কত দূর দূর বেড়াতে গেছে অনেকে, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, দুবাই। কেউ আবার দেশের ভেতরেই কক্সবাজার, সিলেট বা বান্দরবানে। কেউ আবার কাছেই গ্রামের বাড়িতে দাদু-নানুর কাছে। গান শুনে, ছবি এঁকে, হেসে-খেলে, গল্প করে সময় পার হয়ে গেছে।
আর এবারের ছুটিটা একেবারেই অন্যরকম। না আছে কোন বেড়ানো, না বাসা থেকে একটু বের হওয়া! শুধু বারান্দা আর ঘর, ঘর আর বারান্দা। এভাবে কি দিনের পর দিন থাকা যায়! কিন্তু উপায় নেই। বাসায় থাকতেই হবে। এবারের ছুটি অন্য সব ছুটি থেকে আলাদা। এবারে ছুটি দেওয়াই হয়েছে বাসায় থাকার জন্য। বাসার বাইরে যে ওঁত পেতে আছে বিপদ।
শুধু বিপদ বললে কম বলা হয়, মহাবিপদ। এই মহাবিপদের নাম ‘করোনাভাইরাস’। এখন সব জায়গায় করোনাভাইরাসের কথা। টেলিভিশনে, রেডিওতে, পত্রিকায় এমনকি বাবা-মার গল্পেও।
অথচ আশ্চর্য, কোথায় করোনাভাইরাস? কেউ কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। দেখবো কীভাবে! এরা যে জীবাণু, জীবাণুদের খালি চোখে দেখা যায় না। করোনাভাইরাস এতো ছোট্ট যে স্কেলের এক মিলিমিটার দাগও তার কাছে দশ হাজার গুণের চেয়ে বড়। তাই এ ভাইরাসকে দেখার জন্য দরকার হয় ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ।
এই যন্ত্রের নিচে করোনাভাইরাসকে দেখায় আমাদের পরিচিত কদমফুলের মতো, সারা গায়ে ছড়ানো ছিটানো কাঁটা। করোনা শব্দের অর্থ মুকুট, আমরা ফুল দিয়ে তৈরি যে মুকুট মাথায় পরি তা।
এ করোনাভাইরাসের হাত থেকে বাঁচার জন্য এখন আমরা সবাই বাসায় বসে আছি। কারণ করোনাভাইরাস সংক্রামক রোগ, এরা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। মাত্র তিন মাস আগে আমরা এই নতুন ভাইরাসের কথা জানতে পারি। চীন দেশের উহান শহরে প্রথম করোনা রোগী সনাক্ত হয়। আর এরই মধ্যে তা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। লাখ লাখ মানুষ করোনা রোগে আক্রান্ত হয়েছে, প্রতিদিনই এ সংখ্যা বাড়ছে। এতো মানুষকে চিকিৎসা দিতে পৃথিবীর ধনী দেশগুলোও হিমশিম খাচ্ছে। একেবারেই নতুন রোগ হওয়ার কারণে এর কোন ওষুধ নেই। নেই কোন টিকা যা আমাদের এই রোগের হাত থেকে সুরক্ষা দেবে।
তাহলে এ রোগ থেকে বাঁচার উপায় কি? উপায় একটাই, এই রোগ যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেই কাজ করা। এই রোগে যে আক্রান্ত হয়েছে তার কাছ থেকে দূরে থাকা, তার সংস্পর্শে না আসা। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে কে যে আক্রান্ত আর কে নয়, তা সাথে সাথে বোঝা যায় না। করোনাভাইরাসের জীবাণু আমাদের শরীরে প্রবেশের পর রোগের লক্ষণ দেখা দেয়ার মাঝখানে ২ থেকে ১৪ দিনের বিরতি থাকে। লক্ষণ প্রকাশের আগে বোঝার উপায় নেই কেউ করোনায় আক্রান্ত কিনা, তাকে আর সবার মতোই সুস্থ দেখায়। তাই সে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করে, সবার সঙ্গে মেলামেশা করে; নিজেকে সুস্থ ভাবে।
কিন্তু সে তো শরীরে বহন করছে করোনাভাইরাসের জীবাণু। নিজেও জানে না, আমরাও জানি না। এর এভাবেই করোনা ভাইরাসের জীবাণু ছড়িয়ে দিতে থাকে অন্যদের মাঝে। একজন থেকে তিনজন, তিনজন থেকে নয়জন, নয়জন থেকে সাতাশ জন; দ্রুতই তা ছড়াতে থাকে।
কীভাবে এ ভাইরাস একজন থেকে আরেকজনের শরীরে ছড়ায়? করোনাভাইরাসের বসত নাকে-মুখে, হাঁচি-কাশির সঙ্গে এ জীবাণু বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে ছোট্ট জলকণার মতো। কিন্তু এক মিটারের বেশি দূরে যেতে পারে না। তাই দুইজনের মাঝে নিরাপদ দূরত্ব এক মিটার বা তিন ফুট। আমাদের এখন সবচেয়ে বড় চাওয়া হচ্ছে কেউ কাছাকাছি থাকবো না, এক মিটারের চেয়ে বেশি দূরে থাকবো।
আর একইসঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে হাঁচি-কাশির জলকণা যেন বাতাসে ছড়িয়ে না পড়ে, অন্যের ক্ষতির কারণ না হয়। সেজন্যই হাঁচি-কাশির সময় মুখ ঢেকে রাখতে হবে। রুমাল বা টিস্যু কাগজ দিয়ে এ কাজটি করতে পারি। রুমাল ধুয়ে বারবার ব্যবহার করা যায়। আর টিস্যু কাগজ ফেলে দিতে হবে বদ্ধ বিনে। রুমাল বা টিস্যু না থাকলে হাঁচি-কাশির সময় আমাদের হাতের কনুইয়ের ভাঁজে মুখ ঢেকে নিতে হবে। কখনোই হাতের তালু দিয়ে নয়।
আরেকভাবে এ ভাইরাস ছড়াতে পারে। তার জন্য দায়ী আমাদের হাত। আমরা কারণে-অকারণে হাত দিয়ে আমাদের চোখ, নাক, মুখ স্পর্শ করি। আবার সেই হাত দিয়েই দরজা খুলি, সিঁড়ির হাতল ধরি, লিফটের বোতাম চাপি, নানা জিনিস ধরি। এসব কাজের আগে আমরা সাধারণত হাত ধুই না, এভাবেই এতদিন ধরে আমরা চলে এসেছি।
করোনাভাইরাস এসে এ সুযোগটাই নিল। করোনাভাইরাসের রোগী যখন নাকে-মুখে হাত দেয় তখন করোনাভাইরাস তার হাতে চলে আসে। এ হাত দিয়ে দরজা খোলার সময় করোনাভাইরাস দরজার হাতলে লেগে যায়। এভাবে যেখানে যেখানে হাত পড়ে সেখানে করোনাভাইরাস লেগে যায়। এরপর একই জায়গায় হাত দিয়ে একজন সুস্থ মানুষ তার শরীরে এ করোনাভাইরাস নিয়ে আসে। হাত থেকে চলে আসে আমাদের নাকে-মুখে, তারপর শরীরে ঢুকে পড়ে।
যতক্ষণ হাতে লেগে থাকে করোনাভাইরাস ততক্ষণ আমাদের ক্ষতি করতে পারে না। নাক-মুখ দিয়ে ঢুকেই আমাদের করোনা রোগে আক্রান্ত করে। সেই জন্যই হাত ধোয়া খুব জরুরি। ধুতে হবে সাবান-পানি দিয়ে, বিশ সেকেন্ড ধরে। এভাবে হাত ধুলে করোনাভাইরাস মারা পড়ে। তাই অপরিষ্কার হাত দিয়ে নাক-মুখ ধরা যাবে না। বারবার সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়া খুবই ভাল অভ্যাস। আর যেন ভুলেও নাকে-মুখে হাত না দেই সেই অভ্যাসও করতে হবে। দরকারে তো আমাদের নাকে-মুখে দিতেই হয়, যেমন খাওয়ার সময়। আমরা তো হাত-মুখ ধুয়েই খেতে বসি।
মানুষ যদি কাছাকাছি না আসে তা হলে এ করোনাভাইরাস ছড়াতে পারবে না। সেই জন্যই দূরে দূরে থাকা। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছিলেন ‘সামাজিক দূরত্ব’। সংক্রামক রোগ যেন দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সেজন্যই এ ব্যবস্থা। শুধু যে স্কুল ছুটি দিয়েছে তাই নয়। বন্ধ হয়েছে অফিস-আদালত, সিনেমা হল, থিয়েটার, খেলার অনুষ্ঠান। যাতায়াত বন্ধ হয়েছে, উড়োজাহাজ চলছে না। চলছে না গাড়ি, স্টিমার, লঞ্চ। বড় বড় শপিং মল বন্ধ। একইসঙ্গে বন্ধ মানুষ জড়ো হবে এমন সব অনুষ্ঠান; বিয়ে, জন্মদিন, কনসার্ট।
অনেকে ‘সামাজিক দূরত্বে’র সাথে সাথে ‘শারীরিক দূরত্ব’ কথাটিও বলছেন। নাম যাই হোক, উদ্দেশ্য একটাই। আমাদের সবাইকে দূরে দূরে থেকে একই কাজ করে যেতে হবে। করোনাভাইরাসকে হারিয়ে দিতে হবে।
লেখক পরিচিতি: সহযোগী অধ্যাপক, থোরাসিক সার্জারি বিভাগ, জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, মহাখালী, ঢাকা
কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি,সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না! |