করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর যত্ন

কোভিড-১৯ মহামারী আকার ধারণ করার কারণে পৃথিবীর মোটামুটি সব দেশেই সাধারণ জীবনযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা এসেছে। ‘সবাই বাসায় থাকুন, নিরাপদে থাকুন’ এই মুহূর্তে মহামারী প্রতিরোধে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের মধ্যে অন্যতম একটি।

ফাতেমা আখতার মিতুবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 April 2020, 04:01 AM
Updated : 9 April 2020, 04:01 AM

অনেকে অফিসে সারাদিন বকবক শেষে বাসায় এসে প্রতিদিন অন্তত একবার হলেও আওড়ান- একটা লম্বা ছুটি দরকার; কোত্থাও যাবো না, শুধু বাসায় বসে খাবো আর ঘুমাবো। করোনাভাইরাসের কারণে ঢাকা লকড ডাউন হওয়ার পর অনেকেই বাসা থেকে অফিস করছেন কিংবা বাসায় বসে বসে বিরক্ত হচ্ছেন। প্রোডাক্টিভ কী করা যায়, আইডিয়া খুঁজছেন। এ অবরুদ্ধ জীবন থেকে মুক্তি পেতে পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ দিন গুণছে।

অথচ দৈনন্দিন জীবন যাদের একটা নির্দিষ্ট ছকে বাধা রুটিনে চলে, কখনো ভেবেছেন সেইসব মানুষের কথা, সেইসব শিশুদের কথা! রুটিনের বাইরে গেলেই এ ধরণের শিশুদের আচরণগত সমস্যা বেড়ে যায়, সাথে সাথে বাবা-মায়ের চিন্তাও বেড়ে যায়। এরকম পরিস্থিতিতে যেসব শিশুদের অটিজমের বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তাদের প্রতি বিশেষ যত্নশীল হওয়া সত্যিই পরিবারের জন্য চ্যালেঞ্জিং।

এ ধরনের শিশুরা প্রতিদিন কিংবা সপ্তাহের কিছু নির্দিষ্ট সময় স্কুলে বা থেরাপি সেন্টারে বিশেষ চিকিৎসা যেমন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি বা অকুপেশনাল থেরাপি বা সমন্বিত চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকে। তবে এ মুহূর্তে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে সরাসরি চিকিৎসা সেবা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার হলো একটি মারাত্মক মাল্টিফ্যাক্টোরিয়াল ডিজঅর্ডার। যে বিষয়গুলোর উপর ভিত্তি করে অটিজম শনাক্ত করা হয় তার মধ্যে মূল লক্ষণগুলো হলো যোগাযোগ বা কমিউনিকেশনে অপারগতা, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া (সোশাল ইন্টারেকশান)/ সামাজিক যোগাযোগে সমস্যা (সোশাল কমিউনিক্যাশান) এবং একই কাজ পুনরাবৃত্তির আচরণ (রিপিট্যাটিভ বিহেভিয়ার)। ফলে এধরনের শিশুরা তাদের চারপাশে কী ঘটছে তা অনুভব করতে পারে না, একই ধরনের আচরণ বারবার করতে থাকে, অনেক সময় কোনো অদ্ভুত বা বিশেষ কোনো কিছুর প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করে।

২ এপ্রিল ছিলো ১৩তম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। বর্তমান পরিস্থিতিতে অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের বাবা-মায়ের বা পরিবারের কী করণীয় এ বিষয়ে লিখার অনুপ্রেরণা পেলাম আমার খুব কাছের আমেরিকান সহকর্মীর সাথে কথা বলার পর।

এই নতুন জীবনযাত্রার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের জন্য কঠিন। একজন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট হিসেবে যতটুকু বলতে পারি, ‘সোশাল স্টোরি’ ব্যবহারের মাধ্যমে কোভিড-১৯ সম্পর্কে অবহিত করা (কেনো সবাই এখন বাসায় আছে, ভাইরাস কীভাবে ছড়ায়, ভাইরাস প্রতিরোধে করণীয়) খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটা শিশুর তথ্যগ্রহণের ক্ষমতা এক নয়। কোভিড-১৯ সম্পর্কে তাদের অবহিত করার আগে প্ল্যান করুন কতোটুকু তথ্য দেওয়া উচিত। অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে বেশি তথ্যের কারণে যেন বিভ্রান্তের সৃষ্টি না হয়।

লক্ষ্য রাখতে হবে শিশুটি যেন সেই তথ্য প্রসেস করার সময়টুকু পায়। যেসব শিশুরা নন-ভারবাল অর্থাৎ মৌখিক ভাষার মাধ্যমে যোগাযোগ করতে অপারগ তাদের ক্ষেত্রে আপনার কথা বলার টোন খুব কাজে দেয়, তারা চেষ্টা করে সে অনুযায়ী আচরণ করতে। এক্ষেত্রে স্কুল শিক্ষক এবং স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্টের পরামর্শ নিতে পারেন। সোশাল স্টোরিতে কী ধরনের তথ্য ব্যবহার করবেন তা আপনার সন্তানের স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্টের কাছ থেকে জেনে নিন। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের অস্থির আচরণ কমাতে পরিবারের সবাইকে বিশেষ করে বাবা-মা ভাই বোনকে একসঙ্গে শিক্ষক, স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, সাইকোলজিস্ট এর ভূমিকা পালন করতে হবে।

প্রতিদিনের রুটিনে কতটা পরিবর্তন এসেছে সেটা মানিয়ে নেওয়াও অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। নতুনভাবে যোগ হওয়া অ্যাক্টিভিটিগুলো ঠিকভাবে গ্রহণ করছে কিনা লক্ষ্য করুন। নতুন রুটিনের কাজগুলোকে প্রতিদিনের অন্যান্য কাজের সাথে ভাগ করে দিতে পারেন। কাজের তালিকা দেয়ালে বা ফ্রিজের গায়ে ঝুলিয়ে রাখতে পারেন। দিন শেষে চেষ্টা করুন আগামী দিনের রুটিনের সাথে একটু পরিচয় করিয়ে দিতে। এতে করে আপনার শিশু আগামীকাল কী হতে চলেছে সে সম্পর্কে একটা ধারণা পাবে।

অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুরা তাদের সেন্সুরি চাহিদা অনুযায়ী স্ট্রাকচার্ড খেলাধুলা অথবা আনস্ট্রাকচার্ড খেলাধুলা করতে পারে। আপনার শিশু পছন্দ করে এমন ধরনের খেলা নির্বাচন করুন। হতে পারে এককভাবে খেলা (নিজে নিজে খেলা) অথবা পরিবারের অন্যদের সাথে শেয়ার করে খেলা। অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের সাথে কাজ করতে গিয়ে আমি দেখেছি লেগো বেইজড থেরাপি খুব কাজে দেয়। লো বা হাই ফাংশানিং শিশু উভয়ের ক্ষেত্রে এটি খুব ভালো কাজ করে। এর মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের দক্ষতা খুব সহজেই বাড়ানো যায়।

শিশুকে তার সক্ষমতা অনুযায়ী ঘরের কাজে সাহায্য করতে এবং দৈনন্দিন কাজে প্রয়োজনীয় শব্দ ব্যবহারে উৎসাহ দিন। দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে তাকে নিয়ে ফান অ্যাক্টিভিটির মাধ্যমে অথবা ভিডিওর মাধ্যমে কিছু শারীরিক ব্যায়াম করাতে পারেন। শিক্ষামূলক ভিডিও দেখাতে পারেন, যা তাদের জ্ঞানের দক্ষতার (কগনিটিভ স্কিল) সাথে সাথে বিভিন্ন ধরনের ফেসিয়াল ইমোশান বুঝতে সহায়ক হিসেবে কাজ করবে।

যেহেতু এই মুহূর্তে স্কুল বা থেরাপি সেন্টারে যেতে পারছে না, চেষ্টা করুন স্কুলের কিছু কাজ যেগুলো বাড়িতে করানো সম্ভব তা নিয়মিত করাতে। এক্ষেত্রে সপ্তাহে অন্তত একবার স্কুল শিক্ষকের সাথে ফোনে কথা বলে কিংবা ভিডিও কলের মাধ্যমে সাহায্য নিতে পারেন। অথবা আপনার শিশুর প্রাত্যহিক কাজের ছোট ভিডিও করে থেরাপিস্টকে পাঠাতে পারেন। নতুন কোনো পরিবর্তন কিংবা অস্বাভাবিক কোনো আচরণ করছে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখুন।

যদি সম্ভব হয় সহপাঠীদের সাথে সপ্তাহে অন্তত একবার অনলাইনে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারেন। কী নিয়ে কথা চালিয়ে যাবেন তা আগে থেকে ঠিক করে রাখুন। অবশ্যই এক্ষেত্রে আপনাদেরকে পাশে থেকে কনভারসেশান পরিচালনা করতে হবে, নতুবা শিশুকে বেশি সময়ের জন্য বসিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। পাশাপাশি অন্যান্য অভিভাবকদের সাথে নিয়মিত কথা বললে আপনার যেমন মন ভালো থাকবে তেমনি আপনিও বিভিন্ন বিষয়ে নতুন নতুন আইডিয়া শেয়ার করতে পারবেন, প্রয়োজনে আইডিয়াও নিতে পারবেন।

আপনার শিশুর খাদ্যাভাসের দিকে যত্নশীল হোন। যদি বিশেষ ধরনের খাদ্যাভাস থেকে থাকে সেক্ষেত্রে ডাক্তার বা পুষ্টিবিদের কাছ থেকে পরামর্শ নিন। যে কোনো ধরনের শারীরিক অসুস্থতায় এ মুহূর্তে কী করণীয়, তার পরামর্শের জন্য ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখুন। আমরা সবাই একটা দুঃসহ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, তারপরও চেষ্টা করবেন পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভালো একটা সময় কাটাতে, এতে করে আপনি যেমন স্ট্রেস থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারবেন তেমনি আপনার সন্তানকেও একটা সুস্থ ও চিন্তামুক্ত ঘরোয়া পরিবেশ দিতে পারবেন।

আমি আমার আমেরিকান সহকর্মী বন্ধু্র কাছেও জানতে চেয়েছিলাম সে কীভাবে অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের সাহায্য করছে। জানালো, এ পরিস্থিতিতে সব ধরনের প্রাইভেসি রুলস মেনে ডক্সি.মি টেলিথেরাপির মাধ্যমে শিশুদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তবে যেসব শিশুদের গুরুতর মনোযোগের সমস্যা (সিভিয়ার এটেনশান ডেফিসিট) রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের সাথে কথা বলে জেনে নিচ্ছে এবং সে অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের হোম রিসোর্স, সোশাল স্টরি, ভিজুয়াল সিডিউল তৈরি করে ইমেইলে পাঠিয়ে দিচ্ছে।

সে আরোও একটি বিষয়ে খুব গুরুত্ব দিয়েছে যার সাথে আমিও একমত। তা হলো, যেহেতু এ ধরনের শিশুরা দিনের বেশ অনেকটা সময় স্কুলে কাটায়, সেই স্কুলের পরিবেশ থেকে তারা এক ধরনের সেন্সুরি স্টিমুলেশান ডেভেলাপ করে। তাই বাসায় কোনো একটা রুমের কর্নারকে যদি কিছুটা হলেও কিছু খেলনা (স্কুলে ব্যবহার করে এ জাতীয় খেলনা হলে খুব ভালো হয়) বা বিভিন্ন অ্যাক্টিভিটির সরঞ্জামাদি রেখে ক্লাশরুমের আদলে একটা নিরিবিলি পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া যায়, তাহলে শিশুদের অস্থিরতা কমানো সম্ভব।

বাংলাদেশের ‘তরী ফাউন্ডেশন-স্কুল ফর গিফটেড চিল্ড্রেন’ এর পরিচালক মারুফা হোসেইনের কাছ থেকেও জেনেছি তার প্রতিষ্ঠান কীভাবে কাজ করছে এ লকডাউনের সময়ে। ২২ মার্চ থেকে তারা অনলাইনে ক্লাশ নেওয়া বা অভিভাবকদের পরামর্শ দেওয়া শুরু করেছেন। বেশিরভাগ শিশুরা নন ভারবাল বলে মায়েদের সঙ্গে বেশি যোগাযোগ রাখছেন।

এছাড়া যারা অনলাইনে কম্ফরটেবল না তাদের সঙ্গে ফোনে নিয়মিত খোজখবর রাখছেন। শিশুদের প্রতিদিনের নির্ধারিত হোম ওয়ার্ক শেয়ার করছেন অভিভাবকেরা। দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় ছাড়াও অভিভাবকেরা দিনের যেকোনো সুবিধাজনক সময়ে স্কুলের শিক্ষক এবং থেরাপিস্টের সাথে যোগাযোগ রাখছেন প্রয়োজনীয় পরামর্শের জন্য।

দেশের এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, স্কুল বা থেরাপি সেন্টারে যারা অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন তাদের এবং সব অভিভাবকদের প্রতি রইলো শুভকামনা। পৃথিবীর সব মানুষ নিরাপদে থাকুক, সুস্থ থাকুক। আল্লাহ আমাদের এই দুর্যোগ থেকে রক্ষা করুক, শিঘ্রই ফিরে আসুক স্বাভাবিক জীবন, আবার শুরু হোক কর্মব্যস্তময় মানুষের ছুটে চলা।

লেখক:  পেশায় একজন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বাফেলো ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন। বসবাস করেন ইতালির পাভিয়া প্রদেশের ভিয়া জিওভান্নি তাভাজ্জানি এলাকায়

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি,সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!