ধু মজা করে বললো, তিতা সবজি করোলার নাম থেকে এটা এসেছে। তারপর এর সঙ্গে ভাইরাস যোগ করা হয়। এই কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠল। আবার একজন বললো, এটা আমাদের কোনকিছু করতে নিষেধ করেছে। তখন আর একজন জিজ্ঞাসা করল, কী করতে নিষেধ করেছে? উত্তরে সে বললো, হয়তো দুষ্টুমি না করতে, গেমস না খেলতে নিষেধ করতে পারে। শুনে আবার সবাই হেসে উঠল।

এভাবে করেনাভাইরাস নিয়ে অনেক অনেক আজগুবি দুষ্টুমি চললো। আলাপ করতে করতে একসময় ঘণ্টা বাজল। সবাই যার যার সিটে বসল। আমাদের শ্রেণিশিক্ষক ক্লাসে প্রবেশ করলেন। প্রতিদিনের মতো আবারও করোনাভাইরাস নিয়ে আলোচনা করলেন। আলোচনার শেষে ওই দিনের বিষয়টা একটু আলাদা হয়ে উঠল। কারণ ওই দিন স্যার ঘোষণা করলেন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য ১৭ মার্চ থেকে কলেজ বন্ধ থাকবে।

বেশির ভাগই এ ঘোষণা শুনে খুশি হলো। অল্প কয়েকজন মাত্র দুঃখ পেল।

ক্লাস শেষে ছুটির সময় আমি ও আমার বন্ধু মেহেরাজ কলেজের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, এই ছুটির সময় কী করবি মেহেরাজ?

ও বলল, আর কী ওই একটু ধ্যানমগ্ন থাকব।

আমার আর বুঝতে বাকি রইল না যে ও এই বন্ধের মধ্যে বিরামহীন ছবি আঁকবে। কারণ ও জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে ছবি আঁকা। আমাদের ক্লাসের ওই একটু বিশেষ ধরণের। কারণ ও আমাদের ক্লাসের অন্যান্য ছেলেদের তুলনায় বেশি ভালো। এছাড়া ক্লাসে ছবি আঁকার জন্য বিশেষ খ্যাতি আছে ওর। এজন্য মেহেরাজকে অনেকে ‘ড্রইংয়ের মহারাজ’ বলে ডাকে।

মেহেরাজ আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুই এই বন্ধে কী করবি? বললাম, আমিও ছবি আঁকব। কারণ আমি নিজেও ছবি আঁকতে ভালোবাসি। কথা বলতে বলতে আমরা প্রায় গেটের কাছাকাছি চলে এলাম। মাকে দেখতে পাচ্ছি নিতে এসেছেন। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে মেহেরাজের মায়ের সঙ্গেই কথা বলছেন। কাছে এসে আমরা দুইজন টাটা বাই বাই করে মায়ের হাত ধরে নিজেদের যারা যার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।

লেখক পরিচিতি: ছাত্র, ষষ্ঠ শ্রেণি, প্রভাতী শাখা, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি,সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা  kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!