তুতুন আর বেড়ালের বাচ্চা

তুতুনরা তিন মাস হলো যুক্তরাষ্ট্রে এসেছে। দেশে থাকতে মামা যখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভিডিও কল দিত বা কার্টুন সিনেমায় দেখে যুক্তরাষ্ট্রে আসতে খুব ইচ্ছা করত তার। আসার পরও প্রথম প্রথম খুব ভালো লাগছিল, কিন্তু সমস্যা হলো স্কুল শুরুর পর।

গৌরব দাশ নয়নবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Dec 2019, 08:25 AM
Updated : 2 Dec 2019, 08:25 AM

ঢাকায় ক্লাস থ্রিতে পড়ত সে, এখানে এসে ভর্তি হয় গ্রেড থ্রিতে। এমনিতে পড়ায় সে খুব ভালো, কিন্তু এখানে সবসময় ইংরেজিতে কথা বলতে হয়, এটা নিয়ে লাগল সব গোলমাল। এমন নয় যে সে ইংরেজি পারে না, দেশে সবসময় এ-প্লাস পেত ইংরেজিতে, কিন্তু এখানে বলতে গেলে কেমন যেন ভয় আর জড়তা কাজ করে, গলা যেন ধরে আসে!

শুধু মনে হয় কেউ যদি হাসে, ঢাকার স্কুলের বন্ধু গিল্টুর মতো যদি তাকে নিয়ে মজা করে? গিল্টু তাকে খুব ক্ষেপাত, কিন্তু সে ছিল তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। গিল্টুসহ অন্যসব ক্লাসমেটদের কথাও তার ইদানিং খুব মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্রে আসার সময় প্রথম প্লেন চড়ার আনন্দে হয়ত সেটা অনুভব করেনি, তখন সেই তাদের বুঝিয়েছে ‘তোমরা মন খারাপ করো না, আমি তো আবার আসব। তোমাদের জন্য অনেক চকলেট আনব...’।  

কিন্তু এখন তাদের কথা মনে হলে ভেতরটা তার মোচড় দিয়ে ওঠে। অনেক সময় কাঁদতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সে কাঁদে না, পাছে সবাই যদি তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। ইচ্ছা থাকলেও সে সবার সঙ্গে মিশতে পারে না, টিচারের অনেক প্রশ্নের উত্তর জানলেও কিছু বলতে পারে না, ক্লাসের এককোণে মনমরা চুপচাপ বসে থাকে।

আর চুপচাপ বসে থাকে আরেকটি ছেলে যে তার মতই নতুন এসেছে ক্লাসে, তার চোখ দুটো খুব ছোট টানা টানা, মা বলেছে তারা নাকি চীনা। তুতুন অবশ্য খেয়াল করেছে তার ক্লাসের একটা মেয়েও ক'দিন ধরে বেশ চুপচাপ বিষণ্ণ থাকে, টিচারের মুখে শুনেছে মেয়েটির নাম ভ্যালেন্টিনা।

স্কুল ছুটি হয়েছে, তুতুন তার টিচারের সঙ্গে দাঁড়িয়ে মায়ের জন্য অপেক্ষা করছে, টিচার আজও বলছিল ভয় না পেয়ে বেশি বেশি ইংরেজি প্র্যাক্টিস করতে। নভেম্বর মাসে এখানে অনেক ঠাণ্ডা আর তীব্র বাতাস, আজ তার মার আসতেও দেরি হচ্ছিল। হঠাৎ তার চোখ পড়ল কাছেই একটা গাছের নিচে। সেখানে সাদা ধবধবে ছোট একটা কিছু নড়াচড়া করছিলো। টিচারের অগোচরে সে সেদিকে এগিয়ে গেল। কাছে গিয়ে দেখল, সেটা একটা বেড়ালের বাচ্চা। ধবধবে সাদা বরফের মতো বাচ্চাটি মিউমিউ করে যাচ্ছে।

মা-বাবা বলেছে মালিককে জিজ্ঞেস না করে পশুপাখি না ধরতে। কিন্তু এখানে তো কেউ নেই, বড্ড মায়া হচ্ছে তার, কিন্তু কী করবে? এই ভাবতে ভাবতেই তার ক্লাসের সেই চীনা ছেলেটাও সেখানে চলে আসল। সেও খুব গভীর মনোযোগে বেড়ালের বাচ্চাকে দেখতে লাগল। এরপর তুতুনের দিকে তাকিয়ে বলল 'ক্যাট'।

কী করা যায় এ নিয়ে তুতুন আর তার মধ্যে ইশারায় ইশারায় এবং আস্তে আস্তে ভাংগা ইংরেজিতে কথা হতে লাগল। তারা দুজনেই তাদের লাঞ্চের বেঁচে যাওয়া কিছু খাবার নিরাশ্রয় বেড়ালটিকে দিল। চীনা বন্ধুটি, যার নাম শি মিং বলে তুতুন জানল, একটা তোয়ালে বের করে বেড়ালটির গায়ের উপর দিল। তারা দুজনে বেড়ালটিকে স্কুল বিল্ডিংয়ের এক বারান্দার কোণে রেখে সেদিনকার মতো বাসায় গেল।

এরপর রোজ তুতুন আর শি মিং বেড়ালটার পরিচর্যা করতে লাগল সবার অগোচরে। ক্রমে তারা দুজন ভালো বন্ধুও হয়ে উঠল এবং অজান্তেই দুজন ইংরেজিতে ভালো কথোপকথন করতে লাগল। বেড়ালের যত্ন নিতে তারা স্কুলেও একটু আগেই চলে যায়, আসল ঘটনা না জেনে, ছেলের স্কুলের প্রতি আগ্রহ দেখে মা-বাবাও খুশি। তার টিচারও বলেছে সে এখন সবার সঙ্গে টুকটাক কথা বলে।

এরকম চলল প্রায় দুই সপ্তাহ। একদিন স্কুল শেষে তুতুন আর শি মিং বেড়ালের বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছিল আর লক্ষ্য রাখছিলো মা-বাবা আসছে কিনা। এমন সময় তুতুন দেখল, আজ ওকে নিতে মামা এসেছে। সে দৌড়ে গিয়ে মামাকে জড়িয়ে ধরল, বেড়ালের বাচ্চাকেও লুকালো না। কারণ মামা অন্য বড়দের মতো নন, তিনি তুতুন আর অন্য বাচ্চাদের বন্ধুর মতো।

মামা বেড়ালটিকে দেখে কোলে তুলে নিলেন। বেড়ালটির প্রাণ রক্ষা করার জন্য বাহবা দিলেন বটে, এরপর যা বললেন তা শুনে তুতুন আর মিংয়ের মন খারাপ হয়ে গেল। মামা জানালেন এটি একটি পোষা বেড়াল, কারণ এর গলায় লকেট আছে, সম্ভবত এটি হারিয়ে গেছে এবং একে এর মূল মালিকের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে।

তুতুন আর শি মিং রাগ করল। কিন্তু মামার আরও কথা শোনার পর তারা বুঝতে পারল কোনটা ঠিক। মামা যখন বললেন এই বেড়ালটির মালিক হয়ত তোমাদের মতই এক বাচ্চা, যে বেড়াল হারিয়ে হয়ত দিনরাত কাঁদছে, একথা শোনার পর তুতুনের মন গলে গেল। সে রাজি হলো, শি মিং ও, বেড়ালটিও 'মিয়্যাও' করে উঠল।

মামা বেড়ালের বাচ্চার একটা ছবি তুলে ফেইসবুকের 'লস্ট পেট অব দি এরিয়া' নামের পেজে পোস্ট দিলেন আর বাচ্চাটিকে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে দিয়ে এলেন। রাতে তুতুন জানতে পারল, বেড়ালের বাচ্চার আসল মালিককে পাওয়া গেছে, তারা পরদিন সকালে তুতুনদের বাসায় আসবে ধন্যবাদ দিতে। তুতুনের একটু মন খারাপ হলো, কিন্তু আবার মনে হলো নিজের প্রিয়জনদের সঙ্গে বেড়ালছানা থাকবে, এর চেয়ে ভালো কী হতে পারে!

পরদিন সকালবেলা কলিংবেল বেজে উঠল, তুতুনের মা বললেন নিশ্চয়ই বেড়ালের মালিক এসেছেন। তুতুনই গেল দরজা খুলতে। দরজা খুলে তুতুন অবাক! বেড়াল ছানা কোলে এ যে তারই ক্লাসমেট ভ্যালেন্টিনা! দৌড়ে এসে সে তুতুনকে ধন্যবাদ জানাল, অন্তত এক হাজারবার! ভ্যালেন্টিনার মা-বাবাও তুতুনের খুব প্রশংসা করলেন। শেষে তারা বললেন, তুতুন আর তার বন্ধু শি মিং যখন ইচ্ছা তাদের বাসায় গিয়ে বেড়ালছানা এমি আর ভ্যালেন্টিনার সঙ্গে খেলতে পারে।

দেখতে দেখতে তিন চার মাস পার হয়ে গেল। তুতুন তুষারপাত দেখে যতটা না অবাক হয়েছিল, সবাই তার চেয়ে বেশি অবাক হয় তুতুনের ইংরেজি বলার দক্ষতা দেখে। ক্লাসের সবাই এখন তার বন্ধু, যদিও শি মিং আর ভ্যালেন্টিনা একটু বেশি প্রিয়। রাত এগারোটায় হঠাৎ তুতুনের মায়ের ফোনে একটা ভিডিও কল আসে, মা তুতুনকে চিৎকার দিয়ে ডাকতে থাকেন, 'তুতুন দেখে যা কে ফোন করেছে!'।

দৌড়ে আসে তুতুন, এ যে ক্লাস থ্রির ক্লাস টিচার রোখসানা ম্যাডাম। তিনি ফোর-এ গণিত পড়ান, তার সঙ্গে আছে তুতুনের বাংলাদেশের স্কুলের সব বন্ধুরা! তুতুন এক শ্বাসে বেড়ালের বাচ্চার গল্প বলে যায়। সবাই শোনে খুব অবাক হয়, শুধু গিল্টু দুই একটা উদ্ভট প্রশ্ন করে। রোখসানা ম্যাডাম জানতে চান, তারা কবে বাংলাদেশ বেড়াতে আসবেন, তুতুন বলে সে জানে না। তুতুনের বাবা তখন পাশ থেকে বলেন, ‘আমরা সামারে আসব রোখসানা আপা...’।

তুতুন খুশিতে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে। সে জানে বাবা একটু গম্ভীর মানুষ কম কথা বলেন, কিন্তু কখনো মিথ্যা আশা দেন না। ক্লাসের বাচ্চারাও ফোনের ওপার থেকে উল্লাস করে ওঠে।

শহরের অন্য প্রান্তে ভ্যালেন্টিনাদের বাড়িতে এমি নামের বেড়ালছানাও হঠাৎ আনন্দে মিঁয়্যাও বলে ওঠে।

লেখক: গৌরব দাশ নয়ন, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!