দুই বেড়াল বোনের আত্মকাহিনী, পর্ব ১

আমাদের জন্ম হয়েছিল আরও ৩ ভাই-বোনের সঙ্গে একই দিনে ঢাকার আশুলিয়াতে, কোনো এক বাড়ির সিঁড়িঘরে বা চিলেকোঠায়। আমাদের তা মনে নেই এবং অতো ছোট বয়সে যখন আমাদের চোখই ফোটেনি, তখনকার কথা আমাদের মনে থাকার কথাও না।

সুস্মিতা ও রেদওয়ানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Dec 2019, 09:45 AM
Updated : 13 Dec 2019, 09:45 AM

তবে পরে যাদের কাছে আমরা আশ্রয় পেয়েছিলাম তাদের মুখে শুনেছিলাম। আমাদের যখন মাত্র চোখ ফুটেছে তখন কি এক অজানা কারণে আমাদের মা আমাদেরকে ফেলে রেখে চলে যায়। আমরা ৫ ভাইবোন তখন এতো ছোট বয়সে সম্পূর্ণ একা এবং অসহায় হয়ে গেলাম। ক্ষুধা, ঠাণ্ডা আর ভয়ে আমরা প্রতি মুহূর্তেই দুৰ্বল হয়ে যাচ্ছিলাম।

দিনের বেলায় আমরা পেটের ক্ষুধায় নরম পায়ে দুলতে দুলতে সামান্য এদিক ওদিক যেতাম খাবারের জন্য এবং দুর্বল কণ্ঠে মেঁয়াও মেঁয়াও করতাম। কিন্তু আমাদের মা আর কোনোদিন আমাদের কাছে ফিরে আসেনি এবং আমরা কোনো খাবারও পাইনি। রাত হলেই প্রচণ্ড ক্ষুধাপেটে এবং কুকুরদের ভয়ে আমরা সব ভাইবোন জড়াজড়ি চুপচাপ করে শুয়ে থাকতাম। এভাবে কেটে গেলো ৩-৪ দিন এবং আমরা আরো দুৰ্বল হয়ে পড়লাম।

এরপর একদিন কে যেনো আমাদেরকে এনে রাস্তার পাশের ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে গেলো। দুৰ্বল শরীর আর মন নিয়ে আমরা বুঝতেই পারলাম না যে, আমরা ডাস্টবিনে কী করে আসলাম এবং আমরা তখন কী করবো। আমাদের এক ভাই দিশেহারা হয়ে দুলতে দুলতে রাস্তার উপর চলে গেলো এবং আমাদের চোখের সামনে একটা গাড়ি এসে আমাদের সেই ভাইকে চাপা দিয়ে চলে গেলো। আমাদের ভাই আমাদেরই চোখের সামনে নিথর হয়ে রাস্তার উপর পড়ে রইলো। ক্ষুধা, ঠাণ্ডা আর ভয়ে আমরা মরার মতো হয়ে গেলাম।

এমন সময় ওখানকার একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়য়ের একজন তরুণ শিক্ষক সেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে উনার মেসে যাচ্ছিলেন লাঞ্চ করার জন্য। হঠাৎ করে উনি আমাদেরকে ডাস্টবিনে দেখতে পান এবং কাছে এসে বুঝতে পারেন যে, আমাদেরকে কেউ ডাস্টবিনে এনে ফেলে গেছে এবং আমাদের মা আমাদের সঙ্গে নেই। আমাদের অসহায় অবস্থা দেখে সেই তরুণ শিক্ষক খুব সাবধানে আমাদের পাঁচ ভাই-বোনকে হাতে করে উনার মেসে নিয়ে আসেন এবং ছাদের চিলেকোঠায় মেঝের উপর পুরনো কিছু কাপড় দিয়ে বিছানা বানিয়ে আমাদেরকে সেই বিছানার উপর রাখলেন।

আমরা যেনো নতুন জীবন খুঁজে পেলাম, যদিও ক্ষুধায় তখন আমরা খুবই দুৰ্বল ছিলাম। আমাদেরকে বাসায় রেখে সেই তরুণ শিক্ষক লাঞ্চ না করেই দোকানে গেলেন এবং দোকান থেকে দুধ আর একটা প্লাস্টিকের সিরিঞ্জ কিনে আনলেন। এরপর অনেক যত্ন করে সাবধানে সেই সিরিঞ্জে দুধ ভরে আমাদেরকে আস্তে আস্তে একজন একজন করে খাওয়াতে লাগলেন।

আমাদের জন্য এই ঘটনা ছিল সৃষ্টিকর্তার সবচেয়ে বড়ো করুণা। কারণ, এই দয়ালু মানুষটা যদি আমাদেরকে এভাবে ডাস্টবিন থেকে তুলে নিয়ে না আসতেন এবং এভাবে যত্ন না করতেন, তাহলে হয়তো সেদিনই আমরা চার ভাই-বোন হয় ক্ষুধায়, নয়তো গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে অথবা কুকুরের খাবার হয়ে এই সুন্দর পৃথিবী থেকে বিদায় নিতাম। আপনাদেরকে আমাদের জীবনের এই করুণ কাহিনী বলার সুযোগ পেতাম না এবং আপনারাও আমাদের দুর্ভাগ্যের কথা কোনোদিন জানতেন না।

ওই তরুণ শিক্ষক যদিও আমাদের সব রকম যত্ন করছিলেন, তারপরও আমাদের এক ভাইয়ের ঘাড়ে কী কারণে যেনো চামড়া উঠে দগদগে ঘা হয়ে গেলো। সবচেয়ে ছোট ভাইটি একেবারেই দুর্বল ছিল- কোনোভাবেই শক্তি পাচ্ছিলো না। এতো ছোট বয়সে মাকে হারিয়ে, মায়ের বুকের দুধ আর যত্নের অভাবে আমরা সবাই খুব দুৰ্বল ছিলাম।

আমাদের ৪ ভাই-বোনের যত্ন নিতে গিয়ে তরুণ শিক্ষকের অনেক সময় লেগে যেতো। টাকা খরচ হতো এবং পরিশ্রমও হতো। তারপরও উনি আমাদেরকে অনেক যত্ন করতেন; সময় করে সিরিঞ্জে করে দুধ খাওয়াতেন, ফার্মেসি থেকে অ্যান্টিবায়োটিক মলম কিনে এনে আমাদের যে ভাইয়ের ঘাড়ে ঘা হয়েছিল সেই ঘা’তে দিনে কয়েকবার নিজের হাতে লাগিয়ে দিতেন।

তরুণ শিক্ষক একবার আমাদের ছবি তুলে ঢাকাতে উনার ছোট খালাতো ভাই-বোনদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। স্কুলে পড়া সেই ছোট ছেলেমেয়ে দুটো আমাদেরকে ওদের বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য খুব পীড়াপীড়ি শুরু করে দিলো। কিন্তু উত্তরার একটা ফ্ল্যাট বাড়িতে আমাদের চারজনকে একসঙ্গে রাখার যে ঝামেলা, সেটা বুঝে শিক্ষক সাহেব আমাদের সবাইকে সেই বাসায় নিয়ে যেতে রাজি হলেন না। শুধু আমাদের দুই বোনকে একটা বাক্সে করে নিয়ে গেলেন উত্তরাতে উনার ছোট খালাতো ভাই-বোনদের বাসায়। শুরু হলো আমাদের জীবনের নতুন অধ্যায়- নতুন গল্প।

আমাদের দুই বোনকে যখন উত্তরার নতুন বাসায় আনা হয়েছিল, তখনও আমরা অনেক ছোট এবং দুৰ্বল- কোনো রকমে টলমল পায়ে হাঁটতে পারি। এই বাসায় আনার পর আমরা যেন নতুন জীবন পেলাম। চারতলার উপর ফ্ল্যাট বাসা। অনেক বড়ো এবং ঝকঝকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এই বিশাল বাসায় শুধু চারজন মানুষ থাকতেন- বিদেশি স্কুলে পড়ুয়া ক্লাস সেভেনের একটি মেয়ে, ক্লাস সিক্সে পড়ুয়া ওর ছোট ভাই, ওদের মা আর কাজের মেয়ে। বাচ্চাদের বাবা বিদেশে কাজ করতেন এবং কয়েক মাস পর পর দেশে আসতেন ছুটিতে; দুই-তিন সপ্তাহ ছুটি কাটিয়ে আবার বিদেশ চলে যেতেন।

আমাদের দুই বোনকে দেখে এই বাসার সবাই ভীষণ খুশি হয়ে গেলো। আমাদেরকে এক কোল থেকে অন্য কোলে নিতে লাগলো এবং আমাদেরকে দুধ খাওয়ানোর জন্য ফার্মাসি থেকে নতুন করে সিরিঞ্জও কিনে আনা হলো জরুরি ভিত্তিতে। এরা সবাই আমাদের দুই বোনকে এতো আদর করতে লাগলেন যে আমরা অভিভূত হয়ে গেলাম।

প্রথমেই আমাদের মালিকানা নির্ধারণ করা হলো। আমাদের এক বোনের গায়ে সাদা লোমের মধ্যে কালো লোমের ছাপ একটু কম এবং অন্যজনের একটু বেশি ছিল। মেয়েটি আমাদের মধ্যে সাদা লোম বেশি জনের মালিকানা নিলো আর ছেলেটি মালিকানা নিলো বাকি জনের। কিন্তু শর্ত রইলো যে, আমাদেরকে যে কেউ কোলে নিতে পারবে এবং আদর করতে পারবে- মালিকানা ভিন্ন হলেও আদর-যত্ন সবাই করতে পারবে।

অনেক জার্নি করে এই বাসায় এসেই আমরা একটু গরম জায়গা খুঁজছিলাম এবং কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা তা পেয়েও গেলাম। রেফ্রিজারেটর আর ডিপ ফ্রিজের মাঝখানের চিপা জায়গায় মেঝের উপর পাশাপাশি দুটো ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজার দেখতে পেলাম, যেগুলো ভেতরের ট্রান্সফর্মারের উত্তাপে কুসুম গরম হয়ে ছিল। আমরা দুই বোন তাড়াতাড়ি গিয়ে সেই ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজারগুলোর উপর কোনো রকমে উঠে গিয়ে গুঁটিসুটি মেরে কুণ্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে গেলাম এবং নিমিষেই আরামে ঘুমিয়ে পড়লাম। এই বাসায় আসার পর আমাদের আর থাকা-খাওয়া, আরাম বা যত্নের কোনো অভাব রইলো না।

আমাদেরকে যেদিন উত্তরার বাসাতে নিয়ে আসা হলো, তার পরদিনই ভেটেরিনিয়ান ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো- আমাদের স্বাস্থ্য চেক-আপ এবং প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন দেয়ার জন্য। ভ্যাকসিন দেয়া হলো, গায়ের উকুনের জন্য শ্যাম্পু দেয়া হলো এবং টয়লেট করার জন্য স্টিলের একটা ট্রে এবং সেই ট্রেতে রাখার জন্য ছোট ছোট মাটির দানার মতো কিসের যেনো একটা বড়ো বিদেশি প্যাকেটও কিনা হলো।

বিশেষ রকম মাটির দানাভরা সেই ট্রে রাখা হলো বারান্দায় এবং বারবার আমাদেরকে সেই ট্রে-এর কাছে নিয়ে যাওয়া হলো, যেন আমরা আমাদের টয়লেট চিনতে পারি। দুই দিনের মধ্যেই আমরা আমাদের টয়লেট চিনে ফেললাম এবং আমাদের টয়লেট পেলেই আমরা সেখানে গিয়ে টয়লেট করতাম।

এই বাসাতেও আমাদেরকে সিরিঞ্জে দুধ খাওয়ানো হতো। একবার দুধ খাবার পর ঘুম দিতাম এবং ঘুম থেকে উঠার পর আবার ক্ষুধা পেতো এবং মিঁয়াও মিঁয়াও করতাম; তখন আমাদেরকে আবার দুধ খাওয়ানো হতো। ঘুম-ক্ষুধা-খাবার-ঘুম এভাবেই সেই বাসায় আমাদের দিন কাটতে লাগলো। ক্ষুধা পেলেই আমরা বাসার যে কোনো মানুষের পায়ের কাছে গিয়ে মেঁয়াও মেঁয়াও করতাম এবং আমাদেরকে সিরিঞ্জে করে দুধ খাওয়ানো হতো। এই বাসার ছেলেটা আমাদেরকে বেশি আদর করতো এবং বেশির ভাগ সময় আমাদেরকে খাওয়াতো। বাচ্চাদের মা'ও খাওয়াতেন।

মেয়েটা আমাদেরকে অনেক আদর করতো, তবে খাওয়ানোর এই ঝামেলাটা ওর মা আর ভাইয়ের উপর ছেড়ে দিয়ে ও শুধু আমাদেরকে কোলে নিয়ে আদর করতেই বেশি পছন্দ করতো। আমরা 'দুধে-ভাতে' বড়ো হতে লাগলাম এবং সিরিঞ্জের দুধ ছাড়া আমাদেরকে যে অন্য কোনো খাবার কোনোদিন খেতে হবে- সেই চিন্তা মাথায় তখনও আসেনি।

আমাদের প্রথম মালিক, সেই তরুণ শিক্ষক মাঝে মাঝে এই বাসায় আসতেন এবং খবরাখবর নিতেন, কোলে নিয়ে আদরও করতেন। এই বাসাতেই একদিন তাকে বলতে শুনলাম যে, আমাদের যে ভাইয়ের ঘাড়ে ঘা হয়েছিল, সে ভাই আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেছে। এই কথা শুনে বুক ভেঙে কান্না আসছিলো। একই সঙ্গে জন্ম নিয়ে ভাগ্যের জোরে আমরা দুই বোন আজ এতো ভালো আছি আর আমাদেরই এক ভাই ছোট বয়সে ক্ষুধা পেটে মারা গেলো, গাড়ি চাপা খেয়ে আর আরেক ভাই মারা গেলো ঘাড়ের ঘায়ে তিলে তিলে কষ্ট পেয়ে।

কিছুদিন পর আবার শুনতে পেলাম যে, আমাদের সবচেয়ে আদরের সেই দুর্বল ছোট ভাইটিও আর বেঁচে নেই- অনেক যত্নের পরও কেন জানি আর বাঁচলো না; মানুষ হলে আমরা দুই বোন গলা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতাম। কিন্তু বেড়াল হয়ে জন্ম নিয়েছি তাই এতো কিছু জেনেশুনেও, মনের কষ্ট মনের ভেতর চেপে রেখে চুপচাপ থেকেছি- যেন কিছুই হয়নি।

বেড়ালদেরকে মানুষের মতো এতো কিছু বুঝতে নেই, এতো কিছু জানতে নেই, এতো আবেগ থাকতে নেই এবং এতো কিছু অনুভব করতেও নেই- বেড়ালরা শুধু মেঁয়াও মেঁয়াও করবে আর মাছের কাঁটা খাবে- এই যেনো আমাদের ভাগ্য।  

উত্তরার এই বাসায় আমাদের দুই বোনের দুইটা নাম দেয়া হলো। নামগুলো দেয়া হলো ঠিকই, কিন্তু সেই নাম ধরে আমাদের তেমন কেউ ডাকতো না। আমরা মনের আনন্দে সারা ঘর ঘুরে বেড়াতাম, যখন ইচ্ছা, যেখানে ইচ্ছা- ঘুমিয়ে পড়তাম। আমাদের ঘুমানোর পছন্দের জায়গাগুলো হলো- ভোল্টেজ স্টেবিলিজারের উপর এবং ড্রয়িংরুমে সোফার উপর; কখনো কখনো পাপোষের উপরও ঘুমাতাম। মাঝে মাঝে বারান্দায় গিয়ে ফুল গাছের টবের উপর দাঁড়িয়ে চারতলা থেকে বাহিরের দৃশ্য দেখতাম, দখিনা বাতাসে আমাদের লোমগুলো হালকা উড়তে থাকতো। কখনো কখনো দুষ্টামি করে ফুল গাছের টবের মধ্যেই টয়লেট করে দিয়ে আসতাম- ট্রেতে আর্টিফিশিয়াল টয়লেটে না গিয়ে বেড়ালদের জন্য ন্যাচারাল টয়লেট করার স্বাদটা নিতাম।

আমরা এ বাসায় আসার প্রায় ৩ মাস হয়ে গেলো এবং আমরা অনেকটা বড়ো হয়ে গেছি। এখন সমস্যা দেখা দিলো যে, আমাদের ক্ষুধা ভীষণ বেড়ে গেছে। সিরিঞ্জ দিয়ে ভরপেট দুধ খাওয়ার ১০ মিনিট পরই আবার ক্ষুধা লাগে। এই বাসার নরম মনের ছেলেটা সারাদিন আমাদেরকে সিরিঞ্জ দিয়ে দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে বেচারার কম্পিউটার গেমস আর পিএস-৪ গেমস খেলার সময়টা অনেক কমে গেলো।

ওদের বাবা বিদেশ থেকে পরামর্শ দিলেন আমাদেরকে মাছ-মাংস এবং মাছের কাঁটা খাওয়ানো অভ্যাস করাতে। কিন্তু ছেলেটি কোনোভাবেই তাতে রাজি হলো না। কারণ, ওর ধারণা আমরা তখনও শিশু এবং শক্ত খাবার খাওয়ার বয়স তখনও আমাদের হয়নি।

মেয়েটাতো মাছের কাঁটা খাওয়ানোর কথা শুনেই ভয় পেয়ে গেলো। কারণ, ওর ধারণা আমাদের গলায় মাছের কাঁটা আটকে যাবে। যা হোক, আস্তে আস্তে আমাদেরকে শক্ত খাবার দেয়া হলো। কিন্তু শক্ত খাবারের প্রতি কোনো আকর্ষণই আমরা পেলাম না এবং খেলামও না।

এরপর একটা ঘটনা ঘটলো। এই বাসার সবাই একবার কয়েক দিনের জন্য বেড়াতে গেলো। প্রথমেই ছেলেটা প্ল্যান করলো যে, একটা খাঁচায় করে আমাদেরকে ওদের সঙ্গে নিয়ে যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনেক ঝামেলার কথা চিন্তা করে, বিশেষ করে অপরিচিত জায়গায় আমাদের হারিয়ে যাওয়ার ভয় করে ওরা আমাদেরকে নিচের তলায় দারোয়ানদের কাছে রেখে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। দারোয়ানদের কাছে আমাদের জন্য দুধ, দুধ খাওয়ানোর সিরিঞ্জ এবং দুধ খাওয়ানোর নিয়ম- সব দেখিয়ে দেওয়া হলো।

কিন্তু দারোয়ানগুলো আমাদেরকে এতো কষ্ট করে দুধ খাওয়ানোটা অপ্রয়োজনীয় মনে করলো এবং আমাদেরকে দুধের পরিবর্তে ওদের তরকারির ঝোলমাখা ভাত খেতে দিলো। প্রথম প্রথম আমরা ক্ষুধায় ভীষণ কষ্ট পেলেও সেই ঝোলমাখা ভাত খেতে পারিনি। তারপর ক্ষুধার জ্বালায় টিকতে না পেরে সেই ঝোলমাখা ভাত খাওয়া অভ্যাস করে নিলাম। আমাদের সিরিঞ্জে করে দুধ খাওয়ার চ্যাপ্টার শেষ হয়ে গেলো- আমরা তখন বড়ো হয়ে গেছি।

শক্ত খাবার খাওয়ার অভ্যাস হওয়ার পর আমরা বুঝলাম যে, এই বাসায় থাকলে আমরা মাছ-মাংস খেতে খেতেই আমাদের কলেস্টেরল বাড়িয়ে ফেলবো। আমাদেরকে এতো বেশি খাবার দেয়া হতো যে, মাঝে মাঝে খাবার দেখলেই বিরক্ত লাগতো। এক গাদা মাংস খেয়ে সারাদিন ধরে ঘুমাতাম। ঘুম থেকে উঠে আবার খেতাম- খাবার আর ঘুম- আর কোনো কাজ নেই। আমরা দুই বোন একেবারে অলস হয়ে উঠেছিলাম- বেশি খেয়ে এবং বেশি ঘুমিয়ে শরীর ব্যথা করতো এবং হাত পায়ের গিরা মটমট করতো।

এরই মধ্যে একদিন একটা দুর্ঘটনা ঘটলো। আমাদের এক বোন রাতের বেলা মেয়েটার রুমে লুকিয়ে ঘুমাচ্ছিলো। মাঝরাতে ওর ১ নম্বর টয়লেট পায়, কিন্তু বারান্দায় আমাদের জন্য রাখা টয়লেটে তখন যাওয়ার উপায় ছিল না। কারণ, রুমে এয়ার-কন্ডিশন চলছিল বলে বারান্দার গ্লাস আটকানো ছিল। এতো রাতে সবাই যখন ঘুমাচ্ছে, তখন মেঁয়াও মেঁয়াও করেও কোনো লাভ নেই। কতক্ষণ আর টয়লেট আটকে রাখা যায়? কাজেই আমাদের সেই বোন মেয়েটার রুমের এক কোণায় ১ নম্বর টয়লেটের কাজটা জরুরি ভাবে সেরে নিলো।

পরদিন মেয়েটার রুমে ১ নম্বর টয়লেটের গন্ধে ভরে গেলো; সবাই ভাবলো যে, বিছানায় আমাদের যে কোনো একজন ১ নম্বর টয়লেটের কাজটা সেরেছে। কাজেই, বিছানা পরিবর্তন করা হলো, ডেটল দিয়ে খাটের নিচ এবং ফ্লোর মোছা হলো। কিন্তু গন্ধতো আর যায় না। গন্ধ যাবে কিভাবে? টয়লেটের কাজটা-তো সারা হয়েছে ড্রেসিং টেবিলের নিচে এক কোণায়- সেখানে কি কারো চোখ পড়ে? শেষমেশ প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে এই বাসার লক্ষ্মী মেয়েটা বিনা প্রতিবাদে এই গন্ধ সহ্য করেছে; এরপর আস্তে আস্তে গন্ধ চলে গেছে।

এই ঘটনার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে, রাতের বেলা আমাদেরকে বারান্দায় রাখা হবে এবং বারান্দার গ্লাস লাগিয়ে দেওয়া হবে। এতে ছেলেটা ভীষণ আপত্তি করলো। কারণ, ওর ধারণা যে আমরা এখনো অনেক ছোট এবং আমরা বারান্দায় একা থাকলে ভয় পাবো- বিশেষ করে ভুতের ভয়। তারপরও আমাদেরকে রাতের বেলা বারান্দায় রাখার সিদ্ধান্তই কার্যকর হলো।

এই বিষয়টা আমাদের কাছে অন্যায় মনে হয়েছে। কারণ, টয়লেট পাওয়াতো একটা ন্যাচারাল ব্যাপার; সেই রাতে বারান্দাতে আমাদের নিজস্ব টয়লেটে যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না বলেইতো বাধ্য হয়ে আমাদের এক বোন মেয়েটার ঘরের এক কোণায় ১ নম্বর টয়লেট সেরেছে। এই সামান্য ব্যাপারে আমাদেরকে রাতের বেলা বারান্দায় নির্বাসন দেওয়াটা কি ঠিক হয়েছে? এখানে আমাদের দোষটা কোথায়? মানুষ হলে এই যুক্তিগুলো দিয়ে বাসার লোকজনের সঙ্গে তর্ক এবং ঝগড়া করতে পারতাম। কিন্তু বেড়াল হয়েছি বলে সেটা আর সম্ভব হয়নি- ভাগ্যকে মেনে নিতে হয়েছে।

প্রথম রাত বারান্দায় থাকতে ভালো লাগেনি। এয়ার কণ্ডিশনারের শব্দে ঘুমাতে পারছিলাম না। কিন্তু তারপরই বুঝলাম যে, এয়ার কন্ডিশন শব্দ করলেও এর গরম বাতাসটা চমৎকার- দুই বোন জড়াজড়ি করে এয়ার কন্ডিশনার নিচে এক কোণায় নাক ডেকে ঘুমিয়ে পড়লাম। এরপর থেকে রাতের বেলা বারান্দায় থাকাটা আমাদের অভ্যাস হয়ে গেলো।

সমস্যা দেখা দিলো যখন বর্ষাকাল এলো। বৃষ্টির এই মৌসুমে আমাদেরকে রাতের বেলা বারান্দায় রাখাটা কোনোভাবেই ছেলেমেয়েগুলো মেনে নিলো না। কাজেই, আমরা দুই বোন আবার 'ঘরের মেয়ে ঘরে' ফিরে আসলাম।

এর কয়েকদিন পর আরেকটা দুর্ঘটনা ঘটলো। সন্ধ্যার সময় কী যেন খাবার মজা পেয়ে বেশি খেয়ে ফেলাতে আমাদের এক বোনের রাতের বেলা ২ নম্বর টয়লেট পেয়ে বসলো। কিন্তু আমাদের জন্য যে টয়লেট, সেটাতো বারান্দায় এবং বারান্দার গ্লাস আটকানো। শেষে কি আর করা, আমাদের সেই বোন এই বাসার ছেলেটার রুমের দরজার সামনে পাপোষের উপর ২ নম্বর টয়লেটটা সেরে নিলো।

পরদিন সকালে এ নিয়েতো বাসায় মহা হুলুস্থুল লেগে গেলো- ‘বেড়াল ভাগাও’ আলোচনাটা শুরু হলো।

চলবে...

লেখক পরিচিতি: সুস্মিতা (সপ্তম শ্রেণি) ও রেদওয়ান (ষষ্ঠ শ্রেণি), ইন্টারন্যাশনাল হোপ স্কুল বাংলাদেশ, উত্তরা, ঢাকা

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!