অ্যান্টেনা ঘুরিয়ে ‘ঝিরঝির’ টেলিভিশন দেখার স্মৃতি

নিয়ম করে টিভি দেখা হতো না কতদিন! লক ডাউনে বাধ্যতামূলক বাসাবন্দি হওয়ার কারণে যখন দিন-রাতে কয়েক বেলা টিভি দেখাটা অভ্যাসে রূপ নিতে শুরু করেছে তখন খুব করে মনে পড়ছে ফেলে আসা নব্বইয়ের দশক আর আমাদের প্রজন্মের টেলিভিশন-নির্ভর জীবন।

পিয়াস মজিদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 May 2020, 03:30 AM
Updated : 1 May 2020, 03:44 AM

ছোটবেলায় আমাদের বাসায় পুরনো মডেলের একটা সাদাকালো টিভি ছিল আর ছিল প্রায়শই এর ‘ঝিরঝির’ রোগ। অ্যান্টেনা কয়েকবার নেড়ে-চেড়ে ঠিক করতে হতো কোনো মোক্ষম অনুষ্ঠানের মুহূর্তে। তখন আমাদের বিরক্তি দেখে কে! যাই হোক, সেই টিভি সেটের ভেতরে বিটিভি আর ভারতীয় দূরদর্শনের সূত্রে কত যে রঙ্গ বসত করত তা দেখে আমরা তাজ্জব বনে যেতাম একেবারে।

স্মৃতিটা বিষাদ দিয়েই শুরু। ভগবান এস গিদওয়ানির 'দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান' বই অবলম্বনে ১৯৯০ সালে সঞ্জয় খান নির্মাণ করেছিলেন টিভি সিরিয়াল; সুরকার নওশাদের করা আবহসঙ্গীতের সুর এখনও কানে বাজে ঠিকঠাক। মনে আছে, যে সকালে টিপু সুলতানের বিয়োগান্ত মৃত্যু দিয়ে সিরিয়ালটি শেষ হল সেদিন স্কুল থেকে ফিরে টিপুর দুঃখে নাস্তা পর্যন্ত করতে পারিনি। এখনও চোখে ভাসে কালো-সোনালি আচ্ছাদনে ঢাকা টিপু চরিত্রের মরদেহের ছবিটি। যতদূর জানি, এই সিরিয়ালে গতকালই প্রয়াত ইরফান খানও যুক্ত ছিলেন।

টিপু সুলতান থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন আবহের ছিল 'ম্যাকগাইভার'। একজন সাবেক সিক্রেট এজেন্ট (রিচার্ড ডিন অ্যান্ডারসন) তার উপস্থিত বুদ্ধি ও হাতের কাছে পাওয়া জিনিসপাতি দিয়ে যেভাবে অসম্ভবকে সম্ভব করত তা আমাদের মনে বিস্ময়ী মুগ্ধতা জাগাত। এক শীতের রাতে বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে একটু আগে। আমি একা 'ম্যাকগাইভার' দেখছিলাম। একটি খালি জাহাজে ম্যাকগাইভার দেখছেন ছুরি-রক্ত আর পেছনে তার অজান্তে কেউ গুলি তাক করছে; ভয়ে ছোট্ট আমি কীভাবে টিভিটা বন্ধ করতে বিছানা ছেড়ে সামনে যাব সেটা ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। মনে আছে ম্যাকগাইভারকে নিয়ে লেখা ডলি সায়ন্তনীর গান, ‘টেলিফোন ধরি না কবিতা পড়ি না/ রাত জেগে দেখি না ভিসিআর/ আমার দুটি চোখ শুধু তাকে খুঁজে ম্যাকগাইভার/ হ্যালো ম্যাকগাইভার/ হ্যালো ম্যাকগাইভার।’

জাপানি সিরিয়াল 'ওশিন' এর কথা কী করে ভুলি! সেই ছোট্ট জাপানি মেয়েটির দুর্দশা, সেখানকার সমাজ, সংস্কার দেখতাম আর আমি মানতে পারতাম না ক্রমশ ওশিনের বুড়ি হওয়া। চোখে ভাসতো পা মুচড়ে কাঠের মেঝেতে বসে দুটি কাঠি দিয়ে ওশিনের চাওমিন খাওয়া। কাছাকাছি সময়ে ইউনেস্কোর শিক্ষামূলক 'মীনা' কার্টুন আর বিনোদনমূলক 'চার্লি চ্যাপলিন' উপভোগের স্মৃতিও সমুজ্জ্বল। ‘আমি বাবা মায়ের শত আদরের মেয়ে’ গানটি কিংবা 'আমার নাম মিঠু' সংলাপটি আমাদের প্রজন্মের কারও পক্ষেই ভুলে যাওয়া সম্ভব না হয়তো।

'সংশপ্তক', 'কোথাও কেউ নেই', 'রূপনগর', 'বহুব্রীহি', 'আজ রবিবার', 'কোন কাননের ফুল', 'জননী জন্মভূমি', 'খাদক', 'চোর' এরকম ধারাবাহিক ও সাপ্তাহিক নাটকের কথা বললে শুধু মুগ্ধতার বয়ানই দেওয়া হবে। বিশেষভাবে মনে আছে 'সহচর' নাটকে মমতাজউদ্দিন আহমদের অভিনয়। সে-ই খালিমপুর গ্রামের লেখক যে বিড়ম্বনায় জীবন হারান তার কী অসামান্য অভিরূপই না ফুটিয়ে তুলেছিলেন নাটকের লেখক এবং অভিনেতা মমতাজউদ্দিন আহমদ। বিটিভির নাটক আমাদের জীবনকে এতটাই দখল করেছিল যে, পরদিন স্কুলে গিয়ে ধারাবাহিক নাটকের আগামী পর্বে কী হবে-সেই সম্ভাবনা বা অনুমানই ব্যক্ত হতো বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম আলোচ্য।

'বিশ্বনাটক' সিরিজে প্রচারিত তলস্তয়ের গল্প অবলম্বনে নির্মিত 'কতটুকু জমি প্রয়োজন' দেখার বেশ পরে আমি মূল গল্পটা পড়েছি। এই নাটকে শহীদুজ্জামান সেলিমের অনন্য অভিনয় গল্পটা পড়ার সময়ও আমাকে তাঁর কথা মনে রাখতে বাধ্য করেছে। আবুল খায়ের, গোলাম মুস্তাফা, ডলি জহুর, দিলারা জামান, লায়লা হাসান, আবুল হায়াত, আবদুল্লাহ আল-মামুন, মামুনুর রশীদ, ইনামুল হক, বুলবুল আহমেদ, এটিএম শামসুজ্জামান, ফেরদৌসী মজুমদার, হুমায়ুন ফরিদী, খালেদ খান, আফজাল হোসেন, সুবর্ণা মুস্তাফা, লাকী ইনাম, নাদের চৌধুরী, তারানা হালিম, শিরিন বকুল, লুৎফুন নাহার লতা, শহীদুজ্জামান সেলিম, মুনিরা ইউসুফ মেমী, রোজী সিদ্দিকী, আজিজুল হাকিম, তৌকীর আহমেদ, টনি ডায়েস, বিপাশা হায়াত, শমী কায়সার, আফসানা মিমি, তানিয়া আহমেদ, নোবেল, শাহেদ, শিমুল, তমালিকা কর্মকার এরাই ছিলেন আমাদের সর্বক্ষণের আলোচনায়৷

রোজী সিদ্দিকির কণ্ঠে একটি নাটকে উচ্চারিত 'এমএ পাশ ফার্স্ট কেলাস' সংলাপটি ভুলবার নয়। মনে আছে হুমায়ূন আহমেদের 'কোথাও কেউ নেই' নাটকে বাকের ভাই-বিরোধী ভূমিকার কারণে আবদুল কাদেরকে (নাটকের 'বদি' চরিত্র) কুমিল্লায় এসে হেনস্থা পর্যন্ত হতে হয়েছিল।

বিচিত্রানুষ্ঠান বলতে এক ও একচ্ছত্র হানিফ সংকেত আর তাঁর 'ইত্যাদি'। পরবর্তীকালে 'শুভেচ্ছা'র মতো আরও অনেক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান এলেও 'ইত্যাদি'র মতো আমাদের আপ্লুত করতে পারেনি। তখনকার ঈদ আরও আনন্দময় হতো, কারণ ঈদ মানেই নতুন 'ইত্যাদি', নতুন 'টিউ টিউ অবিরাম চুপিচুপি...'। শিশু-কিশোরদের নিজেদের অনুষ্ঠান মানে ছিল 'নতুন কুঁড়ি' কিংবা জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক অনুষ্ঠান।

গানের অনুষ্ঠান বলতে রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, শাকিলা জাফর, শুভ্র দেব ও রবি চৌধুরী। ব্যান্ডের গানের রমরমা শুরু হলে গুরু আজম খান থেকে জেমস, বাচ্চু, হাসান আমাদের রক-হৃদয়কে তোলপাড় করত যেন টিভি সেট ভেদ করে।

বিজ্ঞাপন বলতে 'আব্বুর জন্য ইকোনো, আম্মুর জন্য ইকোনো, সবার জন্য ইকোনো', 'রূপসা রূপসা হাওয়াই চপ্পল রূপসা', 'শরীফ মেলামাইন সিংহ মার্কা দেখে নিন' কিংবা বেশ পরে একটু বিতর্ক-জাগানো ‘গোয়ালিনী কনডেন্সড মিল্ক’।

একুশে ফেব্রুয়ারিতে টিভিতে নিয়ম করে প্রচার করা হতো জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ আর ষোল ডিসেম্বর বা ছাব্বিশে মার্চে হয়তো 'কলমীলতা', 'অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী', 'ওরা ১১ জন'। মহররমের সময় টিভিতে চলতো শোকাবহ চলচ্চিত্র 'মেসেঞ্জার'। তবে শৈশব-কৈশোরজুড়ে আমাদের মনের মঞ্চে আলোড়ন সৃষ্টিকারী তিনটি সিনেমা ‘বেদের মেয়ে জোসনা’, ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ আর অনেকটা পরে ডাবিংকৃত 'টাইটানিক'।

বাংলা ও হিন্দি সিনেমার সূত্রে আমাদের প্রিয় ও পরিচিত মুখ ছিল রাজ্জাক, শাবানা, ববিতা, আলমগীর, প্রবীর মিত্র, ফারুক, সালমান শাহ, মৌসুমী, শাবনূর, দিলীপ কুমার, অমিতাভ বচ্চন, নার্গিস, শাম্মী কাপুর, ঋষি কাপুর, রেখা, হেমা মালিনী, গোবিন্দ, রাভিনা ট্যান্ডন, কাজল, সোনালী ব্রেন্দে, সঞ্জয় দত্ত, শাহরুখ-আমির-সালমান খান, অজয় দেবগন আরও আরও কত কে!

সিনেমার তারকারা আমাদের কাছে ছিল প্রায় দোষশূন্য, দেবতুল্য। তাই সঞ্জয় দত্ত দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাগারে গেলে আমরা কাতর হয়েছি দুঃখে। ছোটবেলায় আমাদের জন্য সিনেমা মানে ছিল 'বই'। আর সিনেমায় গান শুরু হলে আমাদের প্রতি নির্দেশ আসতো আবার কাহিনী শুরু হলে দেখতে আসার। হয়তো গানের রোমান্টিক আবহ বাচ্চাদের বখে যাওয়ার প্রেরণা জোগাতে পারে বলে অভিভাবকদের বিশ্বাস ছিল৷ তো সাধারণত রোববারে ভারতীয় দূরদর্শনে ভাল সিনেমা দেখানো হতো৷ এত এত সিনেমা দেখেছি বাসার সবাই মিলে।

কিন্তু আমার মনে আছে এক শীতসন্ধ্যায় বাবার নিষেধ ডিঙিয়ে লেপের তলায় শুয়ে লুকিয়ে দেখা 'অমর প্রেম' সিনেমাটির কথা। সে-ই সিনেমায় একটি ছেলের শৈশবে হারিয়ে যাওয়া এক সমাজ-ধিকৃত নারীমুখ আর পরিণত বয়সে আবার তাকে খুঁজে পাওয়ার গল্প আমাকে অধিকার করেছিল রীতিমতো। দুর্ভাগ্যের বিষয় কাহিনীটি মনে থাকলেও সিনেমার নামটি বেমালুম বিস্মৃত হওয়ায় পরে বহুদিন সন্ধান করেও দেখতে পারিনি৷ কয়েক বছর আগে সিনেমার কাহিনীটি বলতেই বন্ধু সামিউল ইসলাম পোলাক বলে দিল, এটি শর্মিলা ঠাকুর-রাজেশ খান্না-ভিনোদ মেহতার সিমেমা 'অমর প্রেম' (১৯৭২)।

হারানো রত্ন ফিরে পাওয়ার কৌতূহলে যখন দ্বিতীয়বারের মতো দেখি সিনেমাটি তখন কানে ভেদ করে মরমে প'শে এই সিনেমার অসাধারণ দুই গান 'বারা নাটখাট হ্যা রে কৃষ্ণ কানহাইয়া' আর 'কুচ তো লোগ কেহেঙ্গা, লোগো-কা কাম হ্যা ক্যাহনা'। এতদিন পর জানলাম গান দুটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে দুই অমর নাম, লতা মুঙ্গেশকর ও কিশোর কুমার।

'ম্যাকগাইভার' এর মতোই প্রিয় আর দুটি বিদেশি সিরিয়াল ছিল 'রোবোকপ' এবং 'দ্য এটিএম'। আর একেবারে মনপ্রাণ-কাড়া সিরিয়াল বলতে গেলে 'আলীবাবা চল্লিশ চোর, 'আলিফ লায়লা ', 'সিন্দবাদ'। আলীবাবা, কাশেম, মর্জিনা, আলিফ লায়লা, মালিকা হামিরা, ডাকু কেহেরমান এইসব চরিত্র আমাদের এমন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে বাস্তব অনেক বিপন্ন পরিস্থিতিতে আমরা এদের কারও কারও উপস্থিতি প্রত্যাশা করতাম আর এইসব সিরিয়াল চলাকালে বিজ্ঞাপন-বিরতি শুরু হলে বা বিদ্যুৎ চলে গেলে ভয়ঙ্কর নাখোশ হতাম। 'সিন্দবাদ' এর জাহাজ আমাকে ডাঙার বাস্তব থেকো তাড়িয়ে নিয়ে যেত দূরের সমুদ্রে, তার নোনা গন্ধে।

'চন্দ্রকান্তা' নামে একটি পৌরাণিক সিরিয়ালেও বুঁদ হয়েছিলাম বহুদিন। 'চন্দ্রকান্তা কি কাহানি...' গানটিও ছিল সম্মোহক। দাস বিদ্রোহ নিয়ে নির্মিত 'দ্য কুইন', শেরউডের জঙ্গলের গরিববন্ধু ডাকুর গল্প 'রবিনহুড' কিংবা সমুদ্র-রোমাঞ্চকর 'মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড' এর কথা ফিরে ফিরে মনে পড়ে। আর বিশেষ করে মনে পড়ে 'আকবর দ্য গ্রেট' এর কথা। এর আবহবাণীটি আমার প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল 'সূর্য ওঠে আবার অস্তমিত হয় ওই দিগন্তের পানে তবু ধরণীর বুকে তার চিহ্ন রেখে চলে'। 'আকবর' দেখা শেষ হলে মন ভার হয়ে থাকতো এই কারণে যে আমাদের বয়সে আকবর শাহী সালাম পাচ্ছে, ফূর্তি করছে আর আমাদের কিনা সারাক্ষণ স্কুলের পড়া পড়তে হচ্ছে।

একসময় ভারতীয় দুটো চ্যানেল চালু হল 'ডিডি ১' আর 'ডিডি ২'। এর কোনো একটায় দুপুরের দিকে 'শান্তি' শিরোনামে সুদীর্ঘ এক ধারাবাহিক দেখতাম একা আমিই, কারণ মন্দিরা বেদির শান্ত -শাণিত অভিনয়ের এমন ধীরলয়ের অনুষ্ঠান দেখার মতো মানুষ বাসায় আমি ছাড়া ছিল না কেউ-ই। ভাই-বোনেরা বরং ১-১০ ক্রমানুসারের চলতি হিন্দি গানের অনুষ্ঠান দেখতে ভালবাসত। গানের ক্ষেত্রে আমার ভাল লাগা ছিল বিটিভিতে প্রচারিত ফিরোজা বেগমের যেন-বা ধূপগন্ধী আবেশ ছড়ানো বা খালিদ হোসেনের মরমী মাধুর্যের নজরুলগীতি৷

তখন তো এখনকার মতো কথায় কথায় লাইভ অনুষ্ঠানের সুযোগ ছিল না। তবে দুঃখজনকভাবে নিহত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর শেষকৃত্যানুষ্ঠানটি দূরদর্শনে প্রচারিত হওয়ার কথা মনে আছে৷ সোনিয়া -রাহুল আর প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর যমুনা-তীরে দাঁড়ানো শোকার্ত ছবিটা টেলিভিশনসূত্রেই মনো-অ্যালবামে গাঁথা আছে আজও।

টিভি দেখে দেখে আমার ভেতরে সাহিত্যের বীজ কতটুকু উপ্ত হয়েছে মালুম নেই। কিন্তু এটা মনে আছে ঈদের এক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ 'সাম্পান' বিষয়টি বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন রফিক আজাদের একটি কবিতার কথা। সে-ই বোধ করি আমার প্রথম শোনা এক বিশিষ্ট আধুনিক কবিতা, 'সুন্দর সাম্পানে চড়ে মাধবী এসেই বলে যাই...’। টেলিভিশনে দেখা-শোনা কতটা প্রভাবী তা অনুমান করা যাবে যখন এখনও আজান হলে কানে ভেসে আসে ছোটবেলায় টিভিতে শোনা মধুর আজান আর আজানোত্তর সেই বাংলা তর্জমা-বাক্যগুচ্ছের কিয়দংশ 'নিশ্চয়ই তুমি ভঙ্গ করো না অঙ্গীকার।'

টেলিভিশন স্মৃতির কথা মনে আসতেই অনিবার্যভাবে মনে পড়ে ক্লাস ওয়ান-টু'তে থাকতে আমাদের দূর প্রতিবেশী এক পরিবারের আদুরে কন্যা অতশীর কথা। কুমিল্লা মুনলাইট স্কুলের ঠিক পেছনে ছিল ওদের বাসা, ওরই নামে বাসাটা 'অতশী'। ও স্কুলের টিফিন আওয়ারে ক্লাসরুম থেকে দেখতে পাওয়া ওদের বাসার জানালায় তাদের টিভি সেটটা ঘুরিয়ে রাখতে বলত ওর মাকে। সেসময় তার কোনো পছন্দের অনুষ্ঠান দেখত ওই প্রক্রিয়ায়। আমরা হাসতাম আবার ওর সাথে ভাগও বসাতাম মুফতে এভাবে টিভি দেখার মওকায়।

টেলিভিশনে দেখতে পাওয়া রঙিন মানুষদের কাছ থেকে কেবল হাসি আর আনন্দের উপচারই সংগ্রহ করতাম না আমরা, তাদের দুঃখ আমাদেরও গ্রাস করতো বিপুলভাবে৷ নয়তো ভারতীয় নায়িকা দিব্যা ভারতীর আত্মহত্যা, সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশের নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রীর মৃত্যু কিংবা সালমান শাহের বিয়োগান্ত পরিণাম আমাদের এতটা আক্রান্ত করেছিল কেন?

টেলিভিশন দেখায় ভালোরকম ছেদ পড়ে আমার কলেজে পড়াকালেই। তখন এত চ্যানেলের ছড়াছড়ি শুরু হয় যে তাল সামলানো যেত না। আর তখন জীবনের ধূসর অঞ্চল একটু একটু বুঝতে শুরু করেছি বলে হয়তো টিভির রঙিন আকর্ষণ ফিকে হতে শুরু করেছিল। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রথম যখন বিটিভিতে কবিতা পড়তে গেলাম, আমি বিস্ময়ে ভাবছিলাম, এই সেই বোকা বাক্সের ভবন! এটাই সাম্রাজ্য বিস্তার করে রেখেছিল আমাদের শৈশব-কৈশোরে!

এখনও মনে পড়লে হাসি পায় টিভির স্ক্রিনে সিনেমা বা নাটকের শুরুতে যখন 'শ্রেষ্ঠাংশে' বা 'কুশীলব' শব্দগুলো ভেসে আসতো তখন ভাবতাম 'আরে, কারা এই দুই ব্যক্তি- 'শ্রেষ্ঠাংশ' আর 'কুশীলব'! এরা কী করে সব নাটক আর সিনেমায় অভিনয় করে!'

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি,সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা  kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!